বিনোদন প্রতিবেদন
প্রকাশ : ১৭ আগস্ট ২০২৫ ০২:৫৩ পিএম
কনসার্টের জন্য বাচ্চুকে রাত আড়াইটায় ডেকে নিয়েছিলেন ‘পপ গুরু’
দেশের পপ ও আঙিনায় চির উজ্জ্বল দুই নাম-পপগুরু আজম খান এবং আইয়ুব বাচ্চু। একজন স্বাধীনতার পরের প্রজন্মকে রক সংগীতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, অন্যজন সেই পথে ব্যান্ডসংগীতকে পৌঁছে দিয়েছিলেন জনপ্রিয়তার শিখরে। তারা একে অন্যের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন শ্রদ্ধা, স্নেহ ও বন্ধুত্বের বাঁধনে।
অনেক কাল আগে এক গভীর রাতে এই শহরের মানুষ আজম খান ও বাচ্চুকে পেয়েছিলেন গানের আসরে। কমলাপুরের এজিবি কলোনিতে আজম খানের গানের ওই আসরে কীভাবে তিনি গিয়ে জুটলেন সেই গল্প বাচ্চু করেছিলেন টেলিভিশনের এক অনুষ্ঠানে। যে অনুষ্ঠানের ভিডিও এখন ঘুরছে সোশাল মিডিয়ায়।
চট্টগ্রামে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশের ব্যান্ড ইতিহাসের অন্যতম নায়ক, দেশের অন্যতম সেরা গিটার বাদক বাচ্চুর ৬৩তম জন্মবার্ষিকীতে সেই ঘটনাটি তুলে ধরছে গ্লিটজ।
ঘটনাটি এমন, এক গভীর রাতে শহর যখন ঘুমিয়ে, তখন গুরু আজম খানের ফোনে আইয়ুব বাচ্চু আর বাসায় থাকতে পারেনি। বাচ্চুকে এজিবি কলোনিতে নিয়ে যাওয়ার জন্য বাইক পাঠিয়েছিলেন পপগুরু।
বাচ্চু বলেন, ‘রাত আড়াইটায় গুরু আজম খান আমাকে ফোন করলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘ঘুমাইছ?’ আমি বললাম, ‘না গুরু, আমি ঘুমাইনি।’ বললেন, ‘আইয়া পড়ো না।’ আমি বললাম, ‘কোথায় আছেন আপনি?’ বললেন, ‘এজিবি কলোনিতে আইসা পড়ো।’ এত রাতে যেতে দ্বিধা করতেই গুরুর কণ্ঠে দৃঢ়তা পেলেন বাচ্চু। আজম খান তাকে বলেছিলেন , ‘আমি লোক পাঠাইতাছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই দুইটি বাইক এসে দাঁড়ায় বাচ্চুর বাসার সামনে।
বাচ্চু কমলাপুরের এজিবি কলোনিতে পৌঁছে দেখেন তখন উৎসবের মাঠ। প্রায় ২০ হাজার মানুষ পপগুরুর গানের মায়ায় ডুবে আছে। পৌঁছে মঞ্চে উঠার সাথে সাথেই আইয়ুব বাচ্চুকে আদরে জড়িয়ে ধরে গালে স্নেহের চুম্বন এঁকে দিয়েছিলেন আজম খান।
বাচ্চু বলেন, ‘আমার বাবাও আমাকে এত চুমু খায়নি। যতটা গুরু আমাকে চুমু খেয়েছেন। মঞ্চে প্রকাশ্যে, মানুষের সামনে। আমার তাতে যেমন লজ্জা লাগত, তেমন ভক্তি লাগত। আমার এটাকে বিশেষ প্রাপ্তি মনে হয়েছিল। একটা স্নেহের মায়ার প্রাপ্তি। এগুলো অনেক মনে পড়ে।’ গুরুর অনুরোধে বাচ্চু গিটার হাতে তুলে গাইলেন কালজয়ী গান ‘সেই তুমি’। পাশে দাঁড়িয়ে আজম খানও গলা মেলালেন।
বাচ্চুর কথায়, ‘আমি যাওয়ার পর উনি মাইকে বললেন, এই আমার ছেলে আইসা পড়ছে। তোমরা দেখতে চাইছ, এখন ওর গান আমিও গাইব একলগে। আমাকে গিটার দেওয়া হল আমি ‘সেই তুমি’ গাইলাম, গুরুও পাশে দাঁড়িয়ে আমার সঙ্গে গাইলেন। আমার গান শেষ হইল, তারপর তিনি বললেন, এবার তোমার একটা গান গাই। আমি বললাম গান গুরু।
‘আমার কাছের আনন্দের হল আমি গিটার বাজাবো, গুরু গান করবেন। তারপর তিনি গাইলেন কিশোর কুমারের, ‘আমি যে কে তোমার, তুমি তা বুঝে নাও’। আমাকে উৎসর্গ করে গানটা করলেন।’ ১৯৬২ সালে ১৬ অগাস্টে এক বনেদি হাজী পরিবারে জন্মেছিলেন বাচ্চু। ডাক নাম রবিন। পড়েছেন গভ. মুসলিম হাইস্কুলে। সংগীতশিল্পী আজম খানে মুগ্ধ হয়ে ব্যান্ডে আগ্রহ তৈরি হয় আইয়ুব বাচ্চুর। ১৯৭৮ সালে ‘ফিলিংস’ ব্যান্ডের মাধ্যমে গানের জগতে যাত্রা শুরু করেন।
১৯৮০ সাল থেকে ১০ বছর সোলস ব্যান্ডের সাথে ছিলেন লিড গিটারিস্ট হিসেবে। আশির দশকের শুরুর দিকে জন্মশহর চট্টগ্রাম থেকে হাতে অল্প কিছু টাকা নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন বাচ্চু। এলিফ্যান্ট রোডের একটি হোটেলে বসবাস করে একটি গিটার নিয়ে নিয়মিত গান চর্চা করতেন তিনি।
মাঝেমধ্যে বিয়ের অনুষ্ঠানে গান গাইতেন। স্বপ্ন দেখতেন গানের সুর আর গিটারের ঝংকারে ভূবন ভরিয়ে দেওয়ার।সেই স্বপ্নকে সত্যি করতে তখন বাচ্চুর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী রুনা লায়লা। রুনা লায়লা তাকে হোটেল সোনারগাঁওয়ে এক অনুষ্ঠানে পারফর্ম করতে সহায়তা করেছিলেন। ধীরে ধীরে তিনি হয়ে ওঠেন ব্যান্ড সংগীতের অপ্রতিদ্বন্দ্বী তারকা। ১৯৯১ সালে বাচ্চু তৈরি করেন তুমুল জনপ্রিয়তা পাওয়া ব্যান্ড এলআরবি। বাচ্চু পৃথিবী ছেড়ে চলে যান ২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর।
দীর্ঘ সংগীত জীবনে আইয়ুব বাচ্চুর ‘আমি কষ্ট পেতে ভালোবাসি’, ‘একদিন ঘুমভাঙা শহরে’, ‘চল বদলে যাই’, ‘এখন অনেক রাত’, ‘বারো মাস’, ‘হাসতে দেখ গাইতে দেখ’র মত বহু গান শ্রোতাদের উপহার দিয়েছেন। একে একে তিনি বের করেছেন ‘ফেরারি মন’, ‘ঘুমন্ত শহরে’, ‘হকার’, ‘অচেনা জীবনে’, ‘মনে আছে নাকি নাই’, ‘স্বপ্ন’, ‘সুখ’, ‘তবুও’, ‘মন চাইলে মন পাবে’ এর মত জনপ্রিয় সব অ্যালবাম। তার শেষ অ্যালবাম ‘স্পর্শ’।
ভোরের আকাশ/তা.কা