মিলবে দুই কিস্তির ১৩০ কোটি ডলার
তাকী মোহাম্মদ জোবায়ের
প্রকাশ : ১৫ জুন ২০২৫ ০৯:৩২ এএম
ছবি: সংগৃহীত
চূড়ান্ত হয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নির্বাহী পরিষদের বৈঠকের তারিখ। আগামী ২৩ জুনের ওই বৈঠকে বাংলাদেশের জন্য ঋণের চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ ছাড়ের বিষয়টি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে। ধারনা করা হচ্ছে, বৈঠকে প্রস্তাবটি অনুমোদিত হবে এবং জুনের মধ্যেই বাংলাদেশ পেয়ে যাবে এই দুই কিস্তির মোট ১৩০ কোটি ডলার।
আইএমএফ ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বৈঠকের সূচি অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে সংস্থার সদর দপ্তরে এই আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে। এতে বাংলাদেশের জন্য অনুমোদিত সাত কিস্তির ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ কর্মসূচির আওতায় চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির মূল্যায়ন প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হবে।
এর আগে তিন কিস্তিতে বাংলাদেশ পেয়েছে ২৩১ কোটি ডলার। চতুর্থ কিস্তির অর্থ গত বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে ছাড় হওয়ার কথা থাকলেও নির্ধারিত কিছু শর্ত পূরণ না হওয়ায় তা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে কয়েক দফা আলোচনা শেষে ১২ মে আইএমএফ ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে একটি সমঝোতা হয়। এরপর ১৪ মে আইএমএফ এক বিবৃতিতে জানায়, এই সমঝোতার ভিত্তিতেই দুই কিস্তির অর্থ জুন মাসে একসঙ্গে ছাড় করা হবে।
এই অর্থ ছাড়ের অন্যতম প্রধান শর্ত ছিল বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া। অর্থাৎ, মুদ্রা বিনিময় হার কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেঁধে দিতে পারবে না। বাংলাদেশ ব্যাংক এরই মধ্যে সেই পদক্ষেপ নিয়েছে। যদিও এর ফলে ডলারের দাম কিছুটা বেড়েছে, তবে বাজারে বড় ধরনের অস্থিরতা দেখা যায়নি।
অন্যদিকে, রাজস্ব আয় বাড়াতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) নেওয়া হয়েছে কাঠামোগত সংস্কার উদ্যোগ। ভর্তুকি হ্রাসের বিষয়েও সরকার কিছুটা অগ্রগতি দেখিয়েছে। ব্যাংক খাতেও দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে এবং সেগুলো আইএমএফকে জানানো হয়েছে। আইএমএফের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত ছিল বিদ্যুৎ খাতে মূল্য সমন্বয়।
যদিও মূল্যস্ফীতির বর্তমান প্রবণতা বিবেচনায় নিয়ে বাজেট বক্তৃতায় অর্থ উপদেষ্টা জানিয়েছেন, আপাতত বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হবে না। একই সঙ্গে সংস্থাটি চায়, মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে না আসা পর্যন্ত কঠোর মুদ্রানীতি বজায় রাখা হোক। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সেপ্টেম্বরের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য রয়েছে। এই লক্ষ্য অর্জিত হলে সুদের হার হ্রাসের সম্ভাবনাও রয়েছে।
নানা নাটকীয়তা শেষে নিশ্চিত হয় দুই কিস্তি : নানা নাটকীয়তা শেষে চলমান ঋণ প্রকল্পের এই দুই কিস্তির অর্থ পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। রিজার্ভ কমে যাওয়ার প্রেক্ষিতে বৈদেশিক দেনার চাপ সামাল দিতে ২০২২ সালে আইএমএফের দারস্থ হয় বাংলাদেশ। ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ অনুমোদন করে আইএমএফের পরিচালনা পর্ষদ। ২০২৬ সাল পর্যন্ত সাত কিস্তিতে এই ঋণ দেওয়ার কথা। যথাসময়ে প্রথম তিন কিস্তির ২৩১ কোটি ডলার ঋণ পায় বাংলাদেশ।
সর্বশেষ কিস্তি পায় ২০২৪ সালের জুনে। চতুর্থ কিস্তি পাওয়ার কথা ছিল ডিসেম্বরে। কিন্তু নানা শর্তে সেই ঋণ আটকে যায়। পরে আইএমএফের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, বাংলাদেশ শর্ত পূরণ করলে চলতি বছরের মার্চে ঋণের চতুর্থ কিস্তি পাবে। কিন্তু আলোচনা ফলপ্রসূ না হওয়ায় ঘোষণা আসে, চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি একত্রে চলতি বছরের জুনে দেওয়া হবে।
এ নিয়ে আলোচনার জন্য এপ্রিল মাসে বাংলাদেশে আসে আইএমএফ মিশন। ওই সময়ে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা ফলপ্রসু না হওয়ায়, বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের বসন্তকালীন বৈঠকের অবসরে আবারও আলোচনা হওয়ার ঘোষণা দিয়ে বাংলাদেশ ছাড়ে সংস্থাটির প্রতিনিধি দল। ২১ থেকে ২৬ এপ্রিল ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের বৈঠকের অবসরে আইএমএফ কর্মকর্তাদের সঙ্গে দুই দফায় আলোচনার টেবিলে বসেন অর্থ উপদেষ্টা ও গভর্নর সহ উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল।
ওই আলোচনায় দুই পক্ষ ঐকমত্যে পৌঁছাতে না পারায় বাংলাদেশে ফিরে পৃথক বক্তব্যে অর্থ উপদেষ্ট ও গভর্নর বলেছেন, শর্ত মেনে আইএমএফের ঋণ নিতেই হবে এমন অবস্থানে নেই বাংলাদেশের অর্থনীতি। এই পরিস্থিতিতে আইএমএফের আগ্রহে গত ৫ ও ৬ মে দুই দিন ভার্চুয়াল মিটিংয়ে বসে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা। ওই মিটিংয়েই সমঝোতায় পৌঁছায় দুই পক্ষ। বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে বাজারমুখী করে মার্কিন ডলারের বিনিময় হার। বিপরীতে ঋণের দুই কিস্তি ছাড়ে সম্মত হয় মুদ্রা তহবিল।
এই সমঝোহায় পৌঁছানোর পর বাংলাদেশ ব্যাংক একটি সংবাদ সম্মেলন ডেকে জানিয়েছিল, বিনিময় হার নির্ধারণের নতুন এই পদ্ধতিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে স্বাধীনভাবে ডলার লেনদেনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি নির্দিষ্ট ঊর্ধ্ব ও নিম্ন সীমা বজায় রাখবে, যা বাজার পর্যবেক্ষণ কৌশলের অংশ হিসেবে প্রকাশ করা হবে না। পাশাপাশি বাজারে হস্তক্ষেপ করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ৫০ কোটি ডলারের একটি তহবিল ব্যবহার করবে। প্রয়োজনে তহবিলের আকার আরও বড় হবে।
বিনিময় হার নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করার উপক্রম হলে ওই তহবিল থেকে ডলার বিক্রি করে বাজারে হস্তক্ষেপ করা হবে। আইএমএফ কিস্তি ছাড়ে রাজি হওয়ায় বিশ্ব ব্যাংক, এডিবি, জাইকা সহ বৈশ্বিক ঋণদাতা ও উন্নয়ন সংস্থাগুলো থেকে ৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণ সহায়তার আশ্বাস পেয়েছে বাংলাদেশ যা জুনের মধ্যেই ছাড় হবে।
ভোরের আকাশ/এসএইচ