মৌলভীবাজার প্রতিনিধি
প্রকাশ : ১১ জুন ২০২৫ ০১:২৮ পিএম
ছুটিতে বর্ষার সেরা সময় হতে পারে চায়ের রাজ্যে
ছুটিতে কিংবা বর্ষার যেকোনো সময় আপনার জন্য আদর্শ গন্তব্য হতে পারে চায়ের রাজ্য মৌলভীবাজার জেলা।
শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ যাওয়ার পাকা সড়কটা ধরে চলেছি। একটি অটোরিকশায় চেপে। দুই পাশে চা বাগানের রাজ্যের মাঝখান দিয়ে ছুটেছে গাড়ি। একটু পর গ্র্যান্ড সুলতান রিসোর্ট পেরিয়ে লাউয়াছড়ার সীমানায় ঢুকে পড়লাম। দুই পাশ থেকে পাখি আর নানা কীট-পতঙ্গের ডাক তারই জানান দিল। তবে এখানেই জঙ্গলের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া মূল রাস্তা বাদ দিয়ে ডানের একটা পথ ধরলাম আমরা। গন্তব্য মাধবপুর লেক। লেবু-আনারসের বাগান পেরিয়ে, লেমন গার্ডেন নামের একটি রিসোর্টকে ডানে রেখে কিছুটা এগুতেই আশ্চর্য সুন্দর এক জগতে চলে এলাম।
প্রবেশের পথটা বাঁশ দিয়ে আটকানো ছিল। গার্ডকে বলে ভেতরে ঢুকেতে হলো। এটাও একটা চা বাগান। তবে ছিমছাম, পরিচ্ছন্ন আর এত সুন্দরভাবে টিলার গায়ে চা গাছগুলো দাঁড়িয়ে আছে, মিলিয়ে দারুণ লাগল। দুটি সুন্দর খরের ছাউনি একটু জিরিয়ে নেওয়ার জন্য আদর্শ। হালকা ছাটে বৃষ্টি পড়ছে। বাগানে তখনো কাজ করছেন চা শ্রমিকেরা। গল্পটি বেশ কয়েক বছর আগের। প্রথম দেখাতেই আমাকে মুগ্ধ করে নূরজাহান চা বাগান। এরপর যতবার শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জে গিয়েছি এই বাগানটিতে একবার ঢু মারতে ভুল করিনি।
ওই যে মাধবপুর লেকের কথা বললাম ওটাও পড়েছে মাধবপুর চা বাগানের সীমানায়। বর্ষায় ভারি সুন্দর হ্রদটা। ওপর থেকে চারপাশের চা বাগান-পাহাড় মিলিয়ে দারুণ লাগে।
শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ গেলে লাউয়াছড়ার জঙ্গলে না গিয়েই বা থাকবেন কীভাবে? বনটির কথা ভাবতে গিয়ে স্মৃতিকাতরতা পেয়ে বসল। ঢাকা থেকে সিলেট যাচ্ছিলাম আন্তঃনগর পারাবত এক্সপ্রেসে। পথেই পড়ে আমার নানার বাড়ির স্টেশন হরষপুর। ওই স্টেশন পেরিয়ে আরো অন্তত ঘণ্টা দেড়েক চলার পর হঠাৎ একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ল ট্রেন। জানালা দিয়ে তাকিয়ে ছিলাম বাইরে, ট্রেন ভ্রমণে এই কাজটাই সবচেয়ে আনন্দ নিয়ে করি। চমকে উঠলাম, আশ্চর্য সুন্দর এক পৃথিবীতে চলে এসেছি। এই অচেনা রাজ্যে ঘন গাছপালার ঠাসবুনোট। হাত দশেক দূরে একটা গাছ ভেঙে কাৎ হয়ে আছে আরেকটার ওপর। এক ডাল থেকে আরেক ডালে উড়ে যাচ্ছে পাখি। ওদের সঙ্গে সমান তালে ডাকছে পোকামাকড়েরা। এ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। নেই লোকজনের বিরক্তিকর কোলাহল।
যতটা সময় ট্রেনটা দাঁড়িয়ে ছিল মোহাচ্ছন্ন হয়ে ছিলাম, তারপর আবার যখন যেমন হঠাৎ থেমেছিল তেমন আচমকা ছেড়ে দিল, তখনই বাস্তবে ফিরলাম। ঘটনাটা বহু বছর আগের, এইচএসসি পাশের পর সিলেট যাচ্ছিলাম শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে। ঢাকা ফিরে আসার পর জানতে পারি ওটাই লাউয়াছড়া। এখন অবশ্য লাউয়াছড়া পর্যটককে রীতিমতো গমগম। এতটাই যে বনের প্রাণীদের ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। আমার মনে হয় ভোরের দিকে হাজির হতে পারেন। মানুষের ভিড় থাকবে না। নীরবে হাঁটলে বুনোরা বিরক্ত হবে না। এদের অনেকের দেখাও পেয়ে যেতে পারেন। লাউয়াছড়ায় যখনই গিয়েছি পাহাড়ের ওপর খাসিয়া পাড়ায় যাওয়ার চেষ্টা করেছি। অদ্ভুত সুন্দর, স্বচ্ছ জলের এক ছড়া পেরিয়ে পাহাড়ের গায়ে মাটির সিঁড়িপথ ধরে হেঁটে বেশ লাগে পাড়াটায় যেতে। তবে আমার ওই পাড়ার চেয়েও বেশি ভালো লাগে পাড়ায় যাওয়ার পথের ওই ঝিরিটাতে সময় কাটাতে। স্বচ্ছ পানির নিচে বালু দেখতে পাবেন পরষ্কার। আবার ঝিরি ধরে হাঁটতে হাঁটতে দুই পাশের প্রায় গায়ের ওপর এসে পড়া জঙ্গলের রূপ উপভোগ করতে পারবেন চমৎকার।
জঙ্গলের ভেতর দিয়ে কু ঝিক ঝিক শব্দে চলে যাওয়া রেলগাড়ি দেখাটাও উপভোগ্য।
লাউয়াছড়ার কথা যখন এল চাইলে কমলগঞ্জের রাজকান্দি রেঞ্জের আদমপুর বনে ঘুরে আসতে পারেন। পর্যটকদের চাপ না থাকায় অরণ্যপ্রেমী হলে দারুণ উপভোগ করবেন সন্দেহ নেই। হামহাম জলপ্রপাতটিও খুব দূরে নয়।
শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জে আরও ঘুরে বেড়াতে পারেন ভারাউড়া লেক, লাল পাহাড়, দার্জিলিং টিলা, শংকর টিলা, গরম টিলা, ডিনস্টন ওয়ার সিমেট্রি, হরিণছড়া গলফ মাঠ, চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের মতো জায়গায়। চা বাগানের পাশাপাশি বর্ষায় আনারস আর লেবু বাগানগুলোতে চমৎকার সময় কাটবে। চাইলে পথের ধারে গাড়ি থেকে নেমে আনারস খেতেও পারবেন। অনেক চা বাগানের রাজ্য বলতে শুধু শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জকে বুঝলেও মৌলভীবাজারের জুড়ি, কুলাউড়া আর বড়লেখাও চা বাগানও মন জুড়িয়ে দেবে। জুড়ি থেকে লাঠিটিলার জঙ্গলে যাওয়ার পথে, চা বাগান ঘেরা আশ্চর্য সুন্দর এক জায়গা পাবেন। সবসময় গা বেয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পানি পড়তে থাকে এমন একটি পাহাড় পেরিয়ে, রাস্তা চলে গেছে একটা সেতু হয়ে ছড়ার ওপর দিয়ে। গাড়িটা ওখানে দাঁড় করাবেন।
সবুজ টিলায় চা বাগান, সমতলের ধানি জমি, মাঝখানের এই রাস্তা সব মিলিয়ে রীতিমতো দিশেহারা হয়ে পড়বেন সৌন্দর্যে। ওখানটায় বেশ কতকটা সময় দাঁড়িয়ে থাকলে আমি যেন পিছিয়ে যাই অন্তত ত্রিশ-চল্লিশ বছর। মানস চোখে দেখি, জমিতে কয়েকটা গরু চরছে, আচমকা পাহাড়ের গায়ের এক পাথরের আড়াল থেকে বিশালদেহী এক বাঘ প্রবল হুংকারে ঝাঁপিয়ে পড়ল একটার ঘাড়ে! জুড়ির লাঠিটিলা এবং সাগরনাল বনও মুগ্ধ করবে আপনাকে। তেমনি চলে যেতে পারেন একেবারে সীমান্তের ধারে ফুলতলা চা বাগান পর্যন্ত। আর এতদূর যদি এগিয়ে যান বড়লেখার মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত না দেখে কী ফিরবেন। এই বৃষ্টিতে জলপ্রপাতটি নাকি রীতিমতো ফুলে-ফেঁপে উঠেছে।
ভোরের আকাশ/আজাসা