মাথায় কিস্তির বোঝা
মো. নুর উদ্দিন, পিরোজপুর প্রতিনিধি
প্রকাশ : ২৭ জুন ২০২৫ ১২:৪৪ পিএম
হাতে ইনহেলার নিয়েই বাদাম বিক্রি করে চলে শাহিনের সংসার
এক হাতে ইনহেলার আর অন্য হাতে বাদাম ভাজার কড়াই নিয়ে শহরের বড় মসজিদ মোড়ে বাদাম বিক্রি করছেন ৬৫ বছরের বৃদ্ধ মোঃ শাহিন আকন। বয়সের ভারে শারীরিক অসুস্থতা এখন তার নিত্যসঙ্গী। বয়স আর অসুস্থতার বাধাকে পাশ কাটিয়ে প্রায় প্রতিদিনই সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে বাদাম বিক্রি করতে হয় তাকে। ২৪ বছর ধরে এখানেই বাদাম বিক্রি করেন তিনি। সপ্তাহ শেষে দিতে হবে ৩ হাজার টাকা কিস্তি তাই অসুস্থতা নিয়ে প্রতিদিনই করতে হয় কাজ।
শাহিন আকনের বাড়ি পিরোজপুর পৌর শহরের উত্তর নামাজপুর গ্রামে। এক ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে সকলকেই বিয়ে দিয়েছেন। ছেলে বিয়ে করে স্ত্রী সন্তান নিয়ে ঘরের পাশেই থাকেন। এখন স্ত্রীকে নিয়ে তাদের দুইজনের সংসার। ২০০০ সাল থেকে পৌর শহরের বড় মসজিদ মোড় এলাকায় সড়কের পাশে ভ্যান গাড়িতে করে বাদাম ভেজে বিক্রি করেন তিনি।
বৃহস্পতিবার (২৬ মার্চ) সন্ধ্যায় শহরের বড় মসজিদ মোড়ে তার বাদাম বিক্রির ভ্যানগাড়ির পাশে দাড়িয়ে কথা হয় শাহিন আকনের সঙ্গে। উঠে আসে তার কষ্ট, জীবন সংগ্রাম ও সমস্যার কথা।
এসময় দৈনিক ভোরের আকাশকে তিনি বলেন, নিজের এক কাঠা জমির উপরে ধার দেনা করে একটি ঘর তুলেছিলেন। ঘুর্নিঝড় রেমালে তার ঘরটি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। পাননি কোন সরকারি, বেসরকারি সাহায্য ফলে দুটি এনজিও প্রতিষ্ঠান থেকে ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ঘর ঠিক করেন। এখন সেই ঋণের বোঝা তার জন্য অভিশাপ হয়ে দাড়িয়েছে। সপ্তাহে গুনতে হয় ৩ হাজার টাকার কিস্তি। এক ছেলে রিকশা চালিয়ে তার সংসারের খরচ কোনরকমে চলে। ফলে বাদাম বিক্রি করে মাঝে মধ্যে সন্তানের সংসারের খরচও বহন করতে হয় শাহিনকে। এখন বর্ষাকাল এই সময় বেচা বিক্রিও কম যেটুকু হয় তাই দিয়ে সংসার চলে এখন।
কথার ফাঁকে শাহিনের কাছে বাদাম চাইলেন এক ক্রেতা। এ সময় একটি কাঠের চুলায় আগুনে ফুটতে থাকা কালচে বালুতে কাঁচা বাদাম ছেড়ে দিলেন তিনি। এরপর পরম যত্ন আর দারুণ কৌশলে বাদামগুলো ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ভেজে নিলেন। সবশেষে গরম-গরম বাদামগুলো একটি ছোট ঠোঙায় ভরে তুলে দিলেন ক্রেতার হাতে। বিনিময়ে ১০ টাকা পেলেন শাহিন।
শাহিন আকন বলেন, প্রতিটি ছোট প্যাকেটে ১০ টাকা ও বড় প্যাকেটে ২০ টাকা এবং ১০০ গ্রামের প্যাকেট ৩০ টাকায় খুচরা বাদাম বিক্রি করেন তিনি। উপজেলা সদর বাজার থেকে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা কেজিদরে বাদাম কিনে সেগুলো ভেজে বিক্রি করেন গড়ে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকায়। স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত সময়ে গড়ে ৮ কেজি বাদাম বিক্রি করেন তিনি। প্রতি কেজি বাদাম বিক্রি করে লাভ হয় ৫০ থেকে ৬০ টাকা। সেই হিসেবে প্রতিদিনই গড়ে ৪০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা তার লাভ হয়। এর মধ্যে বাকি ও বকেয়াও থাকে। আবহাওয়া খারাপ থাকলে, বৃষ্টিবাদল হলে কিংবা শরীর খারাপ হলে ওই দিন আর বাদাম বিক্রি করেন না। এই বর্ষাকালে সাধারণত বিক্রি কিছুটা কম তবে বিক্রি হয়। বড় মসজিদের সামনে নামাজের মুসল্লীরা বেশি কিনে খান।
এখন প্রায়ই অসুস্থতায় ভোগেন শাহিন আকন। শ্বাসকষ্ট কমাতে ওষুধের সূক্ষ্ম কুয়াশা ভরা ইনহেলার তার নিত্য সঙ্গী। কাজ করলে শরীর ক্লান্ত ও দুর্বল লাগে। তাই এখন বেশি কাজ করতে পারেন না। প্রতি মাসে গড়ে ৮ থেকে ৯ হাজার টাকা আয় করেন শাহিন আকন। এ টাকায় ওষুধপত্র কেনার পরে পরিবারের ভরণপোষণ ও অন্যান্য খরচ চালাতে হয়। বাজারে নিত্যপণ্যের দাম চড়া থাকায় এ টাকায় সংসার চালাতে খুব কষ্ট হয়। প্রায়ই ধারকর্জ করতে হয়। তার ভাষায়, কিস্তির বোঝা মাথায় লইয়া সংসার চালাইতে হয়। বাদাম বেইচ্চা যা হয়, তাতে সংসার চলে না।
মো. গফ্ফার নামের এক ক্রেতা বলেন, ১৫ থেকে ২০ বছর ধরে এখানেই শাহিন আকনের বাদাম পাওয়া যায়। এখান থেকে বাদাম কিনে খাই। বেশ কয়েক বছর ধরে শাহিন অসুস্থতায় ভুগছেন। বাদাম বিক্রি করে নিজের চিকিৎসার খরচ চালিয়ে সংসার চালানো তার জন্য এখন অভিশাপ হয়ে দাড়িয়েছে। সমাজের বিত্তবানরা যদি তার জন্য এগিয়ে আসে তাহলে হয়তো শাহিন নিজের সঠিক চিকিৎসা করিয়ে একটি সুস্থ জীবন পাবে।
জুবায়ের আল মামুন নামে এক ক্রেতা বলেন, শাহিন চাচার এক হাতে বাদাম ভাজার কড়াই আর অন্য হাতে সবসময় একটি ইনহেলার থাকে। তিনি এখন খুব অসুস্থ, তার চিকিৎসার প্রয়োজন।
ভোরের আকাশ/জাআ