ভোরের আকাশ প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৮ মে ২০২৫ ০৮:৩৮ পিএম
‘দুষ্কৃতকারীদের’ নিয়ন্ত্রণে নগদ: বাংলাদেশ ব্যাংক
বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান নগদে তারা নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান গতকাল বিকেলে প্রধান কার্যালয়ে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, দুষ্কৃতকারীরা আবারও নগদে নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। ফলে পুনরায় অবৈধ টাকা বা ই-মানি তৈরির আশঙ্কা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি আদালতের রায়ের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটির নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। এই সুযোগে নতুন করে ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ অন্যান্য কর্মীদের বিভাগ পরিবর্তন করা শুরু করেছে নগদ। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেনসিক অডিটে যারা সহায়তা করেছেন এমন ২৩ জন কর্মকর্তাকে অব্যাহতি দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এমনকি ‘অবৈধ পন্থায়’ নগদে এমডি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এমন এক ব্যক্তিকে যিনি বিপুল আর্থিক জালিয়াতির অভিযোগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়ের করা মামলার আসামি।
মুখপাত্র বলেন, নগদের আগের বোর্ডে যারা ছিলেন তারা বিপুল আর্থিক অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন। যেহেতু প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে কোটি কোটি জনগণের সম্পৃক্ততা আছে এবং শত শত কোটি টাকার আমানত এখানে জড়িত তাই বাংলাদেশ ব্যাংক সাময়িকভাবে প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্ব নেয়। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের আইনজীবীর অনুপস্থিতিতে প্রশাসক নিয়োগের সিদ্ধান্তে আট সপ্তাহের স্থগিতাদেশ দেন উচ্চ আদালত। এর উপর ভিত্তি করে এমন সব ব্যক্তিদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হচ্ছে যারা অবৈধভাবে ৬৫০ কোটি টাকার ই মানি তৈরি করেছিল।
আরিফ হোসেন বলেন, নগদের আইটি বিভাগের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ‘দুষ্কৃতকারীরা’ বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সব ধরনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। ফলে প্রতিষ্ঠানটিতে এই মুহূর্তে কি হচ্ছে- তা নিয়ে শংকিত বাংলাদেশ ব্যাংক। বিগত সময়ের মতো অর্থ তসরুপ এবং বেআইনি কর্মকাণ্ড হওয়ার আশঙ্কার কথাও জানান মুখপাত্র। তিনি বলেন, আগামী ১৯ মে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্টের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ প্রতিষ্ঠানটির বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়ের করা মামলার আসামিদের পুলিশ কেন খুঁজে পাচ্ছে না সে প্রশ্ন রাখেন মুখপাত্র। উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ডাক বিভাগকে নগদ পরিচালনার লাইসেন্স দিয়েছে। কিন্তু ডাক বিভাগ কেন দ্বিতীয় পক্ষের হাতে প্রতিষ্ঠানটিকে তুলে দিল তা আমাদের উদ্বিগ্ন করেছে।
জানা গেছে, গত ১৫ মে মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠান নগদে প্রশাসক নিয়োগের সিদ্ধান্ত স্থগিত করেছেন হাইকোর্ট। এর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নগদ পরিচালনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যে প্রশাসক দল কাজ করে আসছিলেন, তারা দায়িত্ব হারিয়েছেন। ফলে নগদের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংক ও ডাক বিভাগ, দুই প্রতিষ্ঠানই নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে।
এদিকে নগদের অর্থ তসরুপের জন্য যাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক, তাদের মধ্যে একজনকে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নিয়োগ করা হয়েছে। তিনি হলেন প্রতিষ্ঠানটির সাবেক পরিচালক মো. সাফায়েত আলম। ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্ব নিয়ে তিনি নতুন মানবসম্পদ কর্মকর্তা নিয়োগসহ নানা ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে শুরু করেছেন। গত দুই দিনে শীর্ষ পর্যায়ের ২৩ কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়ের করা মামলার আরও দুই আসামিকে নতুন করে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এতে নগদ পরিচালনায় নতুন করে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। হাইকোর্টের সিদ্ধান্ত স্থগিত করে দেওয়া আদেশ প্রত্যাহার চেয়ে আবেদন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ নিয়ে ১৯ মে আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে শুনানির দিন নির্ধারণ করা হয়েছে।
গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্র্বর্তী সরকার নগদে প্রশাসক নিয়োগ দেয়। প্রশাসক বসানোর পর নিরীক্ষায় উঠে আসে, নগদ লিমিটেডে বড় ধরনের জালিয়াতি সংঘটিত হয়েছে। ভুয়া পরিবেশক ও এজেন্ট দেখিয়ে প্রতিষ্ঠানটিতে আর্থিক জালিয়াতি এবং অতিরিক্ত ইলেকট্রনিক অর্থ বা ই-মানি তৈরি করা হয়েছে। এসব কারণে ২ হাজার ৩৫৬ কোটি টাকার হিসাব মিলছে না। সাবেক সরকারের আমলে নিয়মের বাইরে গিয়ে গ্রাহক বানানো ও সরকারি ভাতা বিতরণসহ একচেটিয়া সুবিধা পায় নগদ।
প্রতিষ্ঠানটিতে যখন এসব অনিয়ম সংঘটিত হয়, তখন এর পরিচালনায় যুক্ত ছিলেন আওয়ামী লীগের একাধিক সংসদ সদস্য ও প্রভাবশালী ব্যক্তি। সবার চোখের সামনে এসব অনিয়ম হয়। এ ঘটনায় সরকারের ডাক বিভাগের আটজন সাবেক ও বর্তমান মহাপরিচালক (ডিজি), নগদের সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাসহ (সিইও) ২৪ জনকে আসামি করে মামলা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র বলেন, জনগণের টাকার নিরাপত্তা দেওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব। আগে প্রতিষ্ঠানটি যেনতেনভাবে চলেছে। এ জন্য সরকার পরিবর্তনের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক দায়িত্ব নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করে আসছিল। এখন আদালতের আদেশের কারণে সেই দায়িত্ব ছেড়ে দিতে হয়েছে। আমরা সেই আদেশ প্রত্যাহার চেয়ে আবেদন করেছি। আশা করি, জনগণের টাকার নিরাপত্তা দিতে বাংলাদেশ ব্যাংক আবার দায়িত্ব ফিরে পাবে।
ভোরের আকাশ/এসএইচ