রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন অস্থিরতা
লন্ডনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকে নির্বাচনের দিনক্ষণের আলোচনা ও যৌথ বিবৃতি ভালোভাবে নেয়নি দেশের রাজনৈতিক সকল মহলের পাশাপাশি বিশেষজ্ঞদের অনেকেই। এর ফলে স্বস্তির যে আশা নিয়ে বৈঠকের ইতি টানা হয়, অল্প সময়ের পরেই তা অস্বস্তিতে রূপ নিতে শুরু করে।জুলাই বিপ্লবের মুখ্য শক্তি হিসেবে পরিচিত এনসিপি ও জামায়াতে ইসলামী বৈঠক নিয়ে প্রশ্ন না তুললেও এর বিষয়বস্তুতে আপত্তি তুলেছে। এতে মূলত রাজনৈতিক বিভাজনে নতুন মাত্রা পেতে যাচ্ছে। বিএনপি বাদে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার বিষয় নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে। সেই সাথে জুলাই ঘোষণাকে পাশ কাটিয়ে কোনো নির্বাচন দেশের মানুষ মেনে নিবে কি না তা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। আলোচনার বিষয়বস্তুতে অনৈক্য তৈরি হয়েছে :ড. দিলারা চৌধুরীজাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতির বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক প্রফেসর ড. দিলারা চৌধুরী। তিনি দৈনিক ভোরের আকাশ’কে বলেন, প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন নিয়ে প্রকৃত অর্থে নির্দিষ্ট করে কিছু বলেননি। এপ্রিলের মধ্যে ভোট হবে তার এমন ঘোষণায় তিনি অনড় আছেন। বিএনপির সঙ্গে সরকারের যে টানাপোড়েন ছিল সেটির অবসান হয়েছে যা ছিল এ বৈঠকের বিশেষ বার্তা। তবে বৈঠকে সংস্কার ও বিচারসহ নানা বিষয়ে বিএনপির অবস্থান অস্পষ্ট। এছাড়া বিএনপি যে ঐক্যের কথা বলছে সেখানেও কিছুটা হলেও অনৈক্য তৈরি হয়েছে। যার মনোভাব ব্যক্ত করেছে জামায়াত ও এনসিপি।এটি একটি নতুন কালচার : জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক এমপি হামিদুর রহমান আযাদ দৈনিক ভোরের আকাশ’কে বলেছেন, সরকার প্রধানের সঙ্গে একটি দলের শীর্ষ নেতার বৈঠকের পর যৌথ বিবৃতি দেয়ার কালচার আমরা দেখিনি। আমরা দেখি একটি দেশের সঙ্গে অন্য দেশের সরকার প্রধানের বৈঠকের পর এ ধরনের বিবৃতি। এ বিবৃতিতে প্রমাণিত হয় সরকার একটি দলের দিকে ঝুঁকি গেছে। যা সুষ্ঠু ভোটের অন্তরায়। এছাড়া কোন দলের দাবির প্রতি সরকার যে নমনীয় সেটিও প্রমাণিত হয়। এতে সরকারের অবস্থান আরো দুর্বল হবে।বিদেশে বসে সিদ্ধান্তে হতাশ হয়েছি : জাতীয় নাগরিক কমিটির (এনসিপি) সদস্য সচিব আখতার হোসেন দৈনিক ভোরের আকাশ’কে বলেন, প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক কোন দলের নেতার সঙ্গে হতেই পারে। তবে, আমরা দেখেছি শুধুমাত্র নির্বাচন ছাড়া সেখানে অন্য কোন আলাপ নেই। বিচার এবং সংস্কার কী হবে সেটিও আমরা কোনো আলোচনা শুনলাম না। বিদেশে বসে নির্বাচনের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে জাতি কিছুটা হতাশ হয়েছে। এছাড়া বৈঠকের পর এ ধরণের বিবৃতিতে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট প্রশাসনও একটি দলের পক্ষে কাজ করারও আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।বৃহত্তর স্বার্থেই এ সিদ্ধান্ত : সালাহউদ্দিন লন্ডন বৈঠক নিয়ে জামায়াত-এনসিপির নাখোশের জবাব দিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। তিনি বলেছেন, কোনো দলের প্রতি অনুরাগ নয়, বরং ২০২৬ সালের রোজার আগে ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচন হতে পারে বলে জামায়াতের আমির যে পরামর্শ দিয়েছিলেন, সেটার সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার ঘোষিত নির্বাচনের নতুন সময়সীমা সামঞ্জস্যপূর্ণ। সালাহউদ্দিন আহমদ এনসিপি প্রতিক্রিয়ারও জবাব দেন।তিনি বলেন, নতুন রাজনৈতিক দলটি (এনসিপি) লন্ডন এই বৈঠকের ঘোষণাকে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখছে। এ ক্ষেত্রে দলীয় দৃষ্টির ঊর্ধ্বে উঠে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং তাদের আরও অভিজ্ঞতা অর্জনের পরামর্শ থাকবে।এদিকে, গতকাল শনিবার জামায়াত ইসলামী নির্বাহী পরিষদ সভা করে। জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমানের সভাপতিত্বে দলটির সভা শেষে দলটির কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের সেক্রেটারি মতিউর রহমান আকন্দ স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে জানান, লন্ডনে একটি দলের শীর্ষ নেতার সঙ্গে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠকের বিষয় ও পরবর্তীতে যৌথ বিবৃতি দেওয়াকে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ব্যত্যয় বলে মনে করছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।দলটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক শেষে বিদেশে যৌথ প্রেস ব্রিফিং এবং বৈঠকের বিষয় সম্পর্কে যৌথ বিবৃতির মাধ্যমে একটি দলের প্রতি প্রধান উপদেষ্টা বিশেষ অনুরাগ প্রকাশ করেছেন, যা তার নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন করেছে। একই সঙ্গে বৈঠকের পর যৌথ প্রেস ব্রিফিং করায় আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হওয়ার বিষয়ে জনগণের মধ্যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে বলেও অভিমত ব্যক্ত করেছে জামায়াতে ইসলামী।বিবৃতিতে জামায়াতে ইসলামী জানায়, ১৩ জুন লন্ডনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মাদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এটাকে খুবই স্বাভাবিক মনে করে। ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে পৃথকভাবে এবং যৌথভাবে বৈঠক করেছেন।বিবৃতিতে আরও জানায়, তিনি (প্রধান উপদেষ্টা) গত ৬ জুন জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করেন। তার এই ঘোষণার পর লন্ডনে সফরকালে একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক শেষে বিদেশে যৌথ প্রেস ব্রিফিং এবং বৈঠকের বিষয় সম্পর্কে যৌথ বিবৃতি প্রদান করা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ব্যত্যয় বলে আমরা মনে করি। এর মাধ্যমে তিনি একটি দলের প্রতি বিশেষ অনুরাগ প্রকাশ করেছেন, যা তার নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন করেছে। আমরা মনে করি, দেশে ফিরে এসে প্রধান উপদেষ্টা অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে এব্যাপারে তার অভিমত প্রকাশ করাই সমীচীন ছিল।জামায়াতে ইসলামী মনে করে, সরকারপ্রধান হিসেবে কোনো একটি দলের সঙ্গে যৌথ প্রেস ব্রিফিং নৈতিকভাবে কিছুতেই যথার্থ নয়। প্রধান উপদেষ্টা একটি দলের সঙ্গে বৈঠকের পর যৌথ প্রেস ব্রিফিং করায় আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হওয়ার বিষয়ে জনগণের মধ্যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। যেখানে বাংলাদেশে অনেকগুলো রাজনৈতিক দল সক্রিয়ভাবে বিদ্যমান, সেখানে শুধু কোনো একটি দলের সঙ্গে আলাপ করে দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সঠিক বলে বিবেচিত হতে পারে না।আমরা আশা করি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিরপেক্ষ থেকে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করবেন এবং বিচার ও সংস্কারের ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নিশ্চিত করবেন। সরকারের নিরপেক্ষতা এবং অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিয়ে যে সংশয় দেখা দিয়েছে তা নিরসনকল্পে প্রধান উপদেষ্টার ভূমিকা জাতির সামনে স্পষ্ট করার জন্য বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী পরিষদ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে।এছাড়া শুক্রবার রাতে এনসিপি এ বিষয়ে একটি বিবৃতিতে দেয়। সেখানে বলা হয়েছে- জুলাই ঘোষণাপত্র প্রণয়ন, মৌলিক সংস্কার বাস্তবায়নে জুলাই সনদ কার্যকর করা ও বিচারের রোডম্যাপ ঘোষণার পরই নির্বাচন সংক্রান্ত আলোচনা চূড়ান্ত হওয়া উচিত। ‘জুলাই সনদ’ রচনা ও কার্যকর করার পূর্বে নির্বাচনের কোনো তারিখ ঘোষিত হলে তা জনগণ মেনে নেবে না বলেও মনে করেন দলটির নেতারা।এনসিপির বিবৃতিতে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা হিসেবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আলোচনাকে ইতিবাচকভাবে দেখছে জাতীয় নাগরিক পার্টি। এই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে লন্ডনে অনুষ্ঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যকার বৈঠকটি ‘সংসদ নির্বাচন’ বিষয়ে দলটিকে আস্থায় আনতে সফল হয়েছে সরকার। জাতীয় ঐক্য, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব এবং রাষ্ট্র সংস্কারের প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা জরুরি বলে আমরা মনে করি।বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, বৈঠকে নির্বাচনের তারিখ সংক্রান্ত আলোচনা যতটুকু গুরুত্ব পেয়েছে, অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে নাগরিকদের প্রধান দাবি তথা বিচার ও সংস্কার ততটুকু গুরুত্ব পায়নি। এটা অত্যন্ত হতাশাজনক বলে মনে করে এনসিপি। নির্বাচন প্রশ্নে সরকার কেবল একটি রাজনৈতিক দলের অবস্থান ও দাবিকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে বলে বারবার প্রতীয়মান হচ্ছে।দলটির নেতারা বলেন, আমরা মনে করি, ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ প্রণয়ন, ‘জুলাই সনদ’ কার্যকর করা এবং বিচারের সুস্পষ্ট রোডম্যাপ ব্যতীত জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন গণঅভ্যুত্থানকে স্রেফ একটি ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে পরিণত করবে এবং রাষ্ট্র বিনির্মাণের জনআকাঙ্ক্ষাকে অবদমিত করবে। জনগণের দাবি তথা ‘জুলাই সনদ’ রচনা ও কার্যকর করার পূর্বে নির্বাচনের কোনো তারিখ ঘোষিত হলে, তা জনগণ মেনে নেবে না। কাজেই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সংস্কারের বিষয়গুলোর ব্যাপারে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা ও জুলাই সনদ রচনা এবং কার্যকর করেই আসন্ন জুলাইকে যথাযথ মর্যাদায় স্মরণ করার উদ্যোগ নিতে সরকারকে জোর দাবি জানাই।জামায়াত ও এনসিপির মাঠ পর্যায়ে নেতারা বলছেন, মাঠ পর্যায়ের প্রশাসন বিশেষ করে এ যৌথ বিবৃতির পর একটি দলের পক্ষে অবস্থান নিতে পারে। যা ভোটের মাঠে ব্যাপকভাবে প্রভাব পড়বে। অর্থাৎ সুষ্ঠু ভোটের অন্তরায় তাই দল দুটির নেতারা এ বিষয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।ভোরের আকাশ/এসএইচ