নিখিল মানখিন
প্রকাশ : ২০ আগস্ট ২০২৫ ০১:৩০ এএম
ছবি: সংগৃহীত
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে বিদেশি কূটনীতিকদের আনাগোনা ও আলাপচারিতা বেড়েছে। প্রতিদিনই বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে আলোচনা করছেন। আলোচনার নানা ইস্যুর মধ্যে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের বিষয়টি নানা কৌশলে অন্তর্ভুক্ত থাকছে। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিতকল্পে আর্থিক সহযোগিতার প্রতিশ্রুতিও দিয়ে যাচ্ছেন বিদেশি প্রতিনিধিরা। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনের আগেও বিদেশি কূটনীতিক ও প্রতিনিধিদলের সদস্যদের আগমনে মুখরিত হয়েছিল বাংলাদেশ। সেই সময় আগত বিদেশি কূটনীতিকদের বিরুদ্ধে অহেতুক হস্তক্ষেপের অভিযোগও উঠেছিল। এবারও নির্বাচনকেন্ত্রিক একই দৃশ্যপট সৃষ্টি হচ্ছে বলে মন্তব্য করছেন রাজনীতিবিদ ও কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা।
ভূ-রাজনীতিতে বিশ্ব মোড়লদের কাছে বাংলাদেশের বিশেষ গুরুত্ব এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের গ্রহণযোগ্যতার কারণেই এমনটি হচ্ছে বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষক মহল। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক কূটনৈতিক তৎপরতা রাজনৈতিক মহলে বিশেষ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বিষয়গুলো নিয়ে বেশ সরব। সরকারও আমলে নিচ্ছে। এমন কূটনৈতিক তৎপরতা সামনে জটিল কোনো রাজনৈতিক সংকটের আভাস দিচ্ছে কি না সেদিকে চোখ সবার। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিনের সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেয় ছয় সদস্যের একটি ইইউ প্রতিনিধি দল। বৈঠকে সরাসরি আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়।
বৈঠক শেষে বাংলাদেশে নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার সাংবাদিকদের বলেন,‘ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের সঙ্গে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে কাজ করছে যাতে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের আগে প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের সহায়তা নিশ্চিত করা যায়। আমরা ২০২৬ সালের প্রথম দিকে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতির দিকে এগোচ্ছি। এই প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করতে চার মিলিয়ন ইউরোর বেশি সহায়তা প্যাকেজ দিচ্ছি।’
তিনি আরও জানান, ‘ইইউ’র এই সহায়তা প্যাকেজের আওতায় নির্বাচন পরিচালনার সক্ষমতা বৃদ্ধি, নাগরিক পর্যবেক্ষণ জোরদারকরণ, অপারেশনাল পরিকল্পনা এবং বিরোধ নিষ্পত্তিসহ নানা ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা করা হবে।’
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বাণিজ্যমন্ত্রী ঢাকা সফরে আসছেন। দেশটির বাণিজ্যমন্ত্রী জাম কামাল খান আগামীকাল বৃহস্পতিবার এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার ২৩ আগস্ট দ্বিপক্ষীয় সফরে ঢাকা আসছেন। পাকিস্তানের মন্ত্রীদের সফরে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিষয়ে আলোচনা হবে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। শুধু সরকার নয়, দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও বিদেশি কূটনীতিকদের দৌড়ঝাঁপ বেড়েছে।
এমনকি লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গেও বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক এবং উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিরা বৈঠক করেছেন। এতে নির্বাচন নিয়ে বিএনপির অবস্থান, সরকার গঠন নিয়ে ভাবনা, জয় পেলে কীভাবে দেশ গড়তে চায়, দেশ ও জনগণ নিয়ে পরিকল্পনা, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনায় আগ্রহ দেখাচ্ছেন বিদেশিরা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
গত এক বছরে বাংলাদেশে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলের সিনিয়র নেতৃবৃন্দদের সঙ্গে আমেরিকা, ভারত, চীন, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান এবং সৌদি আরবসহ ১৫টি দেশের কূটনৈতিকরা বৈঠক করেছেন। পৃথক পৃথক এসব বৈঠকে জাতীয় নির্বাচন, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক, বিনিয়োগসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়।
এ ছাড়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গেও বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিকরা সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন। সর্বশেষ ২১ জুলাই বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন ঢাকায় নিযুক্ত ভুটানের রাষ্ট্রদূত দাশো খারমা হামু দর্জি। গুলশানে খালেদা জিয়ার বাসভবনে (ফিরোজা) এ সাক্ষাৎ অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় বিএনপি চেয়ারপারসনকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান রাষ্ট্রদূত।
ঘুরে ফিরে নির্বাচন ও ভূ-রাজনীতিই মূল কারণ : ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকার পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর ক্ষমতাসীন হয়েছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। আর এই সরকার সকল রাষ্ট্রের সঙ্গে শান্তি ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বিশ্ব মোড়লদের বিবাদ ও মতবিরোধে বিপাকে অন্তর্বর্তী সরকার। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের টানাপোড়েন রয়েই গেছে। এর বিপরিতে গত এক বছর ধরে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের ইতিবাচক উন্নতি ঘটেছে। পাকিস্তান প্রতিনিধি বা কূটনীতিকদের বাংলাদেশে ঘন ঘন আগমন ঘটছে। এমন সংবাদে নড়েচড়ে বসছে ভারত। নানা ইস্যূ তৈরি করে কূটনীতিক পাঠিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি ঘটানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে তারাও।
এদিকে, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মতবিরোধ প্রায় ৭৬ বছরের পুরনো। ভূ-রাজনীতি ও অর্থনীতিকেন্দ্রিক বিশ্বে বড় দু’টি ব্লক তৈরি করে রেখেছে পরাক্রমশালী এই দু’টি দেশ। বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের উন্নয়নের বন্ধু চীন। বিশ্ব মোড়ল যুক্তরাষ্ট্রকেও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই দেশটির।
গত বছর ৮ আগস্টের পর থেকেই অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে জোরালো যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে চীন। চলতি বছর মার্চে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের চীন সফর ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তারই অংশ হিসেবে তিন দিনের সফরে যুক্তরাষ্ট্রের দুই উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকায় এসেছিলেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র- এই দু’টি রাষ্ট্রের অঘোষিত ব্লকের অন্তর্ভুক্ত এক দেশের প্রতিনিধিদের আগমন ঘটলে অন্য ব্লকের দেশের প্রতিনিধিরাও বাংলাদেশে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন। তাছাড়া সকল দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার কারণে বাংলাদেশে বিদেশি কূটনীতিকদের ঘন ঘন আগমন ঘটছে।
গত আগস্টে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত উচ্চপর্যায়ের ৩৫টিরও বেশি বিদেশি কূটনৈতিক প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করেছে। গত ৪ অক্টোবর মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম ঢাকা সফর করেন। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এটিই ছিল কোনো বিদেশি সরকারপ্রধানের প্রথম ঢাকা সফর। তিনি দুই দেশের সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার বার্তার পাশাপাশি দেশের সংস্কার প্রক্রিয়ার ওপরও গুরুত্ব দেন। একই মাসে অস্ট্রেলিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী টনি বার্গের নেতৃত্বে আসা একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল নির্বাচন ও সংস্কার ইস্যুতে গুরুত্ব দেয়।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্ট সদস্য রূপা হক এবং জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বাংলাদেশ সফরে এসে নির্বাচন ও সংস্কার প্রসঙ্গে কথা বলে গেছেন। একই সময়ে ঢাকায় এসেছিলেন মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি নিকোল অ্যান চুলিক ও তার সফরসঙ্গীরা। তাদের সফরের মূল এজেন্ডা নির্বাচন ও সংস্কার প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশকে সহায়তা দেওয়ার উপায় নিয়ে আলোচনা করা। প্রতিনিধি দলটি এরই মধ্যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করেছে। তারপরই এসেছিলেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব আমনা বেলুচের নেতৃত্বে আসা একটি প্রতিনিধিদল।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আলোচনা যত এগোবে, বিদেশি কূটনৈতিক তৎপরতাও তত বাড়বে। নির্বাচন কীভাবে হবে, কারা অংশ নেবে কিংবা নির্বাচনের পরে কী হবে- এসব নিয়ে ধারণা নিতে বিদেশি কূটনীতিকদের দৌড়ঝাপ চলছে। তাই সব পক্ষের সঙ্গেই বসছেন বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা। এর বাইরে বিদেশি মিশনের রাষ্ট্রদূত ও পলিটিক্যাল কাউন্সিলররা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নিয়মিত আলোচনায় বসছেন, যেখানে নির্বাচনের রোডম্যাপ, সংস্কার এবং ক্ষমতায় এলে তাদের দেশ পরিচালনার রূপরেখা কেমন হবে-তা নিয়ে কথা হচ্ছে। পাশাপাশি নিজেদের মধ্যে নানা ইস্যুতে আলোচনা করছেন বিদেশি মিশনের কূটনীতিকরা।
কূটনৈতিক সূত্র জানায়, সম্প্রতি বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি, এবি পার্টিসহ বেশ কয়েকটি ইসলামপন্থি দলের সঙ্গে বৈঠক করেন জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইস ও তার কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ মানবাধিকার উপদেষ্টা হুমা খান।
এসব বৈঠকের বিষয়ে নানা আলোচনা সমালোচনার বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে হুমা খান বলেন, ‘কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নয়, আমরা মূলত মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখি। কারণ, কোনো ব্যক্তি রাজনৈতিক দলের সদস্য হলেই তার ভুক্তভোগিতা অস্বীকার করা যায় না। আমরা সেই ভুক্তভোগিতার পাশে আছি এবং থাকবো।’
অতীতে কূটনীতিকদের তৎপরতা ও নির্বাচন
বিদ্যমান পরিস্থিতির সঙ্গে অনেকেই ২০০৬-০৭ সালের রাজনৈতিক সংকটের মিল খুঁজে পাচ্ছেন, যা সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার অনিবার্য করে তোলে। তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্যাট্রেসিয়া বিউটেনিস, ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী এবং ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি রেনাটা লক ডেসালিয়ান ছিলেন সে সময়কার আলোচিত নাম। রাজনীতিতে তাদের হস্তক্ষেপ নিয়ে জল্পনা-কল্পনা সত্য প্রমাণিত হয় উইকিলিকসে ফাঁস হওয়া মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্যাট্রিসিয়া বিউটেনিসের তারবার্তা থেকে।
তার বার্তায় জানা যায়, সে সময় ঢাকায় নিযুক্ত পশ্চিমা কূটনীতিকরা ‘কফি গ্রুপ’ নামে একটি বৈঠক বসাতেন। সেখানে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, জাতিসংঘের প্রতিনিধি এবং আমন্ত্রণপত্রপ্রাপ্ত জাপান অংশ নিতো। এ সময় তারা বাংলাদেশের রাজনীতি ‘পর্যালোচনা’ করতেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও কূটনৈতিক বিশ্লেষক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘বরাবরের মতো এবারও বিদেশি কূটনীতিকদের তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তারা কলোনিয়ান মনোভাব থেকেই আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করেন। অথচ এটা তাদের দায়িত্ব নয়। আর আমাদের রাজনৈতিক নেতারাও নিজেদের স্বার্থে সেটা গ্রহণ করেন।’
ভোরের আকাশ/এসএইচ