ভোরের আকাশ ডেস্ক
প্রকাশ : ০৯ অক্টোবর ২০২৫ ১১:০২ এএম
ছবি : সংগৃহীত
আফ্রিকা মহাদেশের ছোট্ট একটি দেশ ইসোয়াতিনি (পূর্বতন সোয়াজিল্যান্ড)। এই ক্ষুদ্র দেশটির বর্তমান নৃপতি তৃতীয় এমসোয়াতি। দেশটি আড়ে-বহরে ছোট হলেও রাজার পরিবার একেবারেই ছোট নয়।
আফ্রিকার এই ছোট দেশটির নাগরিকদের জীবনযাত্রার মান খুবই সাদামাঠা। অর্থনৈতিক ভাবেও দেশটির বেহাল দশা। এত কিছু হলে কী হবে, দেশের রাজা কাটান বিলাসী জীবন। ঠাঁটবাটও নেহাত কম নয়।
রাজার মোট ৩০ জন স্ত্রী, সব মিলিয়ে ৩০-৩৫ জন সন্তান। গৃহকর্ম সহায়কের সংখ্যা গুনে গুনে একশো। পুরো পরিবার ও পরিচারকদের নিয়ে আবু ধাবিতে এসেছিলেন আফ্রিকার অবশিষ্ট নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্রের সদস্য এমসোয়াতি। চলতি বছরের ১০ জুলাই ব্যক্তিগত বিমানে করে রাজা ও রাজপরিবারের সদস্যেরা হাজির হন সংযুক্ত আরব আমিরশাহির আবু ধাবি বিমানবন্দরে। সেই পুরনো ভিডিয়ো নিয়ে নতুন করে চর্চা শুরু হয় সমাজমাধ্যমে।
ভিডিওতে দেখা গিয়েছে, ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে ব্যক্তিগত জেট থেকে নামছেন এক জন পুরুষ। পোশাকটি দিয়ে শুধুমাত্র রাজার শরীরের নিম্নাংশ ঢাকা। উর্ধ্বাঙ্গ প্রায় নিরাবরণ। তাঁর পিছনে সুসজ্জিত ও আধুনিক পোশাক পরা কয়েক জন রমণী। ভিডিয়োটি প্রথমে সকলের নজর কেড়েছিল বেশ কয়েকটি কারণে। নেটাগরিকদের মনে প্রশ্ন জেগেছিল কেন হঠাৎ করে অর্ধেক পোশাক পরা ব্যক্তিটিকে তাঁর আশপাশের লোকেরা মাথা ঝুঁকিয়ে কুর্নিশ জানিয়ে অভিবাদন করছেন ও সেলাম ঠুকছেন। স্বাভাবিক ভাবেই সকলের কৌতূহলী প্রশ্ন ছিল, কে এই ব্যক্তি? অর্ধেক পোশাক পরে কেন তিনি এত বিলাসবহুল ভ্রমণ করছেন? তাঁর সঙ্গে থাকা মহিলারাই বা কারা?
জানা যায়, তিনি রাজা এমসোয়াতি। তাঁর সঙ্গে ছিলেন রাজপুত্র-কন্যারাও। রাজপরিবারের দেখভালের দায়িত্বে থাকা ১০০ জন পরিচারকও ছিল। বৈষয়িক ও অর্থনৈতিক আলোচনার জন্য আবু ধাবিতে এলেও রাজার বিলাসী জীবন নিয়ে তুমুল আলোচনা শুরু হয় সমাজমাধ্যমে ও সংবাদমাধ্যমে। সংবাদ প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজা ও তাঁর বিরাট সংসার নিয়ে হঠাৎ করে চলে আসার ফলে আবু ধাবি বিমানবন্দরের কাজকর্ম সাময়িক ভাবে লাটে ওঠে।
রাজার আগমন এতটাই আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল যে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থার দেখভালকারীরা তিনটি টার্মিনাল বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে অস্থায়ী লকডাউনও জারি করে দেওয়া হয় সেখানে। রাজা এমসোয়াতিকে চিতাবাঘের ছাপের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরা অবস্থায় দেখা গিয়েছে সেই ভিডিয়োয়। রানিরা ধরা দিয়েছেন উজ্জ্বল, রঙিন পোশাকে। রাজার ১০০ জন পরিচারকের দল রাজকীয় জিনিসপত্র এবং রসদ ব্যবস্থাপনায় ব্যস্ত ছিল।
দেশ গরিব হলে কী হবে, রাজা এমসোয়াতির জীবন বৈচিত্রে ভরপুর। বিদেশে গেলে ব্যক্তিগত বিমান ছাড়া চলেন না। গ্যারাজে রয়েছে রোলস রয়েস থেকে শুরু করে একাধিক বিদেশি বিলাসবহুল গাড়ি। কয়েকশো কোটি টাকা দিয়ে স্ত্রীদের রোলস রয়েস কিনে দিয়েছিলেন রাজা, এমনটাই দাবি তুলেছিল বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম।
তৃতীয় এমসোয়াতি ১৯৮৬ সাল থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার এই ছোট্ট দেশটি শাসন করে আসছেন। একাধিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, তাঁর ব্যক্তিগত সম্পদ ১ হাজার কোটি ডলারেরও বেশি। নির্মাণ, পর্যটন, কৃষি, টেলি যোগাযোগের মতো বিভিন্ন সংস্থার শেয়ারের মালিক রাজা নিজে। রাজার বিলাসবহুল জীবনযাত্রা এবং দেশের নাগরিকদের দৈনন্দিন সংগ্রামের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাত বলেও অভিযোগ।
রাজার সম্পত্তি ফুলেফেঁপে উঠলেও সে দেশের জনগণের অবস্থা শোচনীয়। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশটির স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ব্যবস্থার বেহাল দশা। সরকারি হাসপাতালে রয়েছে ওষুধের ঘাটতি। আর্থিক ভাবে পিছিয়ে থাকা শিক্ষার্থীরা অনুদানের অভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ না করে মাঝপথে পড়াশোনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।
বিশ্ব ব্যাঙ্ক জানিয়েছে, ইসোয়াতিনিতে ২০২১ সালে বেকারত্ব ২৩% থেকে বেড়ে ৩৩.৩% হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের জাতীয় সম্পদ রাজপরিবারের কুক্ষিগত বলে জনগণের ৬০ শতাংশই দারিদ্রসীমার নীচে বাস করেন বলে জানা গিয়েছে।
ইসোয়াতিনির জনতা যতই কষ্টে দিনপাত করুক না কেন, রাজা আছেন মহাসুখে! প্রতি বছর একটি করে বিয়ে সারেন এমসোয়াতি। প্রতি বছর তিনি ঐতিহ্যবাহী ‘রিড ড্যান্স’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এক জন করে নতুন কনে নির্বাচন করেন। সেইমতো বর্তমান রাজার ৩০ জন স্ত্রী রয়েছেন। যদিও সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে বর্তমানে তাঁর সঙ্গে ১৫ জন স্ত্রী রয়েছেন। ৩৫টিরও বেশি সন্তান রয়েছে রাজার।
এই দেশের রাজাদের ঐতিহ্যবাহী একটি নামে ডাকা হয়, তা হল ‘দ্য লায়ন’। তাঁদের পোশাকও রাজার পরিচয় বহন করে। বিয়ে করার জন্য স্ত্রী বাছাই করার পদ্ধতিটিও স্বতন্ত্র। প্রতি বছর অগস্টের শেষে বা সেপ্টেম্বরের শুরুতে সোয়াজি সম্প্রদায়ের হাজার হাজার কুমারী নারী এই অনুষ্ঠানে যোগ দেন। রাজা এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন এবং তাঁদের প্রতি সম্মান জানান। এই সমস্ত তরুণীর মধ্যে থেকে এক জনকে নিজের স্ত্রী হিসাবে বেছে নেন রাজা।
শোনা যায়, বর্তমান রাজার বাবা প্রাক্তন রাজা দ্বিতীয় সোভুজার ১২৫ জন স্ত্রী ছিলেন। কিছু প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে যে, ২১০ জনেরও বেশি সন্তান এবং প্রায় ১ হাজার নাতি-নাতনি ছিলেন তাঁর। আবার কেউ কেউ বলেন, প্রাক্তন রাজার ৭০ জন ঘরনি ছিলেন।
রাজার আবু ধাবি সফরের ভিডিয়োটি প্রকাশ্যে আসার পরে সমালোচনার বন্যা বয়ে গিয়েছে সমাজমাধ্যম জুড়ে। দেশের নাগরিকদের দুর্দশার মধ্যেও রাজার অমিতব্যয়ী ও জাঁকজমকপূর্ণ জীবন নিয়ে কটাক্ষ ধেয়ে এসেছে রাজা ও তাঁর পরিবারের দিকে। কেউ কেউ বলছেন, রাজার পরিবারকে পুরো একটা গ্রামের মতো মনে হচ্ছে। কেউ কেউ আরও তীব্র ভাষায় রাজার নিন্দা করেছেন। এক জন লিখেছেন, “এই ব্যক্তি যখন ব্যক্তিগত বিমানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, তখন তাঁর দেশের লোকেরা অনাহারে মারা যাচ্ছেন।’’
নেটমাধ্যমে অনেকের দাবি, দেশটিতে সমস্ত জায়গায় এখনও বিদ্যুৎ পৌঁছোতে পারেনি। সেখানে রাজা এতগুলি বিয়ে করে দামি দামি উপহারে দেশের জনগণের টাকা উড়িয়ে দিতে কসুর করছেন না।
দেশটির নামের সঙ্গে সুইজারল্যান্ডের নামের মিল থাকায় অনেকেই ভুল বুঝতেন। তাই ২০১৮ সালে দেশের স্বাধীনতার ৫০ বছরে পূর্তি উপলক্ষে রাজা এমসোয়াতি দেশের নাম পাল্টে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সোয়াজিল্যান্ডের নতুন নামকরণ করা হয় ইসোয়াতিনি। ৬,৭০৪ বর্গমাইলের এই দেশটির পুরো নাম ‘দ্য কিংডম অফ ইসোয়াতিনি’। এর অর্থ সোয়াজিদের ভূমি।
শতাংশের হিসাবে বিশ্বে এইচআইভি রোগীর পরিমাণ সবচেয়ে বেশি এই ইসোয়াতিনিতে। দেশের জনসংখ্যার ২৭ শতাংশই রোগাক্রান্ত। ১০ কোটি ৩০ লক্ষ জনসংখ্যার দেশটিতে এইচআইভি রোগীর সংখ্যা প্রায় ২ লক্ষ ১০ হাজার জন। লিঙ্গবৈষম্য, বিভিন্ন অধিকার থেকে দেশবাসীকে বঞ্চিত করা খুব সাধারণ ব্যাপার দেশটিতে এমনটাই দাবি তুলেছে সে দেশের জনসংখ্যার অধিকাংশ। দেশের অভ্যন্তরীণ অরাজকতা বিশ্বের দরবারে যাতে প্রকাশিত না হয় সে জন্য সংবাদমাধ্যমগুলির উপর নিয়ন্ত্রণ জারি করা হয়েছে।
সূত্র: আনন্দবাজার
ভোরের আকাশ/মো.আ.