ইসির রোডম্যাপ
নিখিল মানখিন
প্রকাশ : ২৮ আগস্ট ২০২৫ ১২:২৩ এএম
ছবি: সংগৃহীত
গত এক বছর ধরে নির্বাচনী রোডম্যাপ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর সম্পর্কে ভাটা পড়ে। দেখা দেয় পারস্পরিক আস্থার সংকট। রোডম্যাপ ঘোষণার দাবিতে বিএনপিসহ অনেক রাজনৈতিক দল কঠোর আন্দোলনে নামার হুমকি পর্যন্ত দিয়েছিল। সরকারের পক্ষ থেকে ‘নির্বাচনী মাস’ ঘোষণার পর আস্থা ফিরে পায় রাজনৈতিক দলগুলো। কমে আসে রোডম্যাপকেন্দ্রিক অস্থিরতার মাত্রা। তারপর শুরু হয় চূড়ান্ত রোডম্যাপের জন্য অপেক্ষার পালা। আজ সেই অপেক্ষার সমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর বিশেষ করে বিএনপির অন্যতম মূল দাবি ‘নির্বাচনী রোডম্যাপ’ ঘোষণা হতে পারে আজ। এমন ইঙ্গিত দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চূড়ান্ত রোডম্যাপ আজ বৃহস্পতিবার প্রকাশ করতে পারে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। গতকাল বুধবার বিকালে নির্বাচন ভবনের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান ইসি সচিব আখতার আহমেদ।
সাংবাদিকদের তিনি বলেন, আমরা যে কর্ম পরিকল্পনাটা করেছি, সেটার জন্য বৃহস্পতিবার পর্যন্ত অপেক্ষা করুন।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ কবে ঘোষণা করবেন সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে ইসি সচিব বলেন, আমাদের এটার (রোডম্যাপ) জন্য অনেক কিছু অপেক্ষা করছে; এটা আমরা বুঝি। আপনারা আগামীকাল (বৃহস্পতিবার) পর্যন্ত অপেক্ষা করুন।
এর আগে নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাউসদ বলেন, কমিশন রোডম্যাপ অনুমোদন দিয়েছে। দু-একদিনের মধ্যে তা প্রকাশ করা হবে।
ঘটনাবহুল রোডম্যাপ ঘোষণা : রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে বাকযুদ্ধসহ একের পর এক প্রতিশ্রুতি ও মন্তব্য প্রদানের ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। গণ অভ্যুত্থানের পর থেকে এখন পর্যন্ত দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে একমাত্র রাজনৈতিক দল হিসেবে অটল রয়েছে বিএনপি। তাদের সঙ্গে একই সুরে কথা বলছে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচনের সম্ভাব্য মাস হিসেবে ডিসেম্বরকে উল্লেখ করে সেনা প্রধানের দেয়া মন্তব্যও বিএনপিকে কিছুটা সমর্থন যুগিয়েছে।
নির্বাচনের সম্ভাব্য রোডম্যাপ নিয়ে খোদ অন্তর্বর্তী সরকারের ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্যে বেড়েছে সংশয়। ছোট পরিসরে হলে নির্বাচন চলতি বছরের ডিসেম্বরে, বৃহত্তর সংস্কার হলে ২০২৬ সালের জুনে নির্বাচন এমন বক্তব্য দিয়ে বেশ কয়েক মাস পার করেছেন প্রধান উপদেষ্ট ড. ইউনূস। ফলে আগামী জাতীয় নির্বাচনসহ বেশ কিছু ইস্যুতে বিএনপি ও সরকারের টানাপোড়েন চলছিল। এমন সময়ে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসের সাথে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আর বৈঠকেই জাতীয় নির্বাচনের সম্ভাব্য মাস হিসেবে ‘ফেব্রুয়ারি’এর কথা প্রকাশ পায়।
দেশ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত : প্রধান উপদেষ্টা গত ২৫ আগস্ট কক্সবাজারে রোহিঙ্গা অংশীজন সংলাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, বাংলাদেশ রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত। সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে এক বছর আগে ঘটে যাওয়া হত্যাযজ্ঞ এবং ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর বর্তমানে দেশ যথেষ্ট স্থিতিশীল এবং নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত।
প্রধান উপদেষ্টা জানান, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন ঘোষণা করা হয়েছে এবং এই নির্বাচনের মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে।
লন্ডন বৈঠক : গত ১৩ জুলাই লন্ডনের স্থানীয় সময় সকাল নয়টায় (বাংলাদেশ সময় বেলা দুইটা) লন্ডনের পার্ক লেনের হোটেল ডোরচেস্টারে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পূর্ব নির্ধারিত এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
বৈঠক শেষে এক যৌথ বিবৃতিতে জানানো হয়, ২০২৬ সালের রমজানের আগেই বাংলাদেশে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। এ ক্ষেত্রে অবশ্য ওই সময়ের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি অর্জন করা প্রয়োজন বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
নির্বাচন কমিশনকে সরকারের চিঠি প্রেরণ : আগামী ফেব্রুয়ারিতে রোজা শুরুর আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের জন্য সব প্রস্তুতি শেষ করতে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়। এ চিঠির মাধ্যমে নির্বাচন আয়োজনের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনকে অনুরোধের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলো। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং এ তথ্য জানিয়েছে।
গত ৬ আগস্ট নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব বরাবর পাঠানো ওই চিঠিতে উল্লিখিত সময়ে প্রত্যাশিত মানের অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের জন্য অনুরোধ করেন প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব এম সিরাজ উদ্দিন মিয়া।
ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের প্রস্তুতি শেষ করার নির্দেশ : গত ১০ জুলাই রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীসহ আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে এক বৈঠকে নির্বাচনের জন্য বিভিন্ন রকমের প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
বৈঠক শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে ওই বৈঠকের আলোচনা ও নির্দেশনার বিষয় তুলে ধরেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ও উপ–প্রেস সচিব মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ মজুমদার।
শফিকুল আলম বলেন, নির্বাচন ঘিরে আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক যত প্রস্তুতি, তা ডিসেম্বরের মধ্যে নিতে বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে (পুলিশ, বিজিবি, কোস্টগার্ড) ১৭ হাজার নতুন সদস্য নেওয়া হচ্ছে। তাদের নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ যেন এ সময়ের মধ্যে শেষ হয়, সে বিষয়েও প্রধান উপদেষ্টা নির্দেশ দিয়েছেন।
সরকারের নির্বাচনী প্রস্তুতি : নির্বাচনী মাস ঘোষণার পর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সভা অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি দিকনির্দেশনা দেন প্রধান উপদেষ্টা।
সভা শেষে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানায়, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্যে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের কাজ শুরু হয়েছে। সমন্বয় করা হচ্ছে সেনাবাহিনী, পুলিশ এবং সিভিল প্রশাসনের মধ্যে।
আগামী সেপ্টেম্বর থেকে দেড় লাখ পুলিশ সদস্যকে দেওয়া হবে নির্বাচন বিষয়ক বিশেষ প্রশিক্ষণ। প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলবে অক্টোবর ও নভেম্বর পর্যন্ত। এ ছাড়া নির্বাচন সামনে রেখে গ্রাউন্ড লেভেলের পরিস্থিতি জানতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে সিচুয়েশন রিপোর্ট পাঠানোরও নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন : সিইসি আগামী বছর ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দীন। গত ৯ আগস্ট বিকেলে রংপুরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বৈঠক শেষে তিনি এ তথ্য জানান।
এর আগে সকালে রংপুরে সংবাদ সম্মেলনে সিইসি বলেছিলেন, বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো, আরও উন্নতির দিকে যাচ্ছে। আমরা চাই যাতে শান্তিপূর্ণ ও নির্ভয়ে মানুষ পছন্দের প্রার্থীদের ভোট দিতে পারেন। মানুষ ভোটকেন্দ্রে যাওয়া ভুলে গেছে। তাদের ভোটকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়াই নির্বাচন কমিশনের চ্যালেঞ্জ। এজন্য সচেতনতার প্রয়োজন রয়েছে। আর এই সচেতনতা তৈরিতে সাংবাদিকদের ভূমিকা রয়েছে। আমরা সাংবাদিকদের কাছে সহযোগিতা চাই, পরামর্শ চাই।
আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে রোজার আগে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের জন্য ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে তফসিল ঘোষণা করবে নির্বাচন কমিশন। এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার চিঠি পাওয়ার পর নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ গত বৃহস্পতিবার তফসিলের সম্ভাব্য সময় সাংবাদিকদের জানান।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার এএমএম নাসির উদ্দিনের সভাপতিত্বে এদিন নবম কমিশন সভা হয়। পরে নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন নির্বাচন কমিশনার সানাউল্লাহ।
তিনি বলেন, ফেব্রুয়ারিতে ভোট করতে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে পাঠানো চিঠি নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে পৌঁছেছে। তবে কমিশন সভায় সেই চিঠি নিয়ে আলোচনা হয়নি। আমরা অতি শিগগির আলোচনা করব। আর মাননীয় প্রধান নির্বাচন কমিশনার আপনাদেরকে যেটা বলেছেন, আমাদের পক্ষ থেকে ঘোষণাটা আসবে দুই মাস আগে। আপনারা ধরেই নিতে পারেন, এই শিডিউল ঘোষণার কাজটা আমাদের ডিসেম্বর মাসের প্রথমার্ধে (করব)।
নির্বাচনমুখি রাজনৈতিক দলগুলো : দেশজুড়ে এখন প্রধান আলোচনার বিষয় নির্বাচন। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথামার্ধেই হতে যাচ্ছে-এমন খবরে জনমনে এক ধরনের স্বস্তি দেশের সর্বত্র। সম্ভাব্য প্রার্থীরা নিজ নিজ এলাকায় জনসংযোগ বাড়িয়েছেন। শোভাযাত্রাও হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও তৎপর অনেকে। কয়েকটি দলের শীর্ষ নেতারা কেন্দ্রীয় পর্যায়ে ভিন্ন কথা বললেও তাদের স্থানীয় নেতারা নির্বাচনী প্রচারে পিছিয়ে নেই। দল থেকে, বিশেষ করে বিএনপি থেকে কারা প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পাবেন তা নিয়েও কৌতূহলের অন্ত নেই। ছোট দলগুলো বড় কোনো দলের সঙ্গে জোট গঠনের অপেক্ষায়। অনানুষ্ঠানিকভাবে নানা কৌশলে প্রার্থী নির্বাচনসহ নির্বাচনী প্রচারণা অব্যাহত রেখেছে দলগুলো।
ভোরের আকাশ/এসএইচ