মাজাহারুল ইসলাম
প্রকাশ : ২৯ আগস্ট ২০২৫ ০২:৫৯ পিএম
সংগৃহীত ছবি
দেশবিরোধীরাই আজ বিতর্কিত বিষয় নিয়ে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে বলে ভাবছেন দেশের জনপ্রিয় বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি। দলটির শীর্ষ নেতৃবৃন্দ বলেছে, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করছে গণতন্ত্রবিরোধী একটি গোষ্ঠী। এরা বিতর্কিত বিষয় নিয়ে দেশকে গভীর সংকটে ফেলার চক্রান্ত করছে বলেও মনে করছেন তারা।
বিএনপির মতে, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দিয়ে জনগণের সরকার তৈরি হবে, তারা গণতন্ত্রের স্বার্থে সংবিধান সংশোধন করবে। সেটা তাদের দায়িত্ব। নির্বাচিত সংসদ ব্যতিত সংবিধান সংশোধন সম্ভব নয়। আইন বা সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন হলে, সেটা নির্বাচিত সংসদের মধ্যদিয়েই করতে হবে। পিআর পদ্ধতি নির্ধারণের জন্য গণভোটের দাবি তোলার আগে নির্বাচন দিয়ে জনমত যাচাই করার আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপির শীর্ষ নেতারা।পিআর গণভোটের দাবি তোলার আগে নির্বাচন দিয়ে জনমত যাচাই করতে হবে। জনগণই সিদ্ধান্ত নেবে আগামীর বাংলাদেশ কীভাবে চলবে। এছাড়াও নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্রকারীরা দেশের অগ্রগতি চায় না বলেও মত বিএনপি নেতাদের।
প্রসঙ্গত, জুলাই সনদের খসড়া মতামতে বিএনপি বলছে, যেসব সংস্কার কার্যকরে সংবিধান সংশোধন করতে হবে, সেগুলো আগামী সংসদে বাস্তবায়ন করা হবে। তবে জামায়াতে ইসলামী বিরোধিতা করে জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোট দাবি করেছে।
খসড়ায় বলা হয়েছে, সংবিধান ও আইনের ওপর প্রাধান্য পাবে সনদ। কোনো আদালতে সনদ নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না। এ দুই অঙ্গীকারে বিএনপি রাজি নয়। তবে, এতে একমত জামায়াতে ইসলামী। আর সনদের আইনি ভিত্তি চাইলেও সংবিধানের ওপর প্রাধান্য চায় না এনসিপি। একইসঙ্গে জামায়াত ইসলামী জুলাই সনদের অধীনে নির্বাচন চায়, বিরোধিতায় রয়েছে বিএনপি ও তার সমমনা দলগুলো।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বাংলাদেশে এক ধরনের উগ্রবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। এই উগ্রবাদকে মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে দেওয়া যাবে না। তিনি বলেন, দেশে একাত্তরকে ভুলিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র চলছে। আজ ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদদের কথা বারবার স্মরণ করতে চাই। এজন্য চাই যে, ১৯৭১ সাল আমাকে একটা স্বাধীন দেশ দিয়েছিল, ভূখণ্ড দিয়েছিল, আমাকে একটা স্বাধীন সত্তা দিয়েছিল এবং সেজন্য আজ আমার অস্তিত্ব আছে, আমি টিকে আছি। আমি স্মরণ করতে চাই, ২৪ জুলাই-আগস্টের শহীদদের। কারণ তারা আমাদের একটা গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখার সুযোগ করে দিয়েছি।
মির্জা ফখরুল বলেন, একাত্তর ও চব্বিশ দুটা জিনিসই আমাদের মাথায় রাখতে হবে। চব্বিশের জুলাই-আগস্ট যেভাবে সত্য, ঠিক একইভাবে সত্য কিন্তু একাত্তরের নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ। আজ একটা প্রচ্ছন্ন প্রচেষ্টা আছে একাত্তর ভুলিয়ে দেওয়ার- এটার বিরুদ্ধে কিন্তু আমাদের বাংলাদেশের সব নাগরিককে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে গণভোট ও গণপরিষদের চিন্তা বাস্তবসম্মত নয়। জুলাই সনদ হচ্ছে জনগণের সামনে রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গীকার এবং সেই অঙ্গীকার আইনের চেয়েও বেশি শক্তিশালী।
এক্ষেত্রে বিএনপির সিদ্ধান্ত হচ্ছে- সংবিধান সংশোধনের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, রাজনৈতিক ঐকমত্য হওয়া এমন সংস্কার প্রস্তাবগুলো অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাহী আদেশে ও অধ্যাদেশের মাধ্যমে নির্বাচনের আগেই বাস্তবায়ন করতে পারে। আর যেসব সংস্কার প্রস্তাব সংবিধান সংশোধন সংশ্লিষ্ট সেগুলো নির্বাচিত সংসদ করবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেনে, সংবিধান পরিবর্তনের অধিকার শুধু নির্বাচিত প্রতিনিধিদের। কোনো অনির্বাচিত ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর পক্ষে সংবিধানের ওপর প্রভাব বিস্তার করা গ্রহণযোগ্য নয়।
তিনি বলেন, বর্তমান সরকার একটি ‘জুলাই সনদ’ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাছে পাঠিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যে যে সনদ গৃহীত হবে, সেটি নাকি সংবিধানের ওপরে স্থান পাবে। এটি তো কখনো হতে পারে না। সারা পৃথিবীতে সংবিধান প্রণয়ন করে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা। বাংলাদেশেও তাই হয়েছে, ভবিষ্যতেও ইনশাআল্লাহ তাই হবে।
তিনি আরও বলেন, দেশবাসী একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রত্যাশায় আছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে সেই নির্বাচন হলে নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই ভবিষ্যতের সংবিধান নির্ধারণ করবেন।
জামায়াতে ইসলামী ও নতুন গড়ে ওঠা কয়েকটি দলের সমালোচনা করেন হাফিজ উদ্দিন বলেন, একটি দল স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে, আরেকটি ১৯৪৭-এর বিরোধিতা করেছে। এরা আজ জনগণের মালিক সাজতে চায়। তারা জানে নির্বাচনে তাদের কোনো সুযোগ নেই, তাই শুধু বিএনপিকে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখতেই ব্যস্ত।
জামায়াত প্রসঙ্গ টেনে তিনি আরও বলেন, আমরা এত বছর জামায়াতকে আশ্রয় দিয়েছি, এমনকি তাদের মন্ত্রী বানিয়েছি। অথচ এখন তারাই বিএনপিকে আক্রমণ করছে।
বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও জাতীয় সংসদের সাবেক চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক বলেছেন, একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের সঙ্গে ঐক্য হয়ে ভারতে বসে বাংলাদেশ নিয়ে ষড়যন্ত্র করেছেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, ৭১ বিরোধীরা ষড়যন্ত্র করে পিআর পদ্ধতিতে ভোট চাচ্ছে। যারা বুকের রক্ত দিয়ে দেশের স্বাধীনতা এনেছে, তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে অস্থিরতা সৃষ্টি করলে দেশের মানুষ সেটা রুখে দেবে। এই দেশটা এখন জনগণের। এটা এখন আর হাসিনার বাংলাদেশ নয়। আমার ভোট এখন আমিই দেব, সে ভোটের জন্য আমরা আত্মাহুতি দিয়েছি। এই ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনার জন্য ১৬টি বছর অপেক্ষা করেছি। এখন যদি কেউ সেই ভোটাধিকার হরণ করতে চায়, তাহলে তার জবাব আপনারাই দেবেন। যদি এই দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হয়, আল্লাহ ছাড়া কেউ ধানের শীষকে রুখতে পারবে না।
বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এড সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেছেন, দেশে গণতন্ত্র পুনর্নিমাণের পদক্ষেপ চলছে এর মাঝে যারা এখন বিতর্কিত জিনিস সামনে নিয়ে আসছে। তারা মুক্তিযুদ্ধের ও বিরোধিতা করেছে।
তিনি বলেন, গণতন্ত্র পুনর্নিমাণের যে পদক্ষেপ আজ সারা বাংলাদেশের চলছে এর মাঝখানে কিছু কিছু বিতর্কিত জিনিস যারা উত্থাপন করছে তারা মুক্তিযুদ্ধের সময়ও একই কাজ করেছে।
জামায়াতের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ৫ আগস্টের পরে ৩০০ আসনের প্রার্থিতা ঘোষণা করেছে একটি রাজনৈতিক দল, তারা আবার পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চাচ্ছে। কোন টা ঠিক? আগে যে ৩ শত আসনের প্রার্থীতা দিলেন সেটা ঠিক নাকি পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন ঠিক? আগে সেটা ঠিক করেন।
যুবদলের সাবেক এই সভাপতি বলেন, বিএনপি বরাবর গণতন্ত্রের পক্ষে, গণতন্ত্রের কাতারে দাঁড়িয়েছে। এই দেশে এমন একটি দল দেখান যে দল ছোট ছোট অনৈতিক কাজের জন্য তিন হাজার এর উপরে নেতা-কর্মীদেরকে বহিষ্কার করেছে। সেটা একমাত্র বিএনপি করেছে। বিএনপি'র চামড়া তুলে নিবেন নেন, বিএনপি অর্জুন গাছ। অর্জুন গাছের চামড়া তুলে নিলেও সে গাছ মরে না।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, যারা ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে, গণতন্ত্রের স্বপক্ষে কাজ করতে পারেনি, তারাই এখন নতুনরূপে, নতুনভাবে এই নির্বাচনকে ঠেকানোর চেষ্টা করছে।
তিনি বলেন, ১৯৭১-এ আপনারা যে ভুল করেছেন, তা সংশোধনের একটি সুযোগ এখনো আছে। আপনারা এখনো ক্ষমা চাননি। ক্ষমা চান, নির্বাচনে অংশ নিন। তাহলে অতীতের কিছু ভুল হলেও মোচন হবে।
তিনি আরও বলেন, একসময় আন্দোলনের স্বার্থে, গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের স্বার্থে বিএনপি আপনাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। সেই সময় আপনাদের সাধারণ মানুষের কাছে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। বিএনপি তখন ক্ষতিগ্রস্ত হলেও জাতীয় স্বার্থে পাশে ছিল। সেটা যদি মনে রাখেন, তবে আপনাদের জন্য, দেশের জন্য সেটিই হবে শুভকর।
দুদু বলেন, দেশে নানামুখী ষড়যন্ত্র চলছে। স্বৈরতন্ত্রের পতনের পর গণতন্ত্রের যে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, গণতন্ত্রকে উত্তরণের জন্য যেটি প্রয়োজন সেটি হচ্ছে নির্বাচন। সেই নির্বাচন বিলম্বিত করার অর্থ হচ্ছে সময়কে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেওয়া। নির্বাচন বিলম্বিত হলে পার্শ্ববর্তী দেশ যাদের আশ্রয় দিয়েছে, সেই কুচক্রিমহল, ষড়যন্ত্রকারী, গণহত্যাকারী এবং লুটপাটকারীদের সময় দেওয়া। যাতে তারা বাংলাদেশে অস্থিতিশীল করতে পারে।
তিনি আরও বলেন, ৭১ সালে এ জাতি সরাসরি রণাঙ্গনে থেকে যুদ্ধ করেছে। ৭১ নিয়ে কোনো আপস নেই। বেগম খালেদা জিয়া, তারেক রহমান এবং স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমানের ব্যাপারেও কোনো আপস নেই। এগুলোর ব্যাপারে যতই উসকানি দেন না কেন আমরা সেটির প্রতিশোধ নেব আগামী নির্বাচনে। আমরা নির্বাচনের মধ্যদিয়ে প্রমাণ করব বাংলাদেশের জনগণ বিএনপির সঙ্গে আছে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু বলেছেন, আগামীতে তারেক রহমান যাতে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হতে না পারেন, সে জন্য ষড়যন্ত্র শুরু করেছে জামায়াতে ইসলামী। দলটি নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করছে। স্বাধীনতাবিরোধী এই রাজনৈতিক দল পিআর পদ্ধতির অজুহাতে নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্র করছে। তাদের এ চেষ্টা বাস্তবায়ন হবে না। দেশের মানুষ এখন নির্বাচনমুখী হয়ে গেছে।
বুলু বলেন, পিআর, টিআর বুঝি না। আগে যে পদ্ধতিতে নির্বাচন হয়েছে, সেই পদ্ধতিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। অন্যথায় এই দেশের মানুষ প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। ১৯৯৬ সালে জামায়াত আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করে দেশে ১৭৩ দিন হরতাল পালন করেছে। ১৯৯৬ সালে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে নির্বাচন করে, তারা মাত্র ৩টি সিট পেয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ১৯৪৭ সালে জামায়াত পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দেয় নাই। তারা তখন অবিভক্ত ভারতের পক্ষে ভোট দিয়েছে। জামায়াত কখনো দেশের পক্ষে থাকে না, তারা সব সময় দেশের বিপক্ষে কাজ করে। আগামী নির্বাচন নিয়েও তারা ষড়যন্ত্রের অংশ হিসাবে পিআর পদ্ধতিকে সামনে নিয়ে এসেছে।
ভোরের আকাশ/এসএইচ