জাতীয় সংসদ নির্বাচন
এম. সাইফুল ইসলাম
প্রকাশ : ২১ মে ২০২৫ ০৮:১২ এএম
হার্ডলাইনে যাচ্ছে বিএনপি
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন আদায়ে হার্ডলাইনে যাচ্ছে বিএনপি। দ্রুত সময়ে নির্বাচনি রোডম্যাপ আদায়ের জন্য কর্মসূচি দেওয়ার কথাও ভাবছে দলটি। ইতোপূর্বে নির্বাচন, সংস্কারসহ নানা ইস্যুতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে দলটির টানাপোড়েন থাকলেও ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র হিসেবে ইশরাক হোসেনকে শপথ না দেওয়াকে কেন্দ্র করে সেটি আরো স্পষ্ট হয়েছে।
এছাড়া প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ঘোষিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন না করে তা পেছাতে সরকারের মধ্যে কেউ কেউ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত বলেও মনে করছে দলটি। তাই তিন অঙ্গসংগঠনের চলমান তারুণ্য সমাবেশ ও সদস্য সংগ্রহ শেষ হওয়ার পর মূল দলের কর্মসূচির কথা ভাবছেন নেতারা। মূলত সরকারকে চাপে ফেলতে নেতাকর্মীদের রাজপথমুখী কর্মসূচির দিকেই এগোচ্ছে বিএনপি। সেই পরিকল্পনা থেকেই দলটি যুগপৎ আন্দোলনে থাকা মিত্রদেরও মতামত নিচ্ছে। সবশেষ গত সোমবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও বিষয়গুলো উঠে এসেছে।
বিএনপি নেতারা বলছেন, দেশে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে দ্রুত জাতীয় নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। মানুষের ভোটাধিকারে বিশ্বাসী একটি দল হিসেবে বিএনপি নির্বাচন চাইছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার চলতি বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন দেয়ার কথা বললেও এখনও সুনির্দিষ্ট কোনো রোডম্যাপ ঘোষণা করছে না। তাই বিএনপি নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণায় যা কিছুর করার দরকার তা করতে চায় বিএনপি। এছাড়া আদালতের রায়ের পরও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে ইশরাক হোসেনের শপথ না পড়ানো নিয়ে সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন বিএনপি নেতারা।
জানা গেছে, গত বছর ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। হাসিনা সরকারের এই পতনকে নিজেদের দীর্ঘ আন্দোলনের একটি পরিণতি বা সমাপ্তির অধ্যায় বলে মনে করছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপি। দলটির নেতাকর্মীদের ভাষ্যমতে, দীর্ঘদিন তাদের গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের শেষটা নামিয়েছে ছাত্র-জনতা। তাদের প্রত্যাশা ছিল- অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দ্রুততম সময়ে মৌলিক সংস্কারের পর একটি নির্বাচন দেবে। সেই নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠিত হলে সেটিই হবে গণতান্ত্রিক সরকার।
যার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সুফল পাবেন দেশের মানুষ। কিন্তু ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ নয় মাস পার হলেও নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে সরকার সুষ্পষ্টভাবে এখনো কোনো ঘোষণা দেয়নি। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরও গণতান্ত্রিক লড়াই শেষ হয়নি বলে মনে করছেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। ফলে, বিএনপির হাইকমান্ড থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত সরকারের উপর ক্ষুব্ধ মনোভাব তৈরি হয়েছে।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, বিএনপি সরকারকে সংস্কারের জন্যে সময় দিচ্ছে। কিন্তু সংস্কারের নামে কেউ কালক্ষেপণ করতে চাইলে জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী দল হিসেবে সেটা মেনে নিতে পারি না।
তিনি বলেন, প্রকৃত অর্থে একটি সংস্কার করতে হলে অবশ্যই নির্বাচিত সংসদের কোনো বিকল্প নেই। নির্বাচনের লক্ষ্যে রোডম্যাপ ঘোষণার জন্য এতদিন ধরে আমরা সরকারের কাছে যে আহ্বান জানিয়ে আসছি, সে ব্যাপারে সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। যে কারণে আমরা দাবি আদায়ে কর্মসূচির কথা ভাবছি।
তিনি আরো বলেন, আদালতের রায় দেওয়ার পরও ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ইশরাক হোসেন শপথ পড়াতে এতো গড়িমসি কেন সরকারের। এসব কারণে সরকার এখন নিরপেক্ষতা হারাচ্ছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, সংস্কারের নামে এ সরকারকে মানুষ সারাজীবন ক্ষমতায় দেখতে চায় না। দেশের চলমান প্রেক্ষাপটে নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। অথচ সরকারের সেদিকে খেয়াল নেই বরং নির্বাচন পেছাতে নানামুখী কূটকৌশল চলছে। বিএনপি মানুষের ভোটাধিকার অধিকার লড়াইয়ের আন্দোলনে ছিল ও আছে। প্রয়োজনে দেশবাসীকে সঙ্গে নিয়ে ফের কর্মসূচিতে যাবে দল।
বিএনপি নেতাকর্মীরা মনে করছেন, গণতন্ত্রের জন্যেই বিএনপিসহ দেশের বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক প্রায় দেড় দশক ধরে শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছে। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর এখন একটি নির্বাচিত সরকার সবার চাওয়া। কারণ, নির্বাচিত সরকার ছাড়া জনগণের কাছে প্রকৃত দায়বদ্ধতা থাকে না। দেশে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই বলেও মনে করছেন বিএনপি নেতারা। কিন্তু একটি পক্ষ নির্বাচন পেছানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত বলেও দলটির অভিযোগ।
কারণ হিসেবে তারা বলছেন, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের নয় মাস পার হলেও সরকার সংস্কারকাজ নিয়েই ব্যস্ত রয়েছে। সরকার বারবার বলার চেষ্টা করছে, ন্যূনতম সংস্কার ছাড়া এখনই ভোট দিলে ফের আরেক স্বৈরাচার মাথাচাড়া দিতে পারে। এমন বক্তব্যের পাশাপাশি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ছাত্র নেতাদের দিয়ে রাজনৈতিক দল গঠনও ভালোভাবে নেয়নি বিএনপি। কারণ, শুরুতেই এসব ছাত্র নেতারা নির্বাচনকে অগ্রাহ্য করে সংস্কারকে জোর দিয়েছেন। এছাড়া আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ ইস্যু ও জুলাই ঘোষণাপত্রসহ নানা গুরুত্বহীন ইস্যু নিয়ে তারা সময় কাটাতে চায়।
বিএনপির একাধিক সূত্র বলছে, সাম্প্রতিক সময়ে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ শীর্ষ নেতারা ন্যূনতম সংস্কার শেষে একটি জাতীয় নির্বাচনের উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। নির্বাচনি রোডম্যাপ আদায়ে প্রয়োজনে কর্মসূচির ঘোষণার কথাও বিভিন্ন সময়ে বলেছেন তারা। বিশেষ করে আদালতের রায়ের পর ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র হিসেবে ইশরাক হোসেনকে শপথ পড়ানোর দাবিতে গত কয়েকদিন থেকে নগর ভবনের কার্যক্রম বন্ধ করে আন্দোলন করছে তার সমর্থকেরা। গত দুই দিন থেকে সেখানে ব্লকেড কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। এরপরও সরকার কর্ণপাত না করায় ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন বিএনপি নেতারা।
গতকাল মঙ্গলবারও বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, আদালতের রায় ঘোষণার পরও ইশরাক হোসেনকে শপথ নিতে দেওয়া হচ্ছে না। এখানে অন্তর্বর্তী সরকার গায়ের জোর খাটাচ্ছে। চট্টগ্রামে ডা. শাহাদাত মেয়র হতে পারলে ইশরাক কী দোষ করল? অর্থাৎ সরকার গায়ের জোরে ইশরাককে মেয়র হতে দিচ্ছে না। খিলক্ষেতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহত রাকিবুল হাসানকে দেখতে গিয়ে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা বলেন।
রিজভী বলেন, স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার বয়স অনেক কম। হঠাৎ গুরুতর রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পেয়ে গেছেন। এজন্য তার কথাবার্তায় ভারসাম্যহীনতা রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের প্রকৃত অপরাধীদের এখনও বিচারের মুখোমুখি করা হয়নি। কাজের চাইতে অকাজ বেশি করছে অন্তর্বর্তী সরকার।
এদিকে গত সোমবার বিকালে বিএনপির সিলেট বিভাগীয় সদস্য ফরম সংগ্রহ ও নবায়ন কর্মসূচির উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, এই সরকার গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে কথা বলছে ও কাজ করছে। দ্রুত জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা না হলে ড. ইউনূস তার সম্মান রক্ষা করতে পারবেন না। একই সঙ্গে তিনি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র হিসেবে ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেনকে দ্রুত শপথ গ্রহণ না করানো হলে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলা হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
তিনি আরো বলেন, উপদেষ্টাদের মধ্যে কেউ কেউ দীর্ঘস্থায়ী ক্ষমতা ভোগের স্বপ্ন দেখছেন। চক্রান্ত করে দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করছেন। একজন নারী উপদেষ্টা দাবি করেছেন, তারা নাকি জনতা দ্বারা নির্বাচিত। প্রধান উপদেষ্টার উচিত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া, অন্যথায় তিনি নিজেও সম্মান রক্ষা করতে পারবেন না।
সোমবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে নানা আলোচনা উঠে আসে। সরকার নির্বাচন আয়োজনে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপের দিকে অগ্রসর না হওয়ায় বিএনপিতে নানা সন্দেহ তৈরি হয়েছে আলোচনা উঠে আসে। নির্বাচন নিয়ে গভীর ষড়যন্ত্রও দেখছে বিএনপি। দলটি সরকারের উপরে চাপ তৈরিতে মাঠে নামতে চায়। এছাড়া সরকারের ইন্ধনে কিছু রাজনৈতিক দল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ নয় এমন ইস্যুতে আন্দোলনে নামার পর বিএনপি মনে করছে এটি নির্বাচন পেছানোর কৌশল।
বৈঠকের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, যুবদল, ছাত্রদল ও স্বৈচ্ছাসেবক দলের উদ্যোগে যে তারুণ্য সমাবেশ হচ্ছে সেখানে ব্যাপক সাড়া মিলেছে। এছাড়া দুই মাসব্যাপী চলবে সদস্য সংগ্রহের কাজ। তারপরেই মূল দল বিএনপিও মাঠে নামতে চায় নির্দিষ্ট এজেন্ডোয়। ইতোমধ্যে বিএনপি নেতারা মিত্রদের সঙ্গে দলটি কথাবার্তা বলা শুরু করেছেন। তারা ধারাবাহিকভাবে বৈঠকও করছেন।
বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, কিছুদিনের মধ্যে সরকার সুনির্দিষ্টভাবে নির্বাচনের রোডম্যাপ না দিলে অতীতের মতো সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে যুগপৎভাবে আন্দোলনে নামব। নির্বাচন ছাড়া এভাবে দেশ চলতে পারে না। নির্বাচন না হলে দেশে আরো অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।
এ ব্যাপারে যশোর জেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, নির্বাচিত সরকার ছাড়া দেশ সঠিকভাবে পরিচালনা সম্ভব নয়। সংস্কার যেমন দরকার তেমনি নির্বাচনও দরকার। সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া।
তিনি বলেন, নির্বাচন আদায়ে বা সার্বিক বিষয়ে দলের হাইকমান্ড যে সিদ্ধান্ত নেবে সেটি বাস্তবায়নে অতীতের মতো এখনো তৃণমূল মাঠে থাকবে।
ভোরের আকাশ/এসএইচ