ভোরের আকাশ প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২৭ মে ২০২৫ ০৭:১০ পিএম
দাম কমবে এলএনজির
আসন্ন বাজেটে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজি আমদানিতে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) অব্যাহতি দেওয়ার চিন্তা করছে সরকার। এতে শিল্পের এই গ্যাসের দাম কমে আসতে পারে। পাশাপাশি আগামী বাজেটে প্লাস্টিকের তৈরি আসবাবপত্র, তৈজসপত্রসহ এসি ও ফ্রিজের ভ্যাট হার দ্বিগুণ করা হচ্ছে। এতে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে এসব পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। বর্তমানে এলএনজি আমদানির সময় ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও ২ শতাংশ অগ্রিম কর দিতে হয়। আবার গ্রাহক পর্যায়ে বিক্রির সময় ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও ২ শতাংশ উৎসে কর দিতে হয়।
এছাড়া বাইরেও এলএনজি মার্জিনের বিল পরিশোধের সময় গ্যাস বিতরণ সংস্থার কাছ থেকে ৫ শতাংশ উৎসে কর কাটা হয়। অন্যান্য কর ঠিক রেখে ভ্যাট বাদ দেওয়া হবে। পাশাপাশি প্লাস্টিকের তৈরি আসবাবপত্র, তৈজসপত্রসহ এসি ও ফ্রিজে সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট রয়েছে, যা বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হবে।বর্তমানে শিল্প-কারখানায় তীব্র গ্যাস সংকট বিরাজ করছে।
জানা গেছে, বেশি অর্থ খরচ করেও উদ্যোক্তারা চাহিদামাফিক গ্যাস পাচ্ছেন না। তারা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ও বৈঠকে বলেছেন, এভাবে চলতে থাকলে ঈদের বেতন-বোনাস পরিশোধ করা কঠিন হবে। অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। কলকারখানার এই অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে সরকার ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে বিদ্যুৎ, শিল্পের উৎপাদন ও পরিবহন খাতে ব্যয় কমতে পারে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মোট গ্যাস সরবরাহের ২৫ শতাংশই এলএনজি থেকে সরবরাহ করতে হয়। এলএনজি দিয়ে দেশের শিল্পকারখানা ও বাসাবাড়ির গ্যাস-বিদ্যুৎ, গাড়ির গ্যাসের কিছু অংশের জোগান হয়। এছাড়া কয়লার ব্যবহার কমানোর ক্ষেত্রেও এই গ্যাস একটি বিকল্প।
পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে গ্যাসের চাহিদা রয়েছে প্রায় ৪ হাজার ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট। গত ২৫ মে মোট গ্যাস সরবরাহ করা হয় ২ হাজার ৬৩৯ মিলিয়ন ঘনফুট। ঘাটতি ছিল দেড় হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি। মোট দুই হাজার ৬৩৯ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের মধ্যে আমদানিকৃত এলএনজি থেকে ৭৮১ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়। এলএনজির ওপর দুইবার ভ্যাট আরোপ করা আছে।এর সঙ্গে অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট বাদ দেওয়া হলে এলএনজির দাম অন্তত ২০ শতাংশ কমে যাবে। যার সরাসরি সুবিধা পাবে সাধারণ মানুষ। এর বাইরে আরও সাত শতাংশ অগ্রিম কর আরোপিত আছে। এদিকে ২০২৬-২০২৭ ও ২০২৭-২০২৮ পর্যন্ত সম্ভাব্য করহার ঘোষণা অব্যাহত রাখা হতে পারে। এর ফলে করদাতা ও ব্যবসায়ীরা করবর্ষ শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা না করে সম্ভাব্য করের হার আগেভাগেই জানতে পারবেন।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট থেকে এই চর্চা শুরু হয়েছে। বিনিয়োগ ও কর আদায়ে সরকার ক্রমান্বয়ে প্রোসপেকটিভ বা সম্ভাব্য আগাম কর ব্যবস্থার দিকে যাচ্ছে এনবিআর। বর্তমানে রেট্রোস্পেকটিভ বা পশ্চাদমুখী ব্যবস্থায় এনবিআর করপোরেট প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের জন্য কর হার ঘোষণা করে একটি কর বছর শেষ হওয়ার পর। এই ব্যবস্থায় করদাতারা চলতি কর বছরের ভিত্তিতে তাদের সম্পদ ও আয় বিবরণী দাখিল করতেন এবং পরবর্তী অর্থবছরে নতুন কর হার ঘোষণার পর কর পরিশোধ করতেন। পুরাতন কর বর্ষে কর পরিশোধ হতো নতুন কর বর্ষে নেওয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বা হার অনুযায়ী। নতুন সম্ভাব্য ব্যবস্থার ফলে ব্যক্তি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো করবর্ষের জন্য তাদের কর আগেই জেনে নিতে পারে এবং একই করবর্ষ শেষে তা দিতে পারে।
এর আগে ধারাবাহিক প্রাক-বাজেট আলোচনার এক অনুষ্ঠানে এমন ব্যবস্থা রাখার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান। বিনিয়োগকারী ও কর বিশ্লেষকরা রাজস্ব বোর্ডের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। তারা বলছেন, এর ফলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়াবে।
দ্বিগুণ হচ্ছে প্লাস্টিক পণ্য-এসি-ফ্রিজের ভ্যাট: আগামী অর্থবছরের বাজেটে প্লাস্টিকের তৈরি আসবাবপত্র, তৈজসপত্রসহ সব ধরনের পণ্যে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট দ্বিগুণ করতে যাচ্ছে সরকার। একইভাবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র (এসি) ও ফ্রিজের ভ্যাট হার দ্বিগুণ করা হচ্ছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভ্যাট বাড়লে পণ্যের দাম বাড়বে। এতে বিক্রি কমে যাবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের অর্থনীতি। অন্যদিকে মাটি ও পাতার তৈরি তৈজসপত্রে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হবে। এসব পণ্যে ১৫ শতাংশ ভ্যাট রয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বর্তমানে বাংলাদেশে প্লাস্টিক পণ্যের অভ্যন্তরীণ বাজার প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ চাহিদা প্রায় শতভাগ পূরণ করতে পারছে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো। প্লাস্টিক খাতের বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে আরএফএল, গাজী, বেঙ্গল, ওয়ালটন, আকিজ, তানিন ইত্যাদি। অন্যদিকে ওয়ালমার্ট, টেসকো, জারার মতো আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলো বর্তমানে বাংলাদেশি প্লাস্টিক পণ্যের আন্তর্জাতিক ক্রেতা।
সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশ থেকে ১০ কোটি ৭৩ লাখ ডলারের প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানি হয়। প্লাস্টিক শিল্পের সঙ্গে জড়িত পাঁচ হাজার প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অধিকাংশই ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠান, যেখানে কর্মসংস্থান হচ্ছে ১৫ লাখ মানুষের।
ভ্যাট বাড়ানোর কারণ সম্পর্কে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনবিআরের এক কর্মকর্তা বলেন, এই শিল্পগুলো ভালো করছে। দেশীয় পণ্য সবার ঘরে ঘরে। আমদানি নির্ভরতা দূর হয়েছে। এসব খাতে আর ভ্যাট সুবিধার প্রয়োজন নেই।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দেশীয় ফ্রিজ ও এসির উৎপাদকেরা কারখানা থেকে সরবরাহ পর্যায়ে এই ভ্যাট দেন। এই হার ১৫ শতাংশ করা হলে ভ্যাট রেয়াত নিতে পারবেন। ফ্রিজ ও এসির উপকরণ বা যন্ত্রাংশ সাধারণত প্রতিষ্ঠিত সরবরাহব্যবস্থা বা প্রতিষ্ঠান থেকে কেনা হয়।
চলতি বছরের শুরুতে এসি ও ফ্রিজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের আয়কর দ্বিগুণ করে সরকার। ২০০৯ সাল থেকে ইলেকট্রনিকস শিল্পের করে ছাড় দিয়েছে সরকার। এসব শিল্পের করপোরেট কর, কাঁচামাল আমদানিতে অগ্রিম আয়কর এবং উৎপাদন ও সরবরাহ পর্যায়ে কর ছাড় দেওয়ায় দেশে এক ডজনের বেশি শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এসব শিল্প ২০২১ সাল থেকে যন্ত্রপাতি আমদানিতে ২ শতাংশ এআইটি এবং আয়ের ওপর ১০ শতাংশ কর দেওয়ার সুবিধা পেয়ে আসছিল। এসব সুবিধা ২০৩২ সাল পর্যন্ত বলবৎ থাকার কথা ছিল। তবে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে ফ্রিজার, রেফ্রিজারেটর, এয়ারকন্ডিশনার ও কম্প্রেসারে করপোরেট কর ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এখন এসির বাজারের দুই-তৃতীয়াংশই দেশীয় ব্র্যান্ডগুলোর দখলে। বর্তমানে বছরে গড়ে সাত লাখ এসি বিক্রি হয়। দ্রুত এ খাতের চাহিদা বাড়ছে। অন্যদিকে ফ্রিজের বাজারেও দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর শক্তিশালী অবস্থান আছে। প্রতি বছর গড়ে ২০ থেকে ২৫ লাখ ফ্রিজ বিক্রি হয়।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, সুপারি, হোগলা পাতা ও মাটির তৈরি তৈজসপত্রের ভ্যাট অব্যাহতির সিদ্ধান্ত নিতে পারে সরকার। ভোক্তাপর্যায়ে এসব পণ্যে ১৫ শতাংশ ভ্যাট রয়েছে। একটা সময় এসব শিশুদের খেলনা হিসেবে ও হাত পাখা বানাতে ব্যবহার হলেও এখন সুপারির খোল দিয়ে তৈরি হচ্ছে পরিবেশবান্ধব প্লেট, চামচ, ট্রে, শো পিসসহ একাধিক পণ্য। এসব পণ্য নিয়ে কাজ করছেন শতাধিক উদ্যোক্তা।
ভোরের আকাশ/এসএইচ