ভোরের আকাশ বিনোদন
প্রকাশ : ২৬ জুলাই ২০২৫ ১০:৫৪ এএম
সংগৃহীত ছবি
বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের এক উজ্জ্বল ও শক্তিমান নাম ডলি জহুর। যুগের পর যুগ নাটক, সিনেমা ও মঞ্চে তার সহজাত অভিনয় দিয়ে দর্শকের মনে স্থান করে নিয়েছেন তিনি। তিনবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ বহু সম্মাননায় ভূষিত হলেও, আজকাল তাকে অভিনয়ে খুব একটা দেখা যায় না। বর্তমান পর্বে তার কাজের সংখ্যা অনেকটাই কমে এসেছে। ডলি জহুরের জীবন, অনুভূতি এবং শিল্পের প্রতি তার দর্শন নিয়ে গভীর আলোকপাত থাকল এই আলোচনায়।
অভিনয় থেকে সরে আসার কারণ: ডলি জহুর স্পষ্ট বলেন, বর্তমান নাটক ও সিনেমার গল্প-চরিত্রগুলোতে নতুনত্বের ঘাটতি রয়েছে। একই ধরনের গল্প আর ঘুরেফিরে আসা চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে একঘেয়েমি কাজ করে তার মধ্যে। বিশেষ করে সিনেমায় প্রায়ই মা চরিত্রে তাকে ডাকলেও, এগুলোর গুরুত্ব কম থাকে যে কারণে তিনি আর আগ্রহ পান না। অভিনয়শিল্পী হিসেবে সেই চরিত্র চান, যেখানে নিজের প্রতিভা তুলে ধরার সুযোগ থাকে।
একঘেয়ে ও গুরুত্বহীন চরিত্রে আর কাজ করতে ইচ্ছা করে না। নাটক এখনো করি, যদি কিছু ভিন্নতা পাই। দর্শকের ভালোবাসা ও নিজের অর্জনকে মূল্যবান মনে করে ডলি জহুর। তাই তিনি চান, জীবনটা আতিশয্য ছাড়াই শান্তিতে কাটাতে।
কাজ বন্ধের কষ্ট ও শিল্পীর তৃষ্ণা: কাজ কমিয়ে দেওয়াতে মামুলি কোনো আফসোস নেই তার, তবে শিল্পীর মনের যে অস্থিরতা ও অভিনয়ের ক্ষুধা, সেটির তৃপ্তি নেই বলেই কষ্ট হয় বলে জানান ডলি জহুর। পেশাদার অভিনেত্রী হিসেবে সারাজীবন চেষ্টা করেছি চরিত্রর সত্যতা ধরে রাখতে। সম্মানি নয়, আমি অভিনয়কে ভালোবেসে করেছি; মানুষের ভালোবাসার জন্যই সবকিছু।
তাৎপর্যপূর্ণভাবে বলেন, ‘ভালোবাসা’-ই শিল্পীপনার মূল অনুপ্রেরণা। বর্তমানে সেই সত্যিকারের ভালোবাসার খরা দেখেন তিনি; তার মতে, মানুষের আবেগ ও আন্তরিকতার জায়গায় কৃত্রিমতা ঢুকে পড়েছে। সবাই আজ আত্মকেন্দ্রিক শিল্প কিংবা সমাজ নিয়ে ভাবনার সুযোগই নেই।
সমকালীন শিল্প-ইন্ডাস্ট্রি ও মানুষের মনস্তত্ত্ব: ডলি জহুর মনে করেন, আজকের ইন্ডাস্ট্রিতে নিখাদ ভালোবাসা ও পারস্পরিক নির্ভরতা আগের মতো নেই। সমাজ ও সম্পর্ক নিয়ে তার পর্যবেক্ষণ: মানুষ এখন আর আপনজনকে নিজের মনে করতে পারে না। সবাই যেন শুধু ব্যক্তিগত উন্নতি ও সামর্থ্য বৃদ্ধিতেই ব্যস্ত। এই সময়ের শিল্প-পরিমণ্ডল ও পরিবর্তিত সভ্যতায় নিঃস্বার্থ ভালোবাসার জায়গা সংকুচিত হয়ে এসেছে বলেই তিনি ভাবেন। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই বিষয়ে তার অনুভূতি আরও গভীর হয়েছে।
পরিবার, দেশ, ও পরিচিতির আকর্ষণ: অস্ট্রেলিয়ায় থাকা একমাত্র সন্তানের কাছে চলে যেতে সুযোগ থাকলেও, তিনি নিজেকে সে গণ্ডির মধ্যে আটকে রাখতে চান না।
ডলির অনুভূতি: দেশের মাটি, খোলা আকাশ, চেনা মানুষ, পরিবেশ এসবই আমার জীবনের আনন্দ। বিদেশে গেলেই মনে হয় বন্দিত্ব, যে স্বাধীনতা এখানে পাই সেখানেই শান্তি। দেশের মানুষের কষ্ট দেখলে, নিজেকে অন্তত তাদের পাশে দেখতে চান।
পুরস্কার ও প্রকৃত কৃতজ্ঞতা: জীবনের সব অর্জন, পুরস্কার ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির চেয়েও ডলি জহুরের কাছে সবচেয়ে বড় পাওনা দর্শকের অকৃত্রিম ভালোবাসা ও সম্মান। মানুষের ভালোবাসা, এটাই হয়েছে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পুরস্কার। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি গুরুত্বপূর্ণ, তবে দর্শকের ভালোবাসাই একজন শিল্পীর মূল চালিকাশক্তি। তিনি মনে করেন, শিল্পীর এগিয়ে চলার প্রেরণা ও মুকুট দর্শকের এই ভালোবাসা, যা তাকে আজকের জায়গায় নিয়ে এসেছে।
ডলি জহুরের দর্শনে শিল্প ও মানবতার মিশেল: বাংলাদেশের সংস্কৃতি-ইতিহাসের এক অনুসরণযোগ্য পর্বজ বিশিষ্ট শিল্পী ডলি জহুরের জীবন ও অনুভূতি সচেতন দর্শক, মেধাবী সহকর্মী ও নবীন শিল্পীদের জন্য অন্যতম শিক্ষা। উপলব্ধি, আবেগ আর আদর্শিক আন্তরিকতায় তিনি জানান দেন শিল্প, দেশ, মানুষ ও ভালোবাসার টানেই এগিয়ে চলে একটি শিল্পীর যাত্রা; পুরস্কার, অর্থ কিংবা খ্যাতির উর্ধ্বে মানবিকতা ও আত্মপ্রত্যয়ই তার আসল পরিচয়।
ভোরের আকাশ/এসএইচ