বাংলায় হাতপাখার বিবর্তন

বাংলায় হাতপাখার বিবর্তন

ফিচার ডেস্ক

প্রকাশ : ১ দিন আগে

আপডেট : ১ দিন আগে

বাংলায় হাতপাখার বিবর্তন

বাংলায় হাতপাখার বিবর্তন

হাতপাখা তৈরি ও ব্যবহারের ইতিহাস বহু প্রাচীন। গ্রীষ্মকালে প্রশান্তির জন্য ব্যবহৃত হাতে চালিত পাখা। শুরু হয়েছিল প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে। প্রাচীন মিশরে ফেরাউনদের রাজসভায় দাঁড়িয়ে থাকা দাসেরা সোনার কাঠামোতে বাঁধা ময়ূর পালকের পাখা দুলিয়ে রাজাকে শীতল রাখত। চীনের হান রাজবংশ কিংবা জাপানের হেইয়ান যুগেও হাতপাখা ছিল সম্মানের প্রতীক। ভারতের মন্দির-আশ্রমেও দেবতাদের উদ্দেশ্যে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করার প্রচলন ছিল। সময়ের স্রোতে বদলেছে সভ্যতা, পাল্টেছে প্রযুক্তি, কিন্তু হাতপাখা তার সরল রূপ ধরে রেখেছে আপন মহিমায়। বদলেছে কেবল তার ভূমিকা, নির্মাণশৈলী ও মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের ধরণ। একবার পেছন ফিরে তাকালে দেখা যায় হাতপাখার এক দীর্ঘ ও বৈচিত্র্যময় অভিযাত্রা।

হাতপাখার ব্যবহার: ধারনা করা হয়, হাতপাখার ব্যবহার শুরু হয়েছিল প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে। তৎকালীন রাজাদের সিংহাসনের দুই পাশে ডানে-বাঁয়ে দাঁড়িয়ে বাতাস করার প্রচলন ছিল। অনেকেই শৌখিন বেশে কাছারিঘরে ছাদ বরাবর কড়িকাঠে ঝুলিয়ে রাখতেন। প্রচীন কালে চিন ও জাপান থেকে ইউরোপীয় বণিকরা প্রথম হাতপাখা নিয়ে আসেন। সেই হাতপাখাগুলিতে মণিমুক্তো, সোনারুপো, হাতির দাঁত, বিভিন্ন সামাজিক প্রেক্ষাপট, রাজনৈতিক ঘটনা, ধর্মীয় কাহিনি, ফুল, ফল, পাখি, নানা নিয়মাবলী আঁকা থাকত। কারণ এইসব চিত্র দেখেই সাধারণ মানুষ বর্তমান সমাজ সম্বন্ধে কিছুটা ধারনা পেতেন। প্রথমদিকে পাখাগুলি একটি ভাঁজের হলেও পরবর্তীতে পাখা ভাঁজে ভাঁজে তৈরি হতে শুরু হয়। আঠারো শতকের প্রথম দিকে ইউরোপের হাত ধরে হাতপাখা তৈরির শুভসূচনা হলেও, চিনের পাখার বাজার কিন্তু রমরমিয়ে চলতে শুরু করে। পুরনো দিনের সেই পাখাগুলির বেশ কিছু নমুনা এখনও সংগ্রহশালায় রয়েছে। জানা যায়, হেলেন অফ ট্রয়, আইভরি পার্ল ফন্টেজ, ট্রাইফোল্ড-এর মতো প্রায় ৩৫০০ বেশি দুষ্প্রাপ্য পাখা লন্ডনের গ্রিনউইচ জাদুঘরের সংগ্রহশালায় দেখতে পাওয়া যায়।

বাংলার হাতপাখার ব্যবহার: শুধু বিশ্বের দরবারে নয়, হাতপাখার প্রচলন কিন্তু গ্রাম বাংলায় সর্বত্র দেখতে পাওয়া যায়। অতীতকাল থেকে বর্তমানকালেও এই হাতপাখার ব্যবহার রয়ে গিয়েছে। গ্রাম বাংলার বেশ কিছু ঘরের আজও নিয়মিত হাতপাখার ব্যবহার লক্ষ করা যায়। অতীতে রাজা-মহারাজাদের রাজপ্রাসাদে কিংবা আদালতে বিচারকের কক্ষে এই হাতপাখা ব্যবহার করা হত। ক্লান্ত পথিক, পরিশ্রান্ত শ্রমিক বাড়ি ফিরে হাতপাখার হাওয়া খেয়ে তার ঘর্মাক্ত শরীরকে একটু বিশ্রাম দিত। কিন্তু বর্তমানে পাখার ব্যবহার এতটা না হলেও, বেশ কিছু বিশেষ কাজে যেমন- ষষ্ঠী, ঠাকুর বরণ ইত্যাদি কাজগুলোতে পাখার সম্পূর্ণ ব্যবহার রয়েছে।

বাংলার আবহাওয়ার দাবদাহের সঙ্গে তাল মেলাতে তালপাতা, খেজুরপাতা, কিংবা বাঁশের সাহায্যে স্থানীয়ভাবে হাতপাখা তৈরি শুরু হয়। এই হাতপাখা হয়ে ওঠে প্রতিটি ঘরের নিত্যসঙ্গী। দুপুরের কড়াচড়া রোদ কিংবা বিদ্যুৎহীন রাত হাতপাখার নরম বাতাসে ঘুমিয়ে পড়ত মানুষ। শুধু ব্যবহারিক চাহিদা মেটানো নয়, হাতে বোনা এই পাখাগুলো কখনো কখনো হয়ে উঠত স্নেহের বাহকও।

সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে হাতপাখায় যুক্ত হতে থাকে শিল্পের ছোঁয়া। সাধারণ তালপাতার পাখা ছাড়াও দেখা যায় বাঁশের চিকন বুননে তৈরি পাখা, যার গায়ে আঁকা রঙিন ফুল, পাখি, নকশা। গ্রামীণ মেলায়, বৈশাখী উৎসবে কিংবা বিয়ের উপহার সামগ্রী হিসেবে বাহারি হাতপাখার সমারোহ চোখে পড়ে। একরকম হাতপাখা হয়ে দাঁড়ায় ব্যক্তিগত রুচি ও সৌন্দর্যবোধের প্রকাশ।

বিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে যখন ঘরে ঘরে বৈদ্যুতিক পাখা পৌঁছাতে শুরু করল, হাতপাখার প্রয়োজনীয়তা কমতে থাকে। এসির ঠান্ডা বাতাসের আরামে মানুষ হাতপাখাকে ভুলতে শুরু করে। শহরাঞ্চলে তো বটেই, গ্রামেও আজ বিদ্যুৎ থাকায় আগের মতো প্রতিটি বাড়িতে হাতপাখার ঝুলন্ত সারি দেখা যায় না। তবুও বিদ্যুৎ চলে গেলে কিংবা খুব গরমের দিনে অথবা বিশেষ কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানে এখনো হাতপাখার টুকটুকে বাতাসের কদর অক্ষুণ্ন। গ্রামবাংলার চাষের মাঠে বিশ্রামরত কৃষকের হাতে এখনো চোখে পড়ে পুরোনো হাতপাখার দোলা।

যদিও ব্যবহারিক গুরুত্ব কমেছে, হাতপাখা আজও হারিয়ে যায়নি। বরং হস্তশিল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে নতুন পরিচয় পেয়েছে। বিভিন্ন মেলায়, হস্তশিল্প প্রদর্শনীতে বা ঘরের দেয়াল সাজানোর উপকরণ হিসেবে হাতপাখা নতুন জীবন পেয়েছে। নস্টালজিয়ার টানেই হোক বা ঐতিহ্য সংরক্ষণের চেষ্টা, হাতপাখা আজও টিকে আছে বাংলার মাটির সুবাস নিয়ে।

হাতপাখা ইতিহাসের জীবন্ত সঙ্গী, সংস্কৃতির বুনন ও ভালোবাসার স্মারক। আধুনিক জীবনের চাকচিক্যের মাঝেও হাতপাখার দোল মনে করিয়ে দেয়, আমরা একদিন তালপাতার বাতাসে স্বপ্ন দেখতাম, মাটির ঘ্রাণে জীবন খুঁজে পেতাম।

ভোরের আকাশ/এসআই

  • শেয়ার করুন-

সংশ্লিষ্ট

বাংলায় হাতপাখার বিবর্তন

বাংলায় হাতপাখার বিবর্তন

পাহাড়ে সাতরঙা উৎসব

পাহাড়ে সাতরঙা উৎসব

রুদ্ধ হতে পারে রাজনীতির পথ

রুদ্ধ হতে পারে রাজনীতির পথ

ধর্ষণের শাস্তি হোক মৃত্যুদণ্ড ও অঙ্গ কর্তন!

ধর্ষণের শাস্তি হোক মৃত্যুদণ্ড ও অঙ্গ কর্তন!

মন্তব্য করুন