নিখিল মানকিন
প্রকাশ : ২৩ জুলাই ২০২৫ ০৮:৪৩ এএম
সংগৃহীত ছবি
রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় দগ্ধ আব্দুল্লাহ ছামীমের (১৩) মৃত্যু হয়েছে। ‘অনেক কষ্ট, আর কতক্ষণ লাগবে হাসপাতালে পৌঁছাতে। হাসপাতালটি এত দূরে কেন? শ্বাস নিতে পারছি না, আমাকে বিদেশ নিয়ে যাও।’
মৃত্যুর আগে দগ্ধ ছামীম মায়ের কাছে এমন আকুতি করেছিলেন। শিশু ছামীম এর মতো আরও অনেক শিশু আকুতি জানিয়েও বাঁচতে পারেনি। আর হাসপাতালের বেডে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে চিকিৎসাধীন দগ্ধ শিশুরা। মারা যাওয়ার আগে প্রত্যক্ষ করা দৃশ্যপট বলতে গিয়ে কেঁদে মুচড়ে যাচ্ছেন স্বজনেরা। আর চিকিৎসাধীন দগ্ধদের বাঁচানোর আশায় হাসপাতালে চোখের জল ফেলছেন অনেকে। সব মিলিয়ে বিমান বিধ্বস্তে হতাহতের ঘটনাকে কেন্দ্র করে আকাশে-বাতাসে মানবতার আর্তনাদ। বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে বিশেষ করে ফেসবুকেও দগ্ধ শিশুদের জন্য দোয়া প্রার্থনা করে যাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। তাদের অনেকের লেখায় ফুটে উঠেছে আহাজারি।
গতকাল মঙ্গলবার ভোর ৬টায় অ্যাম্বুলেন্সে দেশের বাড়ি শরীয়তপুরে নেওয়া হয় ছামীমের মরদেহ। পরে সকাল ৯টায় জানাজা শেষে বাবার কবরের পাশেই দাফন করা হয় তাকে।
এর আগে সোমবার রাত ১১টার দিকে জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় সে।
আব্দুল্লাহ ছামীম ঢাকার উত্তরা এলাকার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। ছামীমের গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার ডিএমখালী ইউনিয়নের মাঝিকান্দি গ্রামে। প্রবাসী বাবা আবুল কালাম মাঝি সাত মাস আগেই মারা যান সৌদি আরবে। দুই ভাই, এক বোনের মধ্যে ছামীম ছিলেন সবার ছোট।
আগুনে ঝলসে যায় ছামীমের পুরো শরীর। তাৎক্ষণিকভাবে শিক্ষকরা তাকে উদ্ধার করে মায়ের ফোন নম্বর সংগ্রহ করেন। দ্রুত চলে আসেন তার মা জুলেখা বেগম। শ্বাস নিতে কষ্ট হলেও ছামীম হাসপাতালে নেওয়ার আকুতি জানায়। এমনকি বিদেশে চিকিৎসার কথাও বলে মাকে। পরে এসিবিহীন একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে নেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। চিকিৎসকরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করলেও রাত ১১টার দিকে মৃত্যু হয় ছামীমের।
ছামীমের মা জুলেখা বেগম বলেন, ‘স্কুল থেকে আমার নাম্বারে ফোন করার সঙ্গে সঙ্গেই আমি চলে যাই ঘটনাস্থলে। সেখান থেকে একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে যাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যে আমার ছেলে বলছিল এসি চালাতে; কিন্তু অ্যাম্বুলেন্সে এসি নেই, এতে আরও বেশি কষ্ট পাচ্ছিল ছেলেটি। ছেলে বারবার চিৎকার করে বলছিল, মা আর কতক্ষণ লাগবে হাসপাতালে পৌঁছাতে। হাসপাতালটি এত দূরে কেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার ছেলে আমাকে আকুতি করে বলছিল মা চিকিৎসার জন্য আমাকে বিদেশ নিয়ে যাও। পানি খেতে চেয়েছিল ছেলেটি চিকিৎসকের পরামর্শে পানিও পান করতে দিতে পারিনি তাকে। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত ১১টার দিকে মারা যায় আমার সন্তান।’
বাবা হারা দুই ভাই ও এক বোনকে নিয়ে রাজধানীর উত্তরা দিয়াবাড়ি খালপাড় এলাকায় থাকতেন মা জুলেখা বেগম।
মেয়েকে বাঁচাতে স্কুলে ছুটে যান মা, ফিরলেন লাশ হয়ে : রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় মেয়েকে বাঁচাতে ভেতরে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরলেন মা উম্মে হাবিবা রজনী। গতকাল মঙ্গলবার ভোরে রজনীর মরদেহ কুষ্টিয়ায় নেওয়া হয়। এরপর সকাল ৯টায় তার মরদেহ দৌলতপুর উপজেলার সাজিপুর গ্রামে শ্বশুরবাড়িতে দাফন করা হয় বলে জানান তার স্বামী জহুরুল ইসলাম।
এদিকে এই হৃদয়বিদারক ঘটনায় রজনীর পরিবার, আত্মীয়-স্বজন ও গ্রামবাসীর মাঝে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। মেয়েকে বাঁচাতে গিয়ে মায়ের এভাবে অকালে চলে যাওয়া সবাইকে আবেগাপ্লুত করে তুলেছে।
জানা গেছে, সোমবার দুপুরে রাজধানীর উত্তরা এলাকায় মাইলস্টোন কলেজের ওপর একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়। এতে কলেজে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। আগুন লাগার পর মুহূর্তেই শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ওই সময় রজনী মাইলস্টোন কলেজে অবস্থান করছিলেন। শিশু কন্যা অন্যদের সহায়তায় বাইরে বেরিয়ে এসেছিল। কিন্তু রজনী মেয়েকে না পেয়ে ভেতরে গিয়ে আগুনের লেলিহান শিখায় দগ্ধ হন। পরে তাকে গুরুতর অবস্থায় উদ্ধার করে ঢাকা সিএমএস হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে রাতেই বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। রজনী গাংনী উপজেলার মটমুড়া ইউনিয়নের বাওট গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল হামিদের মেয়ে। তিনি স্বামী জহিরুল ইসলামের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে ঢাকায় বসবাস করছিলেন। জহিরুলের গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার চর সাদিপুরে। তাদের একমাত্র মেয়ে ১২ বছর বয়সী ঝুমঝুম খাতুন মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী।
এখনো নিখোঁজ তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী মরিয়ম : বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় রাজধানীর মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী আফিয়া উম্মে মরিয়ম নিখোঁজ। সে প্রতিষ্ঠানটির তৃতীয় শ্রেণির ‘আকাশ বিভাগের’ ছাত্রী। দুর্ঘটনার পর থেকেই সে নিখোঁজ বলে জানিয়েছেন আফিয়ার বড় ভাইয়ের বন্ধু আলভী। আফিয়ার খোঁজ নিতে গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে এসেছিলেন টঙ্গি নিবাসী আলভী। এখানেও আফিয়ার খোঁজ পাওয়া যায়নি বলে তিনি জানান।
আলভী বলেন, ‘বিমান দুর্ঘটনার পর থেকে নিখোঁজ আফিয়া। তার পরিবার তাকে খুঁজতে উত্তরাসহ সব হাসপাতালে গেলেও আফিয়াকে পায়নি। কোনো হাসপাতালের ভর্তির তালিকায় সে নেই।’
তিনি বলেন, ‘যেহেতু কোনো হাসপাতালে তাকে পাওয়া যায়নি, সেহেতু তার পরিবারের ধারণা- আফিয়া এখনো ধ্বংসাবশেষের মধ্যে আছে। তার পরিবার এখনো আশা ছাড়েনি।’
আলভী আরও বলেন, ‘ইতোমধ্যে আফিয়ার খোঁজ চেয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট দেওয়া হয়েছে।’ কেউ তার খোঁজ জানলে তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করার অনুরোধ জানান তিনি।
৭০ শতাংশ পোড়া শরীর, জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে মাহতাব : রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ি এলাকায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় মাহতাব রহমান (১৫) নামের এক শিক্ষার্থী গুরুতর দগ্ধ হয়েছে। ওই স্কুলের ইংলিশ ভার্সনের সপ্তম শ্রেণিতে পড়তো। এ শিক্ষার্থীর শরীরের প্রায় ৭০ শতাংশ পুড়ে গেছে। বর্তমানে ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন মাহতাব।
ঢামেক হাসপাতালের আইসিইউতে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন মাইলস্টোনের এ শিক্ষার্থী। চিকিৎসকরা বলছেন, তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। একমাত্র ছেলের জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছেন মাহতাবের বাবা মিনহাজুর রহমান ভূঁইয়া।
দগ্ধ মাহতাব কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার চুলাশ ভূঁইয়া বাড়ির মিনহাজুর রহমানের একমাত্র ছেলে। তারা ঢাকার উত্তরায় একটি বাসায় থাকেন। মাইলস্টোন স্কুলে তার শিক্ষার্থী কোড নম্বর ১০১৪। মিনহাজুর রহমান কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘ছেলেকে বার্ন ইউনিটে আইসিইউতে ভর্তি রাখা হয়েছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছে মাহতাবের শরীরের ৭০ শতাংশ পুড়ে গেছে। আল্লাহ যেন আমার একমাত্র ছেলেকে সুস্থ করে আমাদের মাঝে ফিরিয়ে দেন সে জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই।’
একমাত্র সন্তান উক্য চিং’কে হারিয়ে পাগলপ্রায় বাবা-মা : রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ক্যাম্পাসে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় আহত শিক্ষার্থী উক্য চিং মারমা মারা গেছে। গত সোমবার রাত ২টার দিকে ঢাকার জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থেকে তার মৃত্যু হয়। এ দিকে একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে পাগলপ্রায় বাবা-মাসহ পুরো পরিবার। উক্য চিং মারমা ওই স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। সে রাঙ্গামাটি জেলার রাজস্থলী উপজেলার বাঙ্গালহালিয়া কলেজপাড়া এলাকার বাসিন্দা। উক্য চিং বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন উক্য চিং মারমা এর মাসি (খালা) নেলী মারমা।
তিনি জানান, দুর্ঘটনার সময় উক্য চিং স্কুল ভবনের শ্রেণিকক্ষে ছিল। বিমান বিধ্বস্ত হয়ে বিস্ফোরণের পর ভবনে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। উক্য চিং মারমার শরীরের প্রায় শতভাগ দগ্ধ হয়। এরপর তাকে উদ্ধার করে বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। মেধাবী এই শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষা অর্জনের জন্য রাঙ্গামাটি প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে ঢাকায় গিয়ে লাশ হয়ে ফিরছে। তার বাবা উসাইমং মারমা রাজস্থলী উপজেলা আবাসিক উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত। এক মাত্র সন্তানকে হারিয়ে পাগলপ্রায় পুরো পরিবার।
আমার বন্ধু আমার চোখের সামনে মারা গেল : ফারহান পরীক্ষা শেষে করে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি শ্রেণিকক্ষ থেকে বের হচ্ছিল শিক্ষার্থী ফারহান হাসান (১০)। ঠিক তখনই ক্যাম্পাসে বিধ্বস্ত হয় বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ জেট। ফারহান বলে, ‘আগুনে জ্বলতে থাকা বিমানটি আমার চোখের সামনেই ভবনে আঁছড়ে পড়ে।’
বাবা ও চাচার পাশে দাঁড়িয়ে ফারহান বলে, ‘আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুও পরীক্ষার হলে ছিল। সে আমার চোখের সামনেই মারা গেল।’
ভোরের আকাশ/এসএইচ