আমানত ও ঋণের ঊর্ধ্বগতি
তাকী মোহাম্মদ জোবায়ের
প্রকাশ : ১০ মে ২০২৫ ১১:৩১ এএম
ঘুরে দাঁড়াচ্ছে অর্থনীতি
মানুষের সঞ্চয় প্রবণতা বৃদ্ধির ইঙ্গিত পাওয়া গেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত হালনাগাদ প্রতিবেদনে। একই সঙ্গে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহও বাড়ছে। এই সূচক দুটি স্থিমিত হয়ে পড়া অর্থনীতিতে গতি ফেরার ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদগণ।
ব্যাংক খাতে আমানত ও ঋণের যে হালনাগাদ প্রতিবেদন বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশ করেছে তাতে দেখা গেছে, মার্চে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি কিছুটা বেড়ে ৭ দশমিক ৫৭ শতাংশে উঠেছে। আগের মাসে তা ছিল ইতিহাসের সর্বনিম্ন, ৬ দশমিক ৮২ শতাংশ। আর জানুয়ারিতে এ খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ১৫ শতাংশ। একই সময়ে আমানতের প্রবৃদ্ধি আগের মাসের চেয়ে বেড়ে মার্চে সাড়ে ৮ শতাংশ পার হয়েছে। গত ৯ মাসের মধ্যে এটি সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি। আগের মাস ফেব্রুয়ারিতে আমানত বৃদ্ধির হার ছিল ৭ দশমিক ৮৯ শতাংশ; আর জানুয়ারিতে ছিল ৮ দশমিক ২৮ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন শুরুর মাস জুলাইয়ে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি ১০ দশমিক ১৩ শতাংশ হলেও সরকার পতনের মাস আগস্টে তা নেমে যায় ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশে। পরের মাস সেপ্টেম্বরে তা আরও কমে হয় ৯ দশমিক ২০ শতাংশ, যেটি ছিল তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। নিম্নমুখী এ হার পরের মাসে কমে দাঁড়ায় ৮ দশমিক ৩০ শতাংশে। আর নভেম্বরে আরও কমে হয় ৭ দশমিক ৬৬ শতাংশ। বিদায়ী বছরের ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ। এর আগে ২০২১ সালের মে মাসে কোভিড মহামারির মধ্যে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশে নেমেছিল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে আগের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের তুলনায় মূলধন যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র বা এলসি খোলা কমেছে ২৮ দশমিক ৬৮ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় বাজারে অর্থপ্রবাহ কমিয়ে রাখার যে নীতি ঠিক করেছে, ঋণ প্রবৃদ্ধি এরই মধ্যে তার চেয়ে নিচে নেমে গেছে। সংকোচনমূলক নীতি বজায় রাখার ধারায় চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতিতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৯ দশমিক ৮০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছিল।
ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর মুদ্রানীতি ঘোষণার দিন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, মূল্যস্ফীতি কমা না পর্যন্ত নীতি সুদহার ১০ শতাংশে রাখা হবে। মূল্যস্ফীতি কমলে নীতিসুদহার কমানো হবে।
এদিকে আমানতের হিসাবে হিসাবে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের মার্চে আমানতের মোট পরিমাণ বেড়ে ১৮ লাখ ১৮ হাজার ১৪৩ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১৬ লাখ ৭৫ হাজার ৪৯২ কোটি টাকা। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি শেষে মোট আমানতের পরিমাণ ছিল ১৭ লাখ ৯২ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা। আর জানুয়ারি শেষে ছিল ১৭ লাখ ৮১ হাজার ২৮৭ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের সেপ্টেম্বর থেকে ব্যাংক খাতে আমানতে প্রবৃদ্ধি কমতে থাকে, যা ওই মাসে ৭ দশমিক ২৬ শতাংশে নেমে যায়। অক্টোবরে তা সামান্য বেড়ে হয় ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ। নভেম্বরে আরও কিছুটা বেড়ে হয় ৭ দশমিক ৪৬ শতাংশ এবং ডিসেম্বরে তা দাঁড়ায় ৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ।
এর আগে ব্যাংক খাত আমানতে এত কম প্রবৃদ্ধি দেখেছিল ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, সেবার ৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। মার্চের ধারাবহিকতায় শিগগিরই আমানত বৃদ্ধির হার দশ শতাংশ পার হবে বলে জানিয়েছেন মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান।
জানা গেছে, আমানতে ভালো সুদ হার, ব্যাংক খাতে চলমান সংস্কারের ফলে আস্থা বৃদ্ধি ও রেকর্ড রেমিট্যান্স প্রবাহের কারণে চলতি বছরের মার্চ মাসে ব্যাংক খাতে আমানত বেড়েছে। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২৪ সালের জুনে ব্যাংক খাতে আমানত প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ২৫ শতাংশ। তবে এরপর থেকেই এই প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে। ২০২৩ সালের আগস্টে তা নেমে দাঁড়ায় মাত্র ৭ দশমিক শূন্য ২ শতাংশে, যা ছিল আগের ১৮ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। তবে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এই হার ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করে এবং তার ধারাবাহিকতায় মার্চ মাসে ৯ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
ব্যাংক খাতের কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, ব্যাংক খাত থেকে অনিয়মের মাধ্যমে ঋণ নেওয়ার বেশকিছু ঘটনা নজরে আসার পর গ্রাহকদের মধ্যে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছিল। পাশাপাশি দুর্বল ব্যাংকগুলো থেকে গ্রাহকরা তাদের জমা রাখা টাকা ঠিকমতো ফেরত না পাওয়া তা তাদের মধ্যে আতঙ্ক বাড়িয়ে দেয়। তবে গত আগস্ট থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর দায়িত্ব নেওয়ার পর পরিস্থিতি কিছুটা বদলাতে শুরু করে। তার নেতৃত্বে অন্তত ১৩টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন, টাকা ছাপিয়ে তারল্য সহায়তা, এবং বেনামী ঋণ বন্ধে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়। যদিও এসব উদ্যোগে সব দুর্বল ব্যাংকের অবস্থার উন্নতি না হলেও অবনতি ঠেকানো সম্ভব হয়েছে।
গভর্নরের ভাষ্য অনুযায়ী, ইসলামী ও ইউসিবি ব্যাংকের অবস্থান আগের তুলনায় কিছুটা ভালো হয়েছে। একই সঙ্গে ভালো অবস্থানে থাকা ব্যাংকগুলোর প্রতি গ্রাহকদের আস্থা বাড়ায় সেগুলোতে আমানতও বাড়তে শুরু করেছে। এছাড়া, অনেক ব্যাংক আমানত টানতে ১৪ শতাংশ পর্যন্ত সুদহার অফার করছে, যা গ্রাহকদের আরও আকৃষ্ট করছে।
ব্যাংক কর্মকর্তারা মন্তব্য করেছেন, মার্চ মাসে আমানত ও বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি বাড়লেও, এটি এখনও বলা সম্ভব নয় যে, প্রবৃদ্ধির ধারা স্থায়ীভাবে পরিবর্তিত হয়েছে কিনা। তবে এটি অবশ্যই ভালো কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে। আমানত বৃদ্ধির কারণ সম্পর্কে পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ আলী বলেন, মার্চ মাসে ব্যাংকে আমানত প্রবৃদ্ধি বাড়ার চারটি প্রধান কারণ রয়েছে।
প্রথমত, কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতিগত সুদের হার বাড়ানোর পর ব্যাংকগুলোও আমানতের বিপরীতে তুলনামূলক উচ্চ সুদহার দিতে শুরু করেছে। এতে গ্রাহকরা বেশি রিটার্ন পাওয়ার আশায় ব্যাংকে টাকা জমা রাখতে আগ্রহী হচ্ছেন।
দ্বিতীয়ত, যেসব ব্যাংকের এডিআর অত্যধিক বেড়ে গিয়েছিল, তারা নতুন করে আমানত সংগ্রহের জন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করে। এর ফলে এসব ব্যাংক নির্দিষ্ট পরিমাণে নতুন আমানত টানতে সক্ষম হয়েছে।
তৃতীয়ত, কেন্দ্রীয় ব্যাংক কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠনসহ খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। এর প্রভাবে ব্যাংকিং খাতের প্রতি গ্রাহকদের আস্থা ধীরে ধীরে ফিরে আসছে।
চতুর্থত, মার্চ মাসে রেকর্ড ৩ দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স দেশে এসেছে। রেমিট্যান্স ব্যাংকিং চ্যানেলে আসার পর সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের ব্যাংক হিসাবে জমা হয়। সাধারণত গ্রাহকরা পুরো অর্থ একসঙ্গে তুলে না নিয়ে একটি অংশ জমা রেখেই দেন। ফলে মার্চ মাসে আমানত প্রবৃদ্ধি বাড়ার পেছনে এটি একটি বড় অবদান রেখেছে।
ভোরের আকাশ/এসএইচ