আবরার হত্যা মামলা
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৭ মার্চ ২০২৫ ১০:০৭ পিএম
২০ জনেরই প্রাণদণ্ড হাইকোর্টে বহাল
এম বদি-উজ-জামান: বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যায় নিম্ন আদালতের দেওয়া ২০ আসামির সবারই ফাঁসির রায় বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে ৫ জনকে দেওয়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশও বহাল রাখা হয়েছে। ২০ আসামির ফাঁসির রায় অনুমোদনের মধ্য দিয়ে নিম্ন আদালতের রায় বহাল রাখলেন হাইকোর্ট। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে চারজন পলাতক। বাকিরা কারাবন্দি। যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্তরাও কারাবন্দি রয়েছেন। বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকাল রোবাবার এ রায় ঘোষণা করেন। ওই মামলায় নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের জন্য পাঠানো ডেথ রেফারেন্স ও কারাবন্দি আসামিদের আপিলের ওপর শুনানি শেষে এই রায় দেওয়া হয়েছে।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন- বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল (সিই বিভাগ, ১৩তম ব্যাচ); সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান রবিন (কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ১৫তম ব্যাচ); তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অনিক সরকার অপু (মেকানিক্যাল ইঞ্জনিয়ারিং, ১৫তম ব্যাচ); সাহিত্য সম্পাদক মনিরুজ্জামান মনির (ওয়াটার রিসোর্সেস ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৬তম ব্যাচ); ক্রীড়া সম্পাদক মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন (মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৫তম ব্যাচ); উপসমাজসেবা সম্পাদক ইফতি মোশাররফ সকাল (বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৬তম ব্যাচ); সদস্য মুনতাসির আল জেমি (এমআই বিভাগ); সদস্য মোজাহিদুর রহমান (ইইই বিভাগ, ১৬তম ব্যাচ); সদস্য হোসেন মোহাম্মদ তোহা (এমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ); সদস্য এহতেশামুল রাব্বি তানিম (সিই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ); শামীম বিল্লাহ (মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ); মাজেদুর রহমান মাজেদ (এমএমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ); খন্দকার তাবাক্কারুল ইসলাম তানভীর (মেকানিক্যাল, ১৭তম ব্যাচ); মুহাম্মদ মোর্শেদ-উজ-জামান মণ্ডল জিসান (ইইই বিভাগ, ১৬তম ব্যাচ); এস এম নাজমুস সাদাত (এমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ); মোর্শেদ অমর্ত্য ইসলাম (এমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ); মিজানুর রহমান (ওয়াটার রিসোসের্স, ১৬ ব্যাচ); শামছুল আরেফিন রাফাত (মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং); উপ-দপ্তর সম্পাদক মুজতবা রাফিদ (কেমিকৌশল) এবং এসএম মাহামুদ সেতু (কেমিকৌশল)। এদের মধ্যে মোর্শেদ-উজ-জামান মণ্ডল জিসান, এহতেশামুল রাব্বি তানিম, মুজতবা রাফিদ ও মুনতাসির আল জেমি পলাতক। এদের মধ্যে প্রথম তিনজন শুরু থেকেই পলাতক। আর জেমি গত বছর ৬ আগস্ট গাজীপুরের হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারের দেয়াল ভেঙে পালান বলে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিকে জানায় কারা কর্তৃপক্ষ। সবমিলে চারজন পলাতক।
যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ আসামি হলেন- বুয়েট ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি মুহতাসিম ফুয়াদ (১৪তম ব্যাচ, সিই বিভাগ); গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক ইসতিয়াক আহমেদ মুন্না (মেকানিক্যাল, তৃতীয় বর্ষ); আইনবিষয়ক উপসম্পাদক অমিত সাহা (সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং); সদস্য আকাশ হোসেন (সিই বিভাগ, ১৬তম ব্যাচ) ও মোয়াজ আবু হোরায়রা (সিএসই, ১৭ ব্যাচ)।
গতকাল হাইকোর্টে রায় ঘোষণরা সময় নিহত আবরারের পিতা বরকত উল্লাহ এবং ছোটভাই আবরার ফাইয়াজ (সেও বুয়েট শিক্ষার্থী) উপস্থিত ছিলেন। রায় ঘোষণার পর বরকত উল্লাহ সন্তোষ প্রকাশ করেন এবং যাতে রায় দ্রুত কার্যকর হয়, সেজন্য প্রয়োজনীয় আইনি পদক্ষেপ নিতে রাষ্ট্রপক্ষের প্রতি অনুরোধ জানান। একইসঙ্গে শিক্ষাঙ্গনে যাতে শিক্ষার পরিবেশ থাকে, শিক্ষার্থীরা নির্ভয়ে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন সেরকম পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সরকারের প্রতি অনুরোধ জানান।
আবরার হত্যার রায় ছাত্র রাজনীতির জন্য কড়া বার্তা : রায়ের পর অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘এ রায় ছাত্র রাজনীতির জন্য একটি কঠোর বার্তা। আজকের রায়ের মধ্য দিয়ে সমাজে এই বার্তা গেল যে, আপনি যত শক্তিশালী হন না কেন, আপনার পেছনে যত শক্তি থাকুক না কেন সত্য একদিন প্রতিষ্ঠিত হবে। ন্যায়বিচার হবেই। আবরার ফাহাদের মৃত্যু এটাই প্রতিষ্ঠিত করে দিয়ে গেছে যে, ফ্যাসিজম যত শক্তিশালীই হোক, মানুষের মনুষত্ববোধ কখনো কখনো জেগে উঠে সব ফ্যাসিজমকে ভেঙে দুমড়ে-মুচড়ে দিতে পারে।’ তিনি বলেন, একটি রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা আনার জন্য ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে বিচার বিভাগের প্রতি যে ধারণা, এই রায়ের মাধ্যমে সে ধারণা প্রতিষ্ঠিত হলো।
রায় দ্রুত কার্যকর হওয়াটাই আমাদের চাওয়া : নিহতের ছোট ভাই আবরার ফাইয়াজ বলেন, ‘হাইকোর্ট থেকে এতবড় একটা রায় আসবে তা আমরা ৫ আগস্টের আগে চিন্তাও করিনি। এটা অবশ্য পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে সম্ভব হয়েছে। তবে রায় কার্যকরের জন্য এখনও অনেকগুলো পদক্ষেপ বাকি আছে। সেসব যেন দ্রুত কার্যকর করা হয়। সেটা আমাদের চাওয়া থাকবে। আবরার ফাহাদ হত্যার পর হাইকোর্টের রায় পেতে পাঁচ বছর লেগেছে। এই রায় কার্যকর হলে একটা দৃষ্টান্ত স্থাপিত হবে। আমরা চাই ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের ঘটনা যেন আর না ঘটে।’ তিনি আরও বলেন, ‘মামলার এক আসামি গত বছরের ৫ আগস্টের পর জেল থেকে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা আমাদের জন্য হতাশার। আমরা এ ধরনের ঘটনা আর চাই না।’ আসামিপক্ষে আইনজীবী আজিজুর রহমান দুলু বলেন, ন্যায়বিচার পাইনি। এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে। হাইকোর্টে রাষ্ট্রপক্ষে আইনজীবী ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. জসিম সরকার, খন্দকার বাহার রুমি, নূর মুহাম্মদ আজমী ও রাসেল আহম্মেদ এবং সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল আবদুল জব্বার জুয়েল, লাবনী আক্তার, তানভীর প্রধান ও সুমাইয়া বিনতে আজিজ। আসামিপক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট এস এম শাহজাহান, মাসুদ হাসান চৌধুরী, মোহাম্মদ শিশির মনির, আজিজুর রহমান দুলু প্রমুখ।
কোনো মামলায় নিম্ন আদালত থেকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলে ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসারে তাতে হাইকোর্টের অনুমোদনের প্রয়োজন পড়ে; যা ডেথ রেফারেন্স হিসেবে পরিচিত। এ কারণে আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় ২০২১ সালের ৮ ডিসেম্বর নিম্ন আদালতের দেওয়া রায় অনুমোদনের জন্য হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স পাঠানো হয়; যা ২০২২ সালের ৬ জানুয়ারি হাইকোর্টে পৌঁছায়। এছাড়া এ মামলার সাজাপ্রাপ্ত কারাবন্দি আসামিরাও আপিল করেন। এরপর বিজি প্রেস থেকে পেপারবুক (সকল নথি একত্রিত করে বাঁধাই করা) প্রস্তুত করা হয়। এই পেপারবুক প্রস্তুত হলেই হাইকোর্টে শুনানির জন্য বেঞ্চ নির্ধারণ করেন প্রধান বিচারপতি। সকল আইনগত প্রক্রিয়া থেকে আবরার ফাহাত হত্যা মামলায় ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের করা আপিলের ওপর গত বছর ২৮ নভেম্বর শুনানি শুরু হয়; যা সম্পন্ন হয় গত ২৪ ফেব্রুয়ারি। উভয়পক্ষের শুনানি সম্পন্ন মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখা হয়। এ অবস্থায় গতকাল প্রকাশ্য আদালতে রায় ঘোষণা করা হলো।
রায় কার্যকরে এখনও তিন ধাপ বাকি : নিম্ন আদালত থেকে কোনো আসামির ফাঁসির রায় কার্যকরের আগে কিছু আইনগত নিয়মকানুন অনুসরণ করার বাধ্যবাধকতার প্রয়োজন পড়ে। কোনো মামলায় নিম্ন আদালত থেকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলে ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসারে তাতে হাইকোর্টের অনুমোদনের প্রয়োজন পড়ে; যা ডেথ রেফারেন্স হিসেবে পরিচিত। এই অনুমোদনের জন্য হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স পাঠানো হয়। আসামিপক্ষে আপিল করুক আর নাই করুক, নিম্ন আদালত থেকে পাঠানো ডেথ রেফারেন্সের ওপর শুনানি শেষে রায় দেন হাইকোর্ট। আর আসামি কারাবন্দি থাকলে তারপক্ষে আপিল করা হলে এবং কারাগার থেকে পাঠানো জেল আপিল-এই তিনটি বিষয় একসঙ্গে শুনানি করা হয়। শুনানি শেষে রায় বহাল রাখা হলে আসামির ফাঁসি কার্যকর করার অনুমোদন দেওয়া হয়। এরপর কারাবন্দি আসামি আপিল বিভাগে আপিল করার সুযোগ পান। আপিল বিভাগে সাজা বহাল থাকলে কারাগারে আাসমির কাছে মৃত্যুপরোয়ানা পাঠানো হয়। এ পর্যায়ে আপিল বিভাগের রায়ের পর আসামিপক্ষে রিভিউ আবেদন করার সুযোগ থাকে। রিভিউ আবেদন খারিজ হলে ফাঁসি কার্যকরের আগে সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়ে আবেদন করার সুযোগ থাকে। রাষ্ট্রপতি প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকোচ করলে ফাঁসি কার্যকরে সকল আইনি বাঁধা দুর হয়। কারাবিধি অনুযায়ী ২১ দিনের আগে নয় বা ২৮ দিনের পরে নয়-এমন সময়ের মধ্যে ফাঁসি কার্যকর করা হয়ে থাকে। ফাঁসি কার্যকরের আসে আসামিকে তার নিকটাত্মীয়দের সঙ্গে শেষবারের মতো সাক্ষাতের সুযোগ দেওয়া হয়। এরপর কারা কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট আসামির ফাঁসি কার্যকর করে থাকে।
আলোচিত এই মামলায়ও আইন অনুযায়ী আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় এ পর্যন্ত ফাঁসির রায় অনুমোদনের ধাপ সম্পন্ন হয়েছে। এখন কারাবন্দি আসামিরা আপিল বিভাগে আপিল করার সুযোগ পাবেন। আসামিপক্ষে আপিল করা হলে সেই আপিলের ওপর শুনানি শেষে রায় দেবেন আপিল বিভাগ। এরপর কারাবন্দি আসামিদের প্রতি মৃত্যুপরোয়ানা জারি করা হবে। এ পর্যায়ে কারাবান্দি আসামিরা রিভিউ আবেদন করার সুযোগ পাবেন। রিভিউ আবেদন নিষ্পত্তি হওয়ার পর রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করার সুযোগ থাকবে। এই তিনটি আইনি ধাপ এখন বাকি রয়েছে।
আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় ২০২১ সালের ৮ ডিসেম্বর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামান এক রায়ে ২০ জনের মৃত্যুদণ্ড ও ৫ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। সাজাপ্রাপ্তরা সকলেই ছাত্রলীগের নেতাকর্মী।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অসম চুক্তি এবং পানি আগ্রাসন নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাসের জেরে বুয়েটের ইলেকট্রিকাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে বুয়েট ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা নৃসংশভাবে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করে। ২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর বুয়েটের শেরেবাংলা হলের সিঁড়ি থেকে তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের পর বুয়েটসহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যাপক ছাত্র বিক্ষোভ হয়। এই হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে সমাজের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষও সোচ্চার হন। নির্মম এই হত্যাকাণ্ডে আবরার ফাহাদের বাবা বরকত উল্লাহ ১৯ জনকে আসামি করে ওই বছরের ৭ অক্টোবর চকবাজার থানায় মামলা করেন। মাত্র ৩৭ দিনে তদন্ত শেষ করে একই বছরের ১৩ নভেম্বর চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক মো. ওয়াহিদুজ্জামান। আবরার হত্যাকে কেন্দ্র করে বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।