তাকী মোহাম্মদ জোবায়ের
প্রকাশ : ২৪ জুন ২০২৫ ০৮:৫৭ এএম
ফাইল ছবি
গেল বছরে বাংলাদেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগে ভাটার টান লক্ষ্য করা গেছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ক্ষমতার পালাবদলের বছরটিতে প্রকৃত বিদেশি বিনিয়োগ বা নিট এফডিআই কমেছে প্রায় ১৩ শতাংশ। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থার (আন্কটাড) প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ইনভেস্টমেন্ট রিপোর্ট-২০২৫ থেকে এই তথ্য মিলেছে। এই রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালে বাংলাদেশে প্রকৃত এফডিআই এসেছে ১২৭ কোটি মার্কিন ডলার।
বাংলাদেশি মুদ্রার বর্তমান বিনিময় হারে নিট এফডিআই’র পরিমাণ প্রায় সাড়ে ১৫ হাজার কোটি টাকা। এই বিনিয়োগ প্রবাহ দেশের এক মাসের রেমিট্যান্স আয়ের অর্ধেকের কম। এর আগের বছর ২০২৩ সালে দেশে নিট এফডিআই ছিল ১৪৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার। এই হিসাবে গত বছর ১৯ কোটি ৪০ লাখ ডলার কম বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে।জতিসংঘের এই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের পাশাপাশি বিশ্ব ও দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের এফডিআই প্রবাহের সামগ্রিক পরিসংখ্যানও তুলে ধরা হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এফডিআইয়ের এই পতন অর্থনীতির জন্য দুশ্চিন্তার বিষয়। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও প্রতিবেশী ও প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় অনেক পিছিয়ে রয়েছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই বিনিয়োগের পতনের পেছনে রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক সংকট, বিনিয়োগ পরিবেশের অপ্রতুলতা এবং বৈদেশিক মুদ্রার অনিশ্চয়তা অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। শুধু তাই নয়, বৈশ্বিক অর্থনীতির বিভিন্ন দিক থেকে উদ্ভূত বৈশ্বিক অস্থিরতা ও বাণিজ্যযুদ্ধও এফডিআই প্রবাহে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বিদেশি বিনিয়োগের স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশের নীতি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার ধারাবাহিকতা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং ব্যবসায়িক পরিবেশের উন্নয়ন জরুরি। পাশাপাশি, সরকারের কর ব্যবস্থা, প্রণোদনা এবং বিনিয়োগকারীর সুরক্ষা নিশ্চিত করাও অপরিহার্য।
এ প্রসঙ্গে এফবিসিসিআই’র সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুল আউয়াল মিন্টু ভোরের আকাশ’কে বলেন, বিদেশি বিনিয়োগ আসবে কোথা থেকে? বর্তমানে দেশীয় বিনিয়োগইতো নেই।
দেশীয় বিনিয়োগ ছাড়া বিদেশি বিনিয়োগ আসবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দূর করে দ্রুত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক সরকারে উত্তরণের মাধ্যমে স্থিতিশীল পরিবেশ ফিরলেই দেশি-বিদেশি সব বিনিয়োগই বাড়বে।
জাতিসংঘের বাণিজ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪ সালের শেষে বাংলাদেশে মোট বিদেশি বিনিয়োগের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৮২৯ কোটি ডলার, যা দেশের মোট জিডিপির মাত্র ৪ শতাংশ। কিন্তু বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার গড় হার ১৩ শতাংশ।
দেখা গেছে, এক্ষেত্রে ভারতের হার ১৪ শতাংশ, ভুটানের হার ১৭ শতাংশ। গত বছর ভুটানে বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে প্রায় ৬ গুণ।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগের প্রতিশ্রুত অর্থের পরিমাণও ৩৫ শতাংশ কমেছে। এ খাতে ২০২৪ সালে ১৭৫ কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি রয়েছে, যা ২০২৩ সালে ছিল ২৭০ কোটি ডলার। এই হ্রাস ভবিষ্যতের বিনিয়োগ সম্ভাবনার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে আশঙ্কা বিশ্লেষকদের।
এক হিসাবে দেখা গেছে, গত বছরের নিট এফডিআইর পরিমাণ করোনাকালের থেকেও কম। ২০২০-২১ অর্থবছরেই করোনা মহামারির মাঝে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছিল ১৭৭ কোটি ডলার, যা ছিল তার আগের বছরের তুলনায় ৩৯ শতাংশ বেশি।
এর চেয়েও উল্লেখযোগ্য, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে নিট এফডিআই প্রবাহ ছিল ২৬৩ কোটি ডলার যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। সেই তুলনায় ২০২৪ সালের পরিস্থিতি যথেষ্ট হতাশাজনক বলে মত বিশেষজ্ঞদের।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) এফডিআই প্রবাহ কমেছে প্রায় ২৯ শতাংশ।
এ অবস্থায় অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য কেবল করছাড় বা সম্মেলন আয়োজন যথেষ্ট নয়, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও বিশ্বাসযোগ্য স্থায়ী নীতিকাঠামো নিশ্চিত করা জরুরি।
বিনিয়োগ কমার কারণ হিসেবে ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফআইসিসিআই) সভাপতি এবং ইউনিলিভার বাংলাদেশের চেয়ারম্যান জাভেদ আখতার বলেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগের পরিবেশ কখনোই খুব একটা সহায়ক ছিল না। আইনি অনিশ্চয়তা, নীতির ধারাবাহিকতা না থাকা এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বল সক্ষমতা বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করেছে। এর ওপর বিদ্যমান অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
তিনি বলেন, সরকারের সাম্প্রতিক কিছু সংস্কার কার্যক্রম ইতিবাচক হলেও বিনিয়োগ পরিবেশে দৃশ্যমান পরিবর্তন আনতে সময় লাগবে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও আইনের শাসন না ফিরলে কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ আশা করা কঠিন।
এদিকে বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, ২০২৪ সালে ১৭ শতাংশ ব্যবসায়ী দুর্নীতিকে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে উচ্চ করহার, অদক্ষ আমলাতন্ত্র, অর্থায়ন সংকট, মূল্যস্ফীতি এবং ডলারের অস্থিরতা ব্যবসার পরিবেশকে আরও নাজুক করে তুলেছে। সিপিডির মত হলো, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও নির্বাচনি শঙ্কা বিনিয়োগকারীদের জন্য বড় বাধা। স্বল্পমেয়াদি বিনিয়োগে রিটার্ন পাওয়া যায় না। তাই দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা ছাড়া বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকি নিতে চান না।
জানা গেছে, বিদেশি বিনিয়োগ টানতে সরকার নতুন করে কিছু করছাড়ের সুবিধা দিয়েছে। অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি আমদানির ক্ষেত্রেও করছাড়ের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগে গতি আনতে পাঁচ সদস্যের একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করেছে অন্তর্র্বর্তী সরকার। এতে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদকে আহ্বায়ক করা হয়েছে।
এ ছাড়া বিডা ও বেজার আয়োজনে ২০২৫ সালের এপ্রিলে আয়োজিত বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিটে ৫০টি দেশের ৪১৫ জন বিদেশি প্রতিনিধি অংশ নেন।
শুধু দেশে নয়, গত বছর বিদেশে বাংলাদেশিদের বিনিয়োগও কমেছে। ২০২৪ সালে বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা বিদেশে মাত্র ৭০ লাখ ডলার বিনিয়োগ করেছেন, যা আগের বছরের তুলনায় ৮ শতাংশ কম। বর্তমানে বৈধভাবে বিদেশে বাংলাদেশিদের মোট বিনিয়োগ দাঁড়িয়েছে ৩২ কোটি ২০ লাখ ডলার।
এদিকে ২০২৪ সালে বৈশ্বিক এফডিআই প্রবাহ ১১ শতাংশ কমে ১ লাখ ৩৭ হাজার কোটি ডলারে নেমেছে। আন্কটাড জানায়, বৈশ্বিক অস্থিরতা, বাণিজ্য দ্বন্দ্ব ও ভূ-রাজনৈতিক বিভাজন এই ধসের মূল কারণ।
প্রকাশিত হিসাব অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ায় মোট বিনিয়োগ প্রবাহ ৩ হাজার ৪৫৭ কোটি ডলার। এটি ২০২৩ সালের প্রায় সমান হলেও ভারতের এফডিআই সামান্য কমেছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের বাণিজ্য সংস্থাটি।
ভোরের আকাশ/এসএইচ