ভোরের আকাশ প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২০ আগস্ট ২০২৫ ০৬:৩৪ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
দেশে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে অসংক্রামক রোগ। ঘনবসতি, ভৌগোলিক অবস্থান এবং বৃহৎ জনসংখ্যার কারণে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে। ব্যয়বহুল হওয়ায় এসব রোগে আক্রান্তদের অনেকেই চিকিৎসাবিহীন অবস্থায় অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন। আবার চূড়ান্ত পর্যায়ে রোগশনাক্ত হওয়ায় সর্বোচ্চ চিকিৎসা দিয়েও রোগীকে বাঁচানো যাচ্ছে না। বাংলাদেশে মোট মৃত্যুর ৭১ শতাংশ অসংক্রামক রোগের কারণে ঘটে এবং এর মধ্যে ৫১ শতাংশ মানুষের মৃত্যু ৭০ বছরের নিচে, যা অকাল মৃত্যু হিসেবে গণ্য করা হয় বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সবশেষ প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে। এমন পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আন্তঃমন্ত্রণালয় সহযোগিতা বৃদ্ধিতে ৩৫টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ ‘যৌথ ঘোষণায়’ স্বাক্ষর করেছে।
বুধবার (২০ আগস্ট) প্রধান উপদেষ্টার উপস্থিতিতে তার কার্যালয়ে এই চুক্তি সই করা হয়। মন্ত্রণালয়গুলো যেসব প্রতিশ্রুতিতে সই করেছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে-নীতি প্রণয়নে অগ্রাধিকার। সব নীতিতে স্বাস্থ্যকে প্রাধান্য দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে প্রত্যেক মন্ত্রণালয় বা বিভাগ কর্মকৌশল ও নীতিমালা প্রণয়ন এবং নির্ধারণে অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে অগ্রাধিকার এবং প্রয়োজনবোধে বিদ্যমান নীতিগুলোর সংশোধন।
কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন: জাতীয় অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে বহুখাতভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ করা সাশ্রয়ী কার্যপন্থা বাস্তবায়নের জন্য যথাযথ মানব ও আর্থিক সম্পদের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা এবং অধস্তন দপ্তর/সংস্থার মাধ্যমে মাঠপর্যায়সহ সব স্তরে পরিকল্পিত কার্যক্রম তদারকি, পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করা।
জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও সর্বজনীন অংশগ্রহণ: অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি ও প্রাসঙ্গিক কার্যক্রম সর্বাত্মক সরকারি এবং সর্বাত্মক সামাজিক উদ্যোগ গ্রহণ করা যেন সব শ্রেণি-পেশার মানুষের সক্রিয় ও অর্থবহ অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়।
সমন্বয় ও সহযোগিতা: প্রত্যেক মন্ত্রণালয়/বিভাগ জাতীয় অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের বহুখাতভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা সমন্বিত ও কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন এবং সমন্বয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা।
অগ্রগতি পর্যালোচনা: প্রত্যেক মন্ত্রণালয়/বিভাগ ‘যৌথ ঘোষণা’র অগ্রগতি নিয়মিতভাবে পর্যালোচনা ও পর্যবেক্ষণ করা এবং উল্লেখযোগ্য সফলতা সংবলিত প্রতিবেদন প্রকাশ করা, শনাক্তকৃত চ্যালেঞ্জ ও সীমাবদ্ধতা মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
স্বাক্ষরকারী মন্ত্রণালয়/বিভাগগুলো: জননিরাপত্তা বিভাগ, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, ভূমি মন্ত্রণালয়, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবরা সাক্ষর করেন। এর বাইরে কৃষি মন্ত্রণালয়, অর্থ বিভাগ, সচিব, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ, অর্থবিভাগ, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ, রেলপথ মন্ত্রণালয়, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা বিভাগ, ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ, আইন ও বিচার বিভাগ, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ, সমন্বয় ও সংস্কার, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণাল, কারিগরী ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগ, লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগের সচিবরা সই করেন। এছাড়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানও সই করেন।
বুধবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, অসংক্রামক রোগ হলে মানুষ উচ্চ চিকিৎসা ব্যয়ের মুখোমুখি হয়। ক্যান্সার বা অন্যান্য গুরুতর রোগের ক্ষেত্রে পরিবারকে সর্বোচ্চ অর্থনৈতিক শক্তি প্রয়োগ করতে হয় এবং অনেক সময় বিদেশ থেকে চিকিৎসা নিতে হয়, যা দেশের অর্থ সম্পদও ক্ষয় করে।
প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে উপযুক্ত জনসচেতনতা এবং কার্যকর ব্যবস্থাপনা দরকার। এককভাবে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ এ কার্য সম্পাদন করতে পারবে না। এজন্য খাদ্য, কৃষি, শিক্ষা, ক্রীড়া, স্থানীয় সরকার, গণপূর্তসহ প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা প্রয়োজন। প্রতিটি খাত থেকে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা ও নিবিড় উদ্যোগ নিশ্চিত করতে হবে। তিনি ‘যৌথ ঘোষণাপত্র’ বাস্তবায়নে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও বিশেষ গুরুত্বারোপ করেন।
এদিকে, সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরীন বলেন, সারাবিশ্বে প্রধান অসংক্রামক রোগগুলোর মধ্যে রয়েছে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, দীর্ঘমেয়াদি শ্বাসতন্ত্রের রোগ, ক্যান্সার এবং মানসিক সমস্যা। বিশ্বের ৮০ শতাংশ অকাল মৃত্যু ঘটে এই রোগগুলোর কারণে। প্রাক্কলিত হিসাব অনুযায়ী প্রতি বছর প্রায় ৪ কোটি লোক অসংক্রামক রোগের কারণে মারা যায় যা বিশ্বের মোট মৃত্যুর ৭১ শতাংশ। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অসংক্রামক রোগজনিত মৃত্যুর হার বাড়ে।
প্রতিবছর ৩০-৬৯ বছর বয়সী দেড় কোটি লোক অসংক্রামক রোগে মারা যাচ্ছে; এই অকালমৃত্যুর ৮৫ শতাংশ ঘটে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে। এশিয়ার মোট মৃত্যুর প্রায় অর্ধেকের কারণ অসংক্রামক রোগ। ৮০ শতাংশের বেশি হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসজনিত মৃত্যু, ৯০ শতাংশ দীর্ঘমেয়াদি শ্বাসরোগে মৃত্যু এবং দুই-তৃতীয়াংশ ক্যান্সারজনিত মৃত্যু ঘটে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। বিশ্বের অন্য যেকোনো অঞ্চলের তুলনায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অসংক্রামক রোগ বৃদ্ধির হার সবচেয়ে দ্রুত।
রোগ ও প্রতিবন্ধকতার কারণে বাংলাদেশে কর্মক্ষমতা হ্রাসের হিসেবে অসংক্রামক রোগ ৬১ শতাংশ দায়ী। ২০১০ সালে পরিচালিত অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি সংক্রান্ত একটি জরিপে দেখা যায় ৯৯ শতাংশ মানুষের অন্তত একটি এবং প্রায় ২৯ শতাংশ মানুষের তিনটিরও বেশি অসংক্রামক রোগের কারণ রয়েছে। ২০৫০ সালে বাংলাদেশে ষাটোর্ধ্ব লোকের সংখ্যা হবে মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ (২১.৮ কোটি) যারা নির্ভরশীল জনসংখ্যা এবং অসংক্রামক রোগের বোঝা বাড়াবে। বাংলাদেশের পাঁচটি মূল অসংক্রামক রোগের অবস্থা সম্পর্কে পরিচালক বলেন, রক্তসংবহনতন্ত্রের (সিভিডি) রোগ, ডায়াবেটিস, দীর্ঘমেয়াদি শ্বাসতন্ত্রের রোগ, ক্যান্সার ও মানসিক সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে।
অসংক্রামক রোগের কারণসমূহ: আইইডিসিআর’র পরিচালক বলেন, চারটি বিপাকজনিত ঝুঁকিকে অসংক্রামক রোগ বৃদ্ধির মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এগুলো হলো উচ্চ রক্তচাপ, ওজনাধিক্য বা স্থূলতা, রক্তে অতিরিক্ত চিনি এবং অতিরিক্ত চর্বির উপস্থিতি। অনেকগুলো কারণ আচরণগত ও পরিবর্তনযোগ্য, যেমন, তামাকের ব্যবহার, কায়িক পরিশ্রমের অভাব, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, মদ্যপান ইত্যাদি।
বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ
অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরীন বলেন, অসংক্রামক রোগের ঝুঁকিসমূহ কমাতে হলে এটিকে সামগ্রিকভাবে মোকাবিলা করতে হবে, যার মধ্যে স্বাস্থ্য ছাড়াও অর্থ, যোগাযোগ, শিক্ষা, কৃষি, পরিকল্পনা ও অন্যান্য খাতকেও সম্পৃক্ত করতে হবে। ব্যবস্থাপনার আওতায় রোগ নির্ণয়, স্ক্রিনিং, চিকিৎসা এবং উপশমক যত্নকে নিয়ে আসতে হবে।
প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয় ও সময়োপযোগী চিকিৎসা- অসংক্রামক রোগ কমাবার অন্যতম উপায় হতে পারে এবং সেটা প্রাইমারি হেলথ কেয়ার এর মাধ্যমেই সম্ভব। আমাদের লক্ষ্য হবে ২০২৫ সালের মধ্যে অসংক্রামক রোগের কারণে অকাল মৃত্যুহার ২৫ শতাংশ কমিয়ে আনা এবং ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা অর্জন করা যেখানে বলা হয়েছে অকাল মৃত্যুহার এক-তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনতে হবে। বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে আসার জন্য এখন যেটি প্রয়োজন, সেটি হচ্ছে, বর্তমান স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা এবং যে সকল দুর্বলতা আছে সেগুলো সমাধানের জন্য কৌশল নির্ধারণ করা।
ভোরের আকাশ/এসএইচ