× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

প্রাকৃতিক দূর্যোগে ভয় পায়না গাইবান্ধা যমুনা-ব্রহ্মপুত্র পাড়ের মানুষ

রিফাতুন্নবী রিফাত, গাইবান্ধা প্রতিনিধি

প্রকাশ : ১৬ জুন ২০২৫ ০৬:১৭ পিএম

প্রাকৃতিক দূর্যোগে ভয় পায়না গাইবান্ধা যমুনা-ব্রহ্মপুত্র পাড়ের মানুষ

প্রাকৃতিক দূর্যোগে ভয় পায়না গাইবান্ধা যমুনা-ব্রহ্মপুত্র পাড়ের মানুষ

কয়দিন আগে সাতোয়া (সাতদিন ব্যাপী বৃষ্টি) নাগচিলো। সাতোয়ায় সিদ্ধ ধান টানাটানি করতে করতে ধান গুল্যা প্রায় নষ্ট। খড় গুল্যায় অর্ধেক পচে গেছে। বাড়ির উঠানে পঁচা খড় উল্টাতে উল্টাতে এসব কথা বলছিলেন গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার ঘুড়িদহ ইউনিয়নের চিনিরপটল পাকারমাথা এলাকার বাসিন্দা লতিফা বেগম।

এবার ভয়েস কল আসলে হামার (আমার) এই ক্ষতি হলো না হয়- যোগ করেন লতিফা। ভয়েস কল কি- জানতে চাইলে তিনি বলেন- আগে মাসে মাসে মোবাইলে ভয়েস কল আসতো। ভয়েস কলে বন্যা, খড়া, বৃষ্টি, আবহাওয়ার আগাম খবর দিতো। জমিতে কখন কোন সার, কি বীজ দিতে হবে সব বলে দিতো। এতে আমাদের অনেক উপকার হতো।

লতিফার মতো উত্তরের জনপদ গাইবান্ধার সাঘাটা ও ফুলছড়ি এ দুই উপজেলার অসংখ্য মানুষ ভয়েস কলের উপকার পেয়েছেন। কেননা, গাইবান্ধার সাতটি উপজেলার মধ্যে চারটি যমুনা-ব্রহ্মপুত্র ‍ও তিস্তা নদীর অববাহিকায় অবস্থিত। বিশেষ করে সাঘাটা ও ফুলছড়ি দুই উপজেলা বেশী দূর্যোগ প্রবণ।

সাঘাটা ও ফুলছড়ি উপজেলার মানুষ অকাল কিংবা প্রলম্বিত বন্যা-খড়া, অনাবৃষ্টি, নদীভাঙ্গনসহ নানা রকম প্রাকৃতিক দূর্যোগ তাদের নিত্যসঙ্গী। তারপরও প্রাকৃতিক দূর্যোগ সম্পর্কে তাদের মধ্যে তেমন কোন ধারণা ছিল না। মূলত: অনুমানের ওপর ভর করে যেমন- পিঁপড়ার সারি দেখে বৃষ্টি, উত্তুরে কিংবা দখিনা বাতাসে বন্যার কমা-বাড়তি অনুমান করতো তারা।

এখন অনুমানের সেই দিন আর নেই। সাঘাটার খামার পবনতাইড় বালুবাড়ি গ্রামের রুমি বেগম, চিনিরপটল ঝোলাপাড়ার পুতুল রানী, মাঝিপাড়ার সোনালী রানী, খামার পবনতাইড় পালপাড়ার শিরিনা বেগমের মতো অনেকেই এখন প্রাকৃতিক দূর্যোগ সম্পর্কে শুধু সচেতন নয়। কোন দূর্যোগের আগে কিংবা পরে কি করতে হবে সবই এখন তাদের জানা। আর তারা এসব সম্পর্কে বিস্তারিত জেনেছেন গাইবান্ধার বেসরকারী সংগঠন এসকেএস ফাউন্ডেশন বাস্তবায়িত প্রকল্প সুফলের কল্যাণে।

চিনিরপটল ঝোলাপাড়ার পুতুল রানী বলেন, প্রাকৃতিক দূর্যোগ সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য গ্রামে গ্রামে ২০ থেকে ২২ জন নারী-পুরুষ নিয়ে এসকেএস ফাউন্ডেশন থেকে গ্রুপ তৈরি করা হয়। তারপর উঠান বৈঠক, আলোচনা, সভা, সেমিনার, হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ নিয়ে আমরা গ্রামের অনেক নিরক্ষর মানুষ প্রাকৃতিক দূর্যোগ সম্পর্কে সচেতন হই।

এরপর গ্রামের প্রতিটি গ্রুপের সদস্যের কাছে সুফল প্রকল্পের মাধ্যমে আসতে শুরু করে ভয়েস কল। ভয়েস কলে জানানো হয় বন্যার আগাম বার্তা। সেই বার্তা পেয়ে আশেপাশের মানুষকে মাইকে ঘোষণার মাধ্যমে বার্তা পৌঁছে দেয়ার উদ্যোগ নেয় স্ব স্ব এলাকার গ্রুপের সদস্যরা।

বার্তা পাওয়ার পরপরই শুরু হয় নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুতির কাজ। নারী, পুরুষ ও কিশোরীদের জন্য তৈরি হয় আলাদা আলাদা থাকার জায়গা। যেখানে শিশু, বয়স্ক, গর্ভবতী ও প্রতিবন্ধীদের জন্য রাখা হয় বিশেষ ব্যবস্থা। এলাকা থেকে আশ্রয়কেন্দ্রে যাবার রাস্তা সংস্কার, আশ্রয়কেন্দ্রে সুপেয় পানি, পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা এবং গবাদী পশু রাখার জন্য নির্মাণ করা হয় অস্থায়ী শেড। আবার বন্যা পরবর্তী সময়ে ঘড়বাড়ি মেরামত, জীবানুমুক্ত করার কাজে ঝাপিয়ে পড়েন তারা। কথাগুলো বলছিলেন, পালপাড়ার শিরিনা বেগম।

বন্যা পূর্বাভাস বা ভয়েস কল পাওয়ার আগে অর্থাৎ বর্ষা আসার আগেই আলগা চুলা তৈরি করা, শুকনো খাবার সংরক্ষণ, কাপড়, গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র সংরক্ষণের ব্যাপারে সচেতন করা হয় গ্রামের মানুষকে। বন্যা-ভাঙ্গনের মতো নিদানকালের জন্য টাকা জমানোর ব্যাপারেও সজাগ করা হয় তাদের। নদ-নদী তীরবর্তী এসব এলাকার মানুষের একমাত্র সম্বল গবাদী পশু। বিশেষ করে বন্যার সময় গোখাদ্য নিয়ে চরম বিপাকে পড়তে হয় তাদের। মাঠ-ঘাট তলিয়ে যাওয়ায় প্রাকৃতিক খাবারের সব উৎস হারিয়ে টাকা দিয়ে গোখাদ্য কেনার সামর্থ থাকেনা তাদের। সেজন্য প্রতিটি গ্রুপের সদস্যকে হাতে কলমে গোখাদ্য তৈরি ও সংরক্ষনের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।

শুধু বন্যার সময় নয়, মাঝে মধ্যেই সুফল প্রকল্প থেকে ভয়েস কল আসতো গ্রুপের সদস্যদের কাছে। আসতো আবহাওয়ার খবর। যেমন জমিতে কোন আবহাওয়ায় সেচ, কীটনাশক বা সার প্রয়োগ করা যাবে আর কখন প্রয়োগ করা যাবে না- সে সম্পর্কে আগাম খবর আসতো ভয়েস কলে। সারের পাশাপাশি শৈত প্রবাহ ও খড়ার আগাম বার্তা এবং কোন মৌসুমে কোন ফসল আর কোন ধরনের বীজ বপন করতে হবে; সে বিষয়েও আগাম জানিয়ে দেয়া হতো এই ভয়েস কলে।

সুফল-২ প্রকল্পের সহকারী প্রকল্প ব্যবস্থাপক (সাবেক) নুরুন্নাহার বলেন, এ প্রকল্পের আওতায় জেলার সাঘাটা ও ফুলছড়ি উপজেলার ৬ হাজার ৭শ ৫৭ জন মানুষকে ভয়েস কল সেবা পৌঁছে দেয়া হয়। ২ হাজার ৭শ ১০ জনকে আর্থিক সহায়তা, দুইটি ড্রামের ভেলা তৈরি, ৫টি বাঁশের সাঁকো, ৫টি আশ্রয় কেন্দ্রের রাস্তা মেরামত, এগারোটি ল্যান্ডগেজ ও একটি রিভার গেজ স্থাপন, ১০টি স্কুল কাম ফ্লাড শেল্টার মেরামত এবং হাইজিন কিডস বিতরণ করা হয়।

এছাড়া দুইশ জনকে সাইলেজ ও হেলেজ পদ্ধতিতে গোখাদ্য তৈরির প্রশিক্ষণ এবং গবাদী পশুর জন্য ২২টি ভ্যাকসিনেশন ক্যাম্পে গবাদী পশুর সেবা দেয়া হয়।

সাঘাটা উপজেলার উত্তর উল্যা বালুচর এলাকার কৃষক সবুজ মিয়া। কৃষি কাজ করে কোনো মতো স্ত্রী সন্তান নিয়ে জীবন যাপন করেন। এই অভাবের সংসারে জন্মগ্রহন এক নবজাতক ছেলে সন্তান। নাম রাখেন নাঈম ইসলাম। বয়স যতই বাড়তে থাকে ততই নানা রকম সমস্যা দেখেন নাঈমের। বিশেষ করে হাত-পা বিকল অবস্থা দেখা দেয়। এই নাঈম বড় হওয়ার পর চলাফেরা করতে পারতেন না। তাই বন্যার সময় এলেই কষ্টে পড়েন সে। ঠিক তখনই তার পাশে এসে দাঁড়ায় সুফল। তাকে বন্যা কবলিত স্থান থেকে উদ্ধার করে আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন ভূমিকা পালন করে। যা এই প্রতিবন্দী নাঈমেরর জীবনে বড় সহায়ক হিসাবে কাজ করেছে।

উপজেলার ঘুড়িদহ ইউনিয়নের চিনিরপটল গ্রামের ঝুমি বেগম বলেন, আগে বন্যা এলেই আমরা সব থেকে বেশি বিপাকে পড়তাম গরু ছাগল নিয়ে। কারণ বন্যা আসায় গোখাদ্য নিয়ে তেমন চিন্তা চেতনা থাকতো না। নিজের জীবন আগে বাঁচাবো, না গরু ছাগল বাঁচাবো। সেই দিক থেকে গোখাদ্য নিয়ে কিছুই অগ্রিম জানতাম না। পরে সুফল আসার পরে গোখাদ্য কি ভাবে বন্যার পূর্বে বানাতে হয় সে বিষয়ে জেনেছি। এখন বন্যা আসলেও আগের মতো আর গোখাদ্য নিয়ে চিন্তা করতে হয় না।

একই গ্রামের শিল্পী বেগম বলেন, আগে বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর পরেই আমরা যখন বাড়ি ঘড়ে চলে যেতাম, গিয়ে দেখতাম ছোট-বড় বিভিন্ন রকমের সাপ দেখা যেত। তখন এই সাপের আতঙ্ক থেকে রক্ষা পেতে শুকনো মরিচের গুড়া বাড়ির চারপাশে ছিটিয়ে দেয়া হতো। কিন্তু তারপরেও সাপের উপদ্রব কমতো না। আর এখন সুফল প্রকল্পের প্রশিক্ষণে আমাদের বলা হয়, বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পরপরই মিটিং করা হয় এবং বন্যার পানি যুক্ত স্থানে ব্লিচিং পাউডার, লাইফবয় সাবান টুকরো করে ঘরের চারপাশে ছড়িয়ে দিলে সাপ থেকে নিরাপদ থাকা যায়।

খামার পবনতাইড় গ্রামের আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আগে বন্যা যখন আসতো কোনো খবরেই পেতাম না। ফলে কষ্টে ফলানো ফসলগুলো পানিতে তলিয়ে যেত। লক্ষ লক্ষ টাকার ফসল এমনি ভাবে বানের জলে ভেঁসে যেত চোঁখের সামনে। কিন্তু সুফল আসার পরে তারা পেতে শুরু করেন ভয়েস কল। আর এই ভয়েস কলের মাধ্যমে আগাম আবহাওয়ার খবর পাওয়ার কারণে কৃষি ফসল চাষাবাদে তেমন আর ক্ষতি হয় না। তাই তো ভয়েস কলে খুশি এসব এলাকার কৃষকরা। এছাড়া বস্তায় এবং ঝুলন্ত পদ্ধতিতে সবজি চাষ সম্পর্কেও এখন গ্রামের মানুষ সচেতন। 

গত বছরের ডিসেম্বরে সুফল প্রকল্পের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। সাথে বন্ধ হয় ভয়েস কলও। প্রকল্প বন্ধ হলেও বন্যার আগে ও পরে করনীয় সম্পর্কে গ্রামের মানুষ বেশ সচেতন। প্রকল্প থেকে পাওয়া জ্ঞান কাজে লাগিয়ে প্রাকৃতিক দূর্যোগ মোকাবেলার ফলে আর্থিক ক্ষতি কম হচ্ছে। তবে ভয়েস কল বন্ধ হবার কারণে এখন আর প্রাকৃতিক দূর্যোগ কিংবা আবহাওয়ার আগাম কোন খবর পাচ্ছেন না তারা।

সুফল প্রকল্পের ফোকাল পার্সন খন্দকার জাহিদ সরওয়ার সোহেল জানান, এসকেএস ফাউন্ডেশন ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়কালে গাইবান্ধার সাঘাটা, বগুড়ার সারিয়াকান্দি ও সোনাতলা উপজেলায় সুফল প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। এ প্রকল্প থেকে অন্তত: দুই লক্ষাধিক মানুষ প্রাকৃতিক দূর্যোগ সম্পর্কে সচেতন হয়েছেন এবং পরোক্ষ প্রত্যক্ষভাবে উপকৃত হয়েছেন। ভয়েস কল চালুর বিষয়ে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের সাথে আলোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

ভোরের আকাশ/জাআ

  • শেয়ার করুন-
 হার্ট ভালো রাখতে লাল রঙের যেসব খাবার খেতে হবে

হার্ট ভালো রাখতে লাল রঙের যেসব খাবার খেতে হবে

 চুলে অ্যালোভেরা ব্যবহার করেন? জেনে নিন কী উপকার হয়

চুলে অ্যালোভেরা ব্যবহার করেন? জেনে নিন কী উপকার হয়

 "নারীকেই কামনা-বাসনার বস্তু হিসেবে তুলে ধরা হয়" — মন্তব্য জয়া আহসানের

"নারীকেই কামনা-বাসনার বস্তু হিসেবে তুলে ধরা হয়" — মন্তব্য জয়া আহসানের

 বিপিএলে তামিমের খেলা নিয়ে অনিশ্চয়তা, সতর্ক করলেন ট্রেইনার ডালিম

বিপিএলে তামিমের খেলা নিয়ে অনিশ্চয়তা, সতর্ক করলেন ট্রেইনার ডালিম

 কারিনা-প্রিয়াঙ্কার চেয়ে সেরা: নিজের প্রশংসায় কী করলেন কঙ্গনা?

কারিনা-প্রিয়াঙ্কার চেয়ে সেরা: নিজের প্রশংসায় কী করলেন কঙ্গনা?

সংশ্লিষ্ট

গাইবান্ধায় ‘ইউথ ফর বাংলাদেশ’ আয়োজনে দুই দিনব্যাপী বৃক্ষরোপণ অভিযান

গাইবান্ধায় ‘ইউথ ফর বাংলাদেশ’ আয়োজনে দুই দিনব্যাপী বৃক্ষরোপণ অভিযান

কুড়িগ্রামে সাঁপুড়ের প্রাণ নেয়া সাপটিকে চিবিয়ে খেলো আরেক সাঁপুড়ে

কুড়িগ্রামে সাঁপুড়ের প্রাণ নেয়া সাপটিকে চিবিয়ে খেলো আরেক সাঁপুড়ে

গাজীপুর বিএনপির প্রস্তুতি সভা অনুষ্ঠিত

গাজীপুর বিএনপির প্রস্তুতি সভা অনুষ্ঠিত

জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের আর্থিক সহায়তা পেলো মাদ্রাসা শিক্ষক-কর্মচারীরা

জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের আর্থিক সহায়তা পেলো মাদ্রাসা শিক্ষক-কর্মচারীরা