ভোরের আকাশ প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০১ জুন ২০২৫ ১০:৩২ এএম
ফাইল ছবি
রাজধানীর জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা গত চার দিন ধরে বন্ধ রয়েছে। চিকিৎসক ও কর্মচারীদের সঙ্গে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহতের সংঘর্ষের সমাধান হয়নি। কর্মবিরতিতে হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স ও কর্মচারীরা। প্রতিদিন চিকিৎসা নিতে আসা শত শত রোগীকে ফিরে যেতে হচ্ছে। হাসপাতালটিতে প্রতিদিন গড়ে ১২০০ থেকে ১৫০০ জন রোগী বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। চিকিৎসাসেবা বন্ধ থাকায় এসব রোগীকে এখন অন্যান্য হাসপাতালে ছুটতে হচ্ছে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, চক্ষু হাসপাতালের প্রধান দুই ফটক তালাবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে। পাশের পকেট গেটে অবস্থান করছেন নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা গার্ডরা। তারা আগত সেবা প্রত্যাশীদের নানাবিধ প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন। এছাড়া হাসপাতালের সব সেবা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। হাসপাতালে নেই কোনো চিকিৎসক ও নার্স। হাসপাতাল ভবনের গেটে অবস্থান করছেন পুলিশ ও নিয়মিত গার্ডরা। গেটের সামনে বেঞ্চ ফেলে বসে আছেন তারা। সাথে জুলাই অভ্যুত্থানে আহত বেশ কয়েকজনকেও অবস্থান করতে দেখা গেছে।
হাসপাতালে চিকিৎসক-নার্স ও কর্মকর্তা কর্মচারী কেউ না থাকলেও এখনও রয়েছেন জুলাই আন্দোলনে আহতরা। বন্ধ হওয়ার আগে মোট ৫৫ জন জুলাই আহত হাসপাতালটিতে ভর্তি ছিল। যাদের মধ্যে বিষপানে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৪ জন এবং একজন সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি ছিল। তবে বর্তমানে হাসপাতালটিতে মোট ৮০ জন জুলাই যোদ্ধা রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন ওয়ার্ডে ভর্তি রয়েছেন আরও ৪০ থেকে ৫০ জন সাধারণ রোগী।
সিরাজগঞ্জ থেকে মেয়ে জেসমিন আক্তারকে চোখের চিকিৎসক দেখাতে এনেছেন বাবুল হোসেন। কিন্তু হাসপাতালে এসে দেখেন সেবা বন্ধ। আজ জেসমিনের অস্ত্রোপচার করার কথা ছিল। এখন চিকিৎসাসেবা চালু হওয়ার অপেক্ষায় আছেন বাবা-মেয়ে। বাবুল হোসেন বলেন, ‘আগে কখনো এমন বিড়ম্বনায় পড়তে হয়নি। যদি অস্ত্রোপচার না করতে পারি, তাহলে সিরাজগঞ্জে ফেরত যেতে হবে। মেয়ের চোখ থেকে অনবরত পানি পড়ছে। দ্রুত চিকিৎসা করা না হলে চোখ নষ্ট হয়ে যেতে পারে।’
কুমিল্লা থেকে আসা গাজী মোহাম্মদ আকতার বলেন, আমার চোখের অপারেশনের তারিখ রোববার (আজ)। ইতোমধ্যে সব পরীক্ষা করেছি। গত দুই দিন যাবত একবার করে হাসপাতালে আসছি। গার্ডরা বলছে হাসপাতাল বন্ধ, কবে খুলবে তারা জানে না। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আমি একজন ক্যান্সার রোগী। চোখের অপারেশনের জন্য কমলাপুরে এক আত্মীয়ের বাসায় থাকছি। কাল অপারেশন করতে না পারলে নতুন করে সব পরীক্ষা করতে হবে। একটা হাসপাতাল কীভাবে বন্ধ থাকতে পারে। কর্তৃপক্ষের দ্রুত সমস্যা সমাধান করা উচিত।’
গতকাল শনিবার সকাল এগারটায় চক্ষু ইনস্টিটিউটের গেটের বাইরে চা খাচ্ছেন রাজধানীর গুলশান কালাচাঁদপুরের বাসিন্দা মো. সেলিমা। তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, ‘ গত মাসে মায়ের চোখের ছানি অপারেশন হয়েছে। পরীক্ষা করে ফলো-আপ করিয়ে নিতে বলেছেন চিকিৎসকরা। দু’দিন আগে নির্ধারিত তারিখ চলে গেছে। ইনস্টিটিউটে সুযোগ না পেয়ে বাইরে থেকে প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী পরীক্ষা করিয়েছি। কিন্তু হাসপাতাল বন্ধ থাকায় চিকিৎসককে দেখাতে পারছি না।’
আজিমপুর থেকে চোখের সমস্যা নিয়ে আসেন আজিজ মিয়া। তিনি বলেন, ‘সরকারি হাসপাতালে চারদিন সেবা বন্ধ, সরকার থেকে কেনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। সাধারণ জনগণ চিকিৎসাসেবা নিবে কোথা থেকে। অর্থসংকটে বেসরকারি হাসপাতালেও সেবা নিতে পারবো না। এখন আমরা কী করবো।’ নারায়ণগঞ্জ থেকে চিকিৎসা নিতে আসা রবিউল বলেন, ‘আমার চোখ শুকিয়ে গেছে। স্থানীয় চিকিৎসক ও স্বজনদের পরামর্শে এখানে এসেছি। এসে দেখি হাসপাতাল চারদিন যাবত বন্ধ। হাসপাতালের মতো সেবা প্রতিষ্ঠান কীভাবে বন্ধ থাকে?’
শান্তা আক্তার সাভার থেকে মায়ের চিকিৎসা করাতে এসেছেন। গত বৃহস্পতিবার তার মায়ের চোখের অস্ত্রোপচার করার কথা ছিল। কিন্তু রাজধানীর আগারগাঁওয়ের জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা বন্ধ থাকায় তা হয়নি। হাসপাতালের ফটকে কথা হলো শান্তার সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘চোখের জন্য অন্য কোথাও ভালো চিকিৎসাসেবা না থাকায় চক্ষুবিজ্ঞান হাসপাতালই ভরসা। কিন্তু অস্ত্রোপচারের তারিখ চলে গেছে। মায়ের চোখের অবস্থা দিন দিন আরও খারাপ হচ্ছে। দ্রুত অস্ত্রোপচার না হলে বড় সমস্যায় পড়তে হবে।’
হাসপাতালের সর্বশেষ অবস্থা : অচলাবস্থা কাটাতে গত শুক্রবার হাসপাতালের কয়েকজন সচিব, হাসপাতাল প্রতিনিধি, ছাত্র প্রতিনিধিসহ বৈঠক হলেও সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি তারা। হাসপাতালটির চিকিৎসাধীন জুলাই যোদ্ধা রোহান আহমেদ বলেন, আমি হাসপাতালেই আছি। সব ধরনের সেবা কার্যক্রম বন্ধ আছে। আমাদের খাবার ও ওষুধ বাইরে থেকে নিয়ে আসা হচ্ছে। দুপুরে চিকিৎসা চালুর বিষয়ে বৈঠক হলেও কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। গত বুধবারও আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠক হয়। বৈঠকে বেশ কয়েকজন উপদেষ্টাসহ এনসিপির নেতা নাহিদ ইসলাম, হাসনাত আবদুল্লাহ ও আবু বকর উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে আহত ৮-১০ জন জুলাই যোদ্ধাকে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট থেকে অন্যত্র স্থানান্তর করার বিষয়ে তারা সম্মত হয়েছেন।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, পুরো সেবা কার্যক্রম স্থগিত রাখা হয়েছে। কর্মচারীরা নিরাপত্তাহীনতার অভিযোগ করছেন। তাদের ভাষ্য, হাসপাতালের ভেতর জুলাই যোদ্ধাদের কিছু অংশ সহিংস আচরণ করেছে। ভাঙচুর ও হামলার ঘটনা ঘটেছে বারবার। এতে আতঙ্কে রয়েছেন চিকিৎসক ও স্টাফরা।
হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ডা. জানে আলম বলেন, ‘পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য আমরা সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত চিকিৎসক ও কর্মীরা কাজে ফিরতে অনিচ্ছুক। চিকিৎসকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের বিষয় উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। তবে এখনও কোনো আশ্বাস পাওয়া যায়নি।’ তিনি আরও বলেন, ‘হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ চেষ্টা করছে দ্রুত চিকিৎসাসেবা চালু করার, তবে কোনো অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি যেন আবার না ঘটে, সে বিষয়েও সজাগ থাকতে হচ্ছে।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, বর্তমানে ৫০ জন জুলাই যোদ্ধা হাসপাতালে ভর্তি। আত্মহত্যার চেষ্টা করা চারজন সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং একজন সিএমএইচে ভর্তি আছেন। এ ছাড়া প্রায় ১৫০ জন সাধারণ রোগী ছিলেন, যারা নিরাপত্তার অভাবে হাসপাতাল ছেড়ে গেছেন।
যে ঘটনার জেরে অচলাবস্থা : হাসপাতালের একাধিক সূত্র জানায়, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহত চার রোগী সঠিক চিকিৎসা না পাওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগে গত ২৫ মে বিষপান করলে উত্তেজনার সূত্রপাত ঘটে। এরপর ২৭ মে পরিচালকের কক্ষে গিয়ে আরেক আহত শরীরে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। এতে উত্তেজনা চরমে পৌঁছায়; তৈরি হয় অবিশ্বাসের আবহ। এরপর গত বুধবার বেলা ১১টার দিকে পরিস্থিতি ভয়াবহ অবস্থায় যায়। হাসপাতালে ভর্তি জুলাই যোদ্ধা, কর্মচারী এবং রোগীদের সঙ্গে থাকা স্বজনদের মধ্যে ত্রিমুখী সংঘর্ষ হয়।
ভোরের আকাশ/আজাসা