নিখিল মানখিল
প্রকাশ : ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০১:৪৭ পিএম
ফাইল ছবি
চলতি বছর ডেঙ্গুতে মাসিক মৃত্যুর রেকর্ড ভেঙে গেল গত বৃহস্পতিবার। এ বছর এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ মৃত্যু হয়েছিল জুলাই মাসে, ৪১ জন। আর চলতি মাসের ১১ দিন বাকি থাকতেই এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ৪৬ জনের।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতি বছর জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি থাকে। এই কয়েকটি মাসেই ডেঙ্গুর ‘পিক মৌসুম’ দেখা দেয়। চলমান পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে চলতি মাসেই ডেঙ্গুর পিক মৌসুম চলছে। কিন্তু ডেঙ্গু মোকাবিলায় নেই বিশেষ ব্যবস্থা। নগরীর দু’টি সিটি করপোরেশনের মশক নিধন কার্যক্রম বিশেষ করে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার লার্ভা ধ্বংস করতে কোনো কার্যক্রম চোখে পড়ছে না। তবে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসাসেবা প্রদানে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
গতকাল শুক্রবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ২৪৮ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তবে এই সময়ের মধ্যে এডিস মশাবাহিত রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে কারও মৃত্যু হয়নি। এই সময়ে ঢাকা মহানগরের হাসপাতালগুলোতে ৮৭, চট্টগ্রাম বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৫৩ জন, ঢাকা বিভাগে ৫২ জন, বরিশাল বিভাগে ৪৩ জন ও ময়মনসিংহ বিভাগে ১৩ জন ভর্তি হয়েছেন। এই রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ১৬৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এদের মধ্যে ৮৬ জন পুরুষ ও ৮১ জন নারী। এছাড়া, এই বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৪০ হাজার ৭০৯ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের ভয়াবহ ডেঙ্গু পরিস্থিতির দায় এড়াতে তৎপর সংশ্লিষ্টরা। ডেঙ্গু সংক্রমণ না কমার পেছনে মশা নিধনে ব্যর্থতার দায় নিতে নারাজ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তাদের দায়িত্ব ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসাসেবা প্রদান করা। মশক নিধনের সফলতা ও ব্যর্থতা নিয়ে কোনো মন্তব্য নেই নগরীর দুই সিটি করপোরেশনের। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মধ্যে নেই কার্যকর সমন্বয়তা।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এডিস মশাবাহিত রোগ ‘ডেঙ্গু’। ঢাকা সিটিতে ডেঙ্গুতে মৃত্যুহার বেশি, আক্রান্ত বেশি ঢাকা সিটির বাইরের এলাকাসমূহে। মশক নির্ধনের দায়িত্বে রয়েছে সিটি করপোরেশন। এটি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীন। আর ডেঙ্গু রোগীকে চিকিৎসাসেবা প্রদানের দায়িত্বে আছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি এবং নিয়মিত মশা নিধন অভিযানসহ আপাতদৃষ্টিতে নানান ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তবে, তা সত্ত্বেও ঢাকায় এডিস মশাবাহিত এ রোগের প্রকোপ স্মরণকালের ভয়াবহ পরিস্থিতি পার করছে।
কর্তৃপক্ষ বলছে, এডিস মশার প্রজনন স্থল (লার্ভা) ধ্বংস করতে চিরুনি অভিযানসহ তাদের আওতাধীন বিভিন্ন এলাকায় নিয়মিত মশা নিধন অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। নগরীতে মশা জন্মানোর অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অনেককে জরিমানাও করা হচ্ছে। তবে সিটি করপোরেশনের সকল প্রচেষ্টাই নিছক লোক দেখানো হওয়ায় ডেঙ্গু থেকে সাধারণ মানুষ রক্ষা পাচ্ছে না বলে অভিযোগ অনেকের।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের সব এলাকায় নিয়মিত মশার ওষুধ না ছিটানো, ফগিং-এর সময় গলির মধ্যে না গিয়ে মেইন রাস্তায় ফগিং করাসহ লোক দেখানো অভিযান পরিচালনা করে জরিমানা আদায়, ডোবা-নালা নিয়মিত পরিষ্কার না করায় সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম কোনো কাজে আসাছে না বলে অভিযোগ করেছেন নগরবাসী।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে হবে : বিশেষজ্ঞরা
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে না নিলে এ কাজে গতি আসবে না বলে জানিয়েছেন কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার। তিনি বলেন, এই চ্যালেঞ্জটা সিটি করপোরেশনগুলো কতটা নিতে পেরেছে- সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। ডেঙ্গু যে আকারে ছড়িয়ে পড়েছে এখন আসলে সিটি করপোরেশনের আর করার কিছুই নেই।
তিনি বলেন, যখন একটা ইনফেকশন ছড়িয়ে পড়ে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে কোনো কাজ হয় না। তার মতে, সিটি কপোরেশনের ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ প্রস্তুতিতে অবশ্যই ঘাটতি ছিল তবে, বর্তমানে যে পরিস্থিতি তার চেয়ে ভয়ংকর হতে পারত যদি সিটি করপোরেশন কন্ট্রোল না করত।
তিনি আরও বলেন, এ মুহূর্তে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম গতানুগতিক পদ্ধতিতে করলে হবে না। হটস্পট ধরে ধরে উড়ন্ত মশা নিধন কার্যক্রম বাড়াতে হবে। সব জায়গায় প্রজননস্থল ধ্বংস (সোর্স রিডাকশন) করতে হবে। মশার লার্ভা ধ্বংসে নতুন প্রজন্মের বায়ো লার্ভিসাইড বিটিআইর প্রয়োগ করতে হবে। এ কাজে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান বিশেষ করে সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি জনগণ ও সামাজিক সংগঠনকেও সম্পৃক্ত হতে হবে।
ডেঙ্গু বিশেষজ্ঞ, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ ভোরের আকাশকে বলেন, দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতি অব্যাহত রয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে সারা বছরই ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত এবং মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। মশক নির্ধন ও লার্ভা ধ্বংস কার্যকর আরো জোরালো করতে হবে। সাধারণ মানুষের মাঝে সচেতনতা না বাড়লে ডেঙ্গু প্রতিরোধ কার্যক্রম সফল হবে না। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে এবছর সেপ্টেম্বরেই ডেঙ্গুর ‘পিক মৌসুম’ চলছে বলে জানান এবিএম আব্দুল্লাহ।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা তৌহিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যত কোনো কার্যক্রম নেই। বিষয়টি একেবারে গা-সওয়া হয়ে গেছে। সরকারের কোনো ভাবনা নেই। মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যত ব্যর্থ সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলো। ঢাকার বাইরে এবার যে ডেঙ্গু বাড়তে পারে, তা শুরু থেকেই ধারণা করা হয়েছিল। কিন্তু ঢাকার বাইরে মশা নিয়ন্ত্রণে কোনো ব্যবস্থাই নেই।
ভোরের আকাশ/এসএইচ