নিখিল মানখিন
প্রকাশ : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০১:১১ এএম
ছবি: সংগৃহীত
মারামারির ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন দুর্গাপুর উপজেলার মো. ইউসূফ (৩৭)। কয়েকদিন থাকার পর সুস্থ ভেবে তাকে ছাড়পত্র দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু হাসপাতাল থেকে যাওয়ার দু’দিন পর তার মৃত্যু ঘটে। মৃত্যু পরবর্তী ময়নাতদন্তে আঘাতজনিত কারণে শরীরের ভেতরে প্রচুর রক্তক্ষরণের বিষয়টি ধরা পড়ে, যা হাসপাতালের চিকিৎসকরা শনাক্ত করতে পারেননি। এমন ভুল চিকিৎসার আতঙ্কে সাধারণ মানুষ। ভুল চিকিৎসায় রোগী মৃত্যুর অভিযোগ ও মামলার বিষয়টি আজ স্বাভাবিক ঘটনায় রূপ নিয়েছে। ভুল চিকিৎসার অভিযোগ তোলার সুযোগ পায় না অনেক অসহায় রোগীর স্বজনেরা। এতে দেশের চিকিৎসাসেবার ওপর সাধারণের আস্থা হ্রাস পেয়েই চলেছে। ভল চিকিৎসার অভিযোগকে কেন্দ্র করে প্রায়শই চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী বা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে রোগীর স্বজনদের বাদানুবাদ, ভাঙচুর এবং উভয়পক্ষে লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনার খবর পাওয়া যায়।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলছেন, ‘আস্থা’ ধরে রাখতে না পারলে ভবিষ্যতে মারাত্মক সমস্যায় পড়বে দেশের চিকিৎসা সেক্টর। বেড়ে যাবে চিকিৎসার জন্য বিদেশগামী রোগীর সংখ্যা। চিকিৎসা সেক্টরে অরাজকতা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে বলে আশঙ্ক প্রকাশ করেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলেন, চিকিৎসায় অবহেলা বা ভুল বলতে শুধু চিকিৎসকের অবহেলা নয় বরং চিকিৎসাসেবা সংক্রান্ত আনুষঙ্গিক ব্যবস্থা যেমন- নার্স, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম উৎপাদন ও সরবরাহকারীদের অবহেলাও বুঝানো হয়।
ভুল চিকিৎসা বা চিকিৎসা অবহেলার অভিযোগ নিষ্পত্তি এবং আইনগত প্রতিকারের জন্য এখনো বাংলাদেশে একক কোনো আইন কার্যকর নেই। বাংলাদেশে ২০১৬ সালে ‘রোগী এবং স্বাস্থ্যসেবা দানকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সুরক্ষা আইন’ নামে একটি আইন প্রস্তাব করে সরকার। কিন্তু এই আইনটি এখনো কার্যকর হয়নি। তবে বিভিন্ন বিক্ষিপ্ত আইনে চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগে আইনি প্রতিকারের সুযোগ রয়েছে। ভুল চিকিৎসায় রোগী মৃত্যু ও শারীরিক ক্ষতির শিকার হওয়ার বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে আলোচনা-সমালোচনা। আইনি লড়াইয়ে ভুল চিকিৎসা প্রদান প্রমাণিত হয়ে অভিযুক্তদের জেলে যাওয়ার ঘটনাও কম নয়। দুই একদিন পর পর এমন ঘটনার খবর বিভিন্ন প্রিণ্ট ও ইলেকট্রনিকস মিডিয়ায় প্রকাশ ও প্রচার হচ্ছে। এসব খবরে আতঙ্কিত হয়ে চিকিৎসা গ্রহণের আগে বারবার ভাবতে হচ্ছে রোগী ও তাদের স্বজনদের।
চলতি বছরের গত আগস্টের ঘটনা। ফেনীর আল-কেমী হাসপাতালে সিজারের সময় রোগীর পেটে গজ রেখেই সেলাই করে দেওয়া হয়। সাত মাস ধরে অসহনীয় ব্যথা ও দুর্ভোগের পর, অবশেষে দ্বিতীয় অস্ত্রোপচারে গজটি অপসারণ করা হয়। এ অভিযোগের ভিত্তিতে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
আল-কেমী হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল মান্নান বলেন, ‘ঘটনাটি অত্যন্ত দুঃখজনক। বিষয়টি আমরা অভ্যন্তরীণভাবে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।’
ভুক্তভোগী রোগী ফরিদা ইয়াসমিন (৪০) ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার শুভপুর এলাকার প্রবাসী মহিউদ্দিনের স্ত্রী। ঘটনার পর গত ২৮ আগস্ট ফরিদার পরিবার অভিযুক্ত চিকিৎসক ও আল-কেমী হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ফেনী সিভিল সার্জন কার্যালয়ে লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছে। চলতি বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি প্রসূতি ফরিদা ইয়াসমিন আল-কেমী হাসপাতালে ভর্তি হন। ওই দিনই গাইনি বিশেষজ্ঞ ও সার্জন ডা. তাসলিমা আক্তার তার সিজার করেন। এসময় রোগীর পেটে গজ রেখেই সেলাই করে দেন চিকিৎসক। চারদিন পর তাকে ছাড়পত্র দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
এরপর থেকে ফরিদা নিয়মিত ব্যথা ও নানা ধরনের শারীরিক সমস্যায় ভুগতে থাকেন। তিনি বারবার ডা. তাসলিমার পরামর্শ নেন এবং প্রতিবারই তাকে শুধু ব্যথানাশক ওষুধ দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। দীর্ঘদিনেও অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় এক সপ্তাহ আগে ফরিদা ফেনী জেড ইউ মডেল হাসপাতালের সার্জন ডা. কামরুজ্জামানের শরণাপন্ন হন। প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তার পেটে অজানা বস্তু থাকার বিষয়টি ধরা পড়ে। এরপর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় অস্ত্রোপচারের।
পরবর্তীতে গত ২৭ আগস্ট রাতে শহরের আল-বারাকা হাসপাতালে সার্জারি বিশেষজ্ঞ ডা. মোহাম্মদ আজিজ উল্লাহ রোগী ফরিদার দ্বিতীয় অস্ত্রোপচার করেন। এ সময় তার পেট থেকে প্রায় এক কেজি ওজনের এক ফুট দীর্ঘ গজ বের করেন তিনি। গত ২ আগষ্টের ঘটনা। চিকিৎসকদের ভুল চিকিৎসার মাশুল দিতে হয় রোগীদের চাঁদপুরের শাহরাস্তির একটি হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় এক প্রসূতির মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে। রোগীর স্বজনদের অভিযোগ, অস্ত্রোপচারের সময় নারীর মূত্রথলি কেটে ফেলেন চিকিৎসক।
এর জেরে তার মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় ওই হাসপাতালে ভাঙচুর করেছে রোগীর স্বজনেরা। পাশাপাশি হাসপাতালের গেটে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে তারা। উপজেলার ঠাকুর বাজার এলাকার শাহরাস্তি জেনারেল হাসপাতালে এ ঘটনা ঘটে। নিহত ওই প্রসূতির নাম উম্মে হাসনা রিপা (২৯)। তিনি উপজেলার পূর্ব নিজমেহার কবিরাজ বাড়ির প্রবাসী দিদার হোসেনের স্ত্রী।
শাহরাস্তি থানার ওসি মো. আবুল বাসার বলেন, ‘খবর পেয়ে আমরা দ্রুত হাসপাতালে যাই এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনি। বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লাহ ভোরের আকাশকে বলেন, চিকিৎসকের কাছ থেকে রোগীদের সঠিক চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার আছে। যদি তারা সঠিক চিকিৎসা না পায় তাহলে বিএমডিসিতে অভিযোগ দায়েরের সুযোগ রয়েছে। অভিযোগগুলো একটি শৃঙ্খলা কমিটির মাধ্যমে তদন্ত করে সমাধান করা হয়।
বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডীন অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ ভোরের আকাশকে বলেন, চিকিৎসাশাস্ত্র একটি স্পর্ষকাতর ক্ষেত্র। চিকিৎসাসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে ভুল হতে পারে না, এমন কথা বলতে পারব না। তবে প্রকৃত চিকিৎসক, নার্স এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ইচ্ছেকৃতভাবে চিকিৎসাসেবা প্রদানে ভুল করেন না। কিছুৃ সংখ্যক অসাধু চিকিৎসক, নার্স, টেকনিসিয়ান, স্বাস্থ্যকর্মী আছেন যারা ব্যবসায়িক স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। তাদের দ্বারা রোগীর ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
অবহেলার শিকার তিনজনে একজন : বিবিএসের জরিপ
দেশের প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন মানুষের সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতালে অবহেলা, অযত্ন ও অপচিকিৎসার শিকার হওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে। গ্রামের চেয়ে শহরে এই হার বেশি। দেশের ৯১ শতাংশ মানুষ চান, সরকার যেন সব মানুষকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দিতে আইনগতভাবে বাধ্য থাকে। দেশের মানুষের স্বাস্থ্য খাত নিয়ে এই মন্তব্য বা মতামত উঠে এসেছে স্বাস্থ্য খাত সংস্কারবিষয়ক জনমত জরিপে। কমিশনের অনুরোধে জাতীয় এই জরিপ করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)।
১৮ ফেব্রুয়ারি বিবিএসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা স্বাস্থ্য খাত সংস্কারবিষয়ক কমিশনের কাছে জরিপের প্রাথমিক প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। মানুষ কোথায় চিকিৎসা নেন, চিকিৎসার জন্য কত মানুষ বিদেশ যান, ওষুধ নিয়ে ভাবনাসহ স্বাস্থ্য খাত-সংক্রান্ত নানা চিত্র জরিপে উঠে এসেছে। জাতীয় অধ্যাপক এ কে আজাদ খানের নেতৃত্বে স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশন কাজ করছে।
৩১ মার্চ কমিশনের প্রতিবেদন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানের কাছে জমা দেওয়ার কথা। দেশের ৩৮ শতাংশ মানুষ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে অবহেলা, অযত্ন বা অপচিকিৎসার শিকার হন। গ্রামের ৩৬ শতাংশ মানুষ ও শহরের ৪৪ শতাংশ মানুষ এই অভিযোগ তুলেছেন। এসব অভিযোগ নারী ও পুরুষের ক্ষেত্রে প্রায় সমান। সব বয়সী মানুষের মধ্যে এই অভিযোগ প্রায় সমানভাবে দেখা গেছে। লিঙ্গ ও বয়সনির্বিশেষে এই অভিযোগ সবচেয়ে বেশি ময়মনসিংহ বিভাগে (৪৪.২ শতাংশ) এবং সবচেয়ে কম খুলনা বিভাগে (৩২.৩ শতাংশ)।
ভোরের আকাশ/এসএইচ