কমপক্ষে তিন বছর পেছানো যৌক্তিক বলছেন বিশেষজ্ঞরা
মো. রেজাউর রহিম
প্রকাশ : ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১২:১৮ পিএম
ফাইল ছবি
এখনই স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হলে রপ্তানি শুল্ক সুবিধা হারাবে বাংলাদেশ। আর এতে বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম স্তম্ভ রপ্তানি খাতে আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। একদিকে, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অতিরিক্ত শুল্কারোপের কারণে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি ১৪ শতাংশ কমে যাওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে, যার বেশির ভাগই তৈরি পোশাক। আর স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হলে রপ্তানির ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে এবং রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য বাড়তি প্রস্ততি ও সক্ষমতা বাড়ানোর ওপর বাংলাদেশকে বাড়তি জোর দিতে হবে বলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ একাধিক সূত্রে জানা গেছে। এ অবস্থায় প্রস্তুতি, সক্ষমতাসহ সবকিছু বিবেচনায় বাংলাদেশের এলডিসি উত্তরণ কমপক্ষে তিন বছর পেছানোই যৌক্তিক বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র্যাপিড) এর এক গবেষণায় বলা হয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের অতিরিক্ত রপ্তানির সুযোগ আর নেই। তবে বিকল্প হিসেবে ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি বৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে। বাড়তি মার্কিন শুল্কারোপের কারণে ছোট দেশগুলোর রপ্তানি খাত আরো বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। তবে বাংলাদেশের অবস্থা তুলনামূলক ভালো হতে পারে, কারণ ভারতসহ অনেক দেশের রপ্তানি পরিস্থিতি আরো খারাপ হওয়ার আশঙ্কা বেশি। বিভিন্ন দেশের ওপর অতিরিক্ত শুল্কারোপের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি ১৫ শতাংশ পর্যন্ত কমেও যেতে পারে।
এদিকে, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এলডিসি থেকে এত দ্রুত উত্তরণে বাংলাশেকে সতর্ক থাকতে থাকতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন। সম্প্রতি তারেক রহমান নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া এক পোস্টে এসব কথা বলেছেন তিনি।
তারেক রহমান বলেছেন, ২০২৬ সালের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশ জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বেরিয়ে আসতে যাচ্ছে। যা দেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হলেও এর সঙ্গে নানা ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জও রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।
তিনি বলেন, এই উত্তরণকে কেন্দ্র করে দেশের অর্থনীতি এবং সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে এখনই সদ্ভাবে কথা বলা দরকার। তিনি বলেন, ভারতে ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের কারণে আগামী এক বছরে যুক্তরাষ্ট্রে তাদের রপ্তানি প্রায় ৮০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। সামগ্রিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক আমদানি ১২ শতাংশ হ্রাস পাবে।
ফেসবুক পোস্টে তারেক রহমান আরো বলেন, এলডিসি থেকে উত্তরণের পথে আমাদের শ্রমিক, কৃষক ও তরুণদের ঝুঁকিতে ফেলে দেওয়া যাবে না। উত্তরণের সুফল যেন জনগণ ভোগ করতে পারেন, সে জন্য বাস্তবসম্মত, দৃশ্যমান অগ্রগতি ও সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।
তারেক রহমান বলেন, এলডিসি থেকে বেরিয়ে গেলে বাংলাদেশ বেশ কিছু আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক সুবিধা হারাবে। এতে তৈরি পোশাক খাতের ওপর প্রভাব পড়তে পারে। একই সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও ঋণের ওপর চাপ বাড়বে। ফলে স্বল্পসুদে বৈদেশিক ঋণ পাওয়া কঠিন হবে। পাশাপাশি আর্থিক সহায়তার পরিমাণও কমে যাওয়ার আশংকা রয়েছে।
তিনি আরো বলেন, এলডিসি দেশ হিসেবে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) থেকে প্রাপ্ত সুবিধাগুলো পাওয়া যায়, -যেমন- ভর্তুকির নমনীয়তা, ওষুধের পেটেন্ট সংক্রান্ত ছাড়ও আর প্রযোজ্য থাকবে না। ফলে ওষুধের দাম বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় এখনই প্রস্তুতি নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তারেক রহমান আরো বলেন, একটি মাত্র খাতে রপ্তানিনির্ভরতা ঝুঁকিপূর্ণ। তাই রপ্তানি বহুমুখীকরণ জরুরি, বিশেষ করে তথ্য-প্রযুক্তি, ওষুধ ও উচ্চমূল্য সংযোজনশীল শিল্পে।
তিনি বলেন, এলডিসি উত্তরণ যেন দেশকে ঋণের ফাঁদে না ফেলে বা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে না দেয়-তা এখনই নিশ্চিত করতে হবে।
এ ব্যাপারে বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান বলেন, স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণ সরকার তিন বছর পিছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। তবে এতে আশাবাদী হওয়ার সুযোগ কম। কারণ ভারত, যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাষ্ট্রও এই প্রস্তাবের তুমুল বিরোধিতা করছে।
তিনি বলেন, আমরা সম্প্রতি বিদেশি একটি টিমের সঙ্গে উত্তরণ পিছিয়ে দেওয়ার বিষয়টি আলোচনা করেছি। তবে বিষয়টি ধীরগতিতে এগোচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আশাবাদী হওয়ার সুযোগ কম, কারণ এই প্রস্তাব জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে তুলতে হবে এবং ভোটে পাস করতে হবে।
তিনি আরো জানান, সূচকে ভালো অবস্থানে থাকায় বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশগুলো বাংলাদেশ বাড়তি সময় পাক তা চাইছে না। প্রতিযোগী দেশগুলোর মধ্যে বন্ধুরাষ্ট্র- বিশেষ করে জাপান, তুরস্ক, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র এর প্রবল বিরোধিতা করছে।
তিনি জানান, বাংলাদেশ এসব দেশ থেকেই টেকনিক্যাল সহায়তা নিচ্ছে, যেন তারা সরাসরি বিরোধিতা না করে।
এলডিসি থেকে উত্তরণ তিন বছর পিছিয়ে দিতে পারলে তা দেশের অর্থনীতি ও রপ্তনির জন্য ইতিবাচক হবে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ ২০১৮ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণের প্রক্রিয়া শুরু করে। আর ২০২৪ সালে এ সংক্রান্ত প্রস্তুতি শেষ হওয়ার কথা থাকলেও কোরোনা মহামারির কারণে বাংলাদেশ বাড়তি দুই বছর সময় পেয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে এলডিসি তালিকা থেকে বেরিয়ে যাবে বাংলাদেশ। তবে সার্বিক অবস্থায় রপ্তানি বাজারে স্বল্প হারের শুল্ক সুবিধা হারালে বাংলাদেশ তার রপ্তানি খাতের ধারাবাহিকতা বজায় এবং রপ্তানি খাতের আয় বাড়াতে পারবে কি-না, এ বিষয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা চলছে।
র্যাপিড চেয়ারম্যান ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, পাল্টা শুল্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাকের আমদানি ১০ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত কমতে পারে।
তবে এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের খুব বেশি রপ্তানি বৃদ্ধির সুযোগ নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভারতের রপ্তানি পণ্যে আমেরিকার ৫০ শতাংশ শুল্করোপের কারণে আগামী এক বছরে যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের রপ্তানি প্রায় ৮০ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে। আর এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশের জোরালো পদক্ষেপ প্রয়োজন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের ওপর আমেরিকার বাড়তি শুল্কারোপের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের রপ্তানি ধারাবহিকতা বজায় রাখতে এবং রপ্তানি বৃদ্ধিও জন্য বাড়তি প্রস্তুতি এবং রপ্তনি সক্ষমতা বাড়াতে হবে বাংলাশেকে। এজন্য জোরালো কুটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি, নতুন বাজার সম্প্রসারণ, বিভিন্ন দেশের সাথে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদন, তৈরী পোশাক রপ্তানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে পণ্য বহুমুখীকরণ পণ্যের মানোন্নয়নের ওপর বাংলাদেশকে বাড়তি জোর দিতে হবে।
উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বড় রপ্তানিকারদের একটি অন্যতম প্রধান দেশ হচ্ছে ভারত। পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনও এলডিসিবুক্ত সুবিধার আওতায় বিভিন্ন দেশের বাজারে শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার পাচ্ছে। কিন্তু ২০২৬ সালের পর এসব সুবিধা আর বহাল থাকবে না। এ কারণে রপ্তানি খাতের ব্যবসায়ীরাও এলডিসি উত্তরণ পিছিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছেন। গত আগষ্ট মাসের ২৬ তারিখে দেশের শীর্ষ ১৬টি বাণিজ্য সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এক সংবাদ সম্মেলন করে এলডিসি উত্তরণ তিন থেকে ছয় বছর পিছিয়ে দেওয়ারও আহবান জানান। তবে সার্বিক অবস্থায়, মাথাপিছু গড় আয়, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও জলবায়ু-অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা এই তিন সূচকেই বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে থাকায় এলডিসি উত্তরণ পেছানোর সম্ভাবনা বেশ কম বলে জানা গেছে।
ভোরের আকাশ/এসএইচ