শর্ত পূরণে বাংলাদেশ অনড়
তাকী মোহাম্মদ জোবায়ের
প্রকাশ : ২৯ এপ্রিল ২০২৫ ১০:০৬ এএম
আইএমএফের ঋণ অনিশ্চিত
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের সাথে বাংলাদেশের ঋণ চুক্তির চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। মুদ্রা বিনিময় হার সংক্রান্ত একটি শর্তে ঋণ প্রক্রিয়াটি আটকে গেছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। আইএমএফ কর্তৃপক্ষ শর্ত পূরণের জন্য সময়সীমা বেঁধে দিলেও বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত এই বিষয়ে অনড় অবস্থান বজায় রেখেছে। এমন অবস্থায় ঋণ সংক্রান্ত আলোচনায় সমাধানে পৌঁছানো ছাড়াই ঢাকার উদ্দেশ্যে ওয়াশিংটন ত্যাগ করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। আইএমএফের সঙ্গে বিদ্যমান ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তির চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির ১৩০ কোটি ডলার পাওয়ার কথা ছিল আগামী জুনের শেষে।
বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের বসন্তকালীন সভায় যোগ দিতে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে গভর্নর সহ উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল যুক্তরাষ্ট্র সফর করে। গত ২১ এপ্রিল থেকে ২৬ এপ্রিল অনুষ্ঠিত এই সভার অবসরে আইএমএফের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দুই দফায় বৈঠকে বসেন উপদেষ্টা ও গভর্নরসহ ১২ সদস্যের প্রতিনিধিদল।
জানা গেছে, কোনো সমাধান ছাড়াই দুটি বৈঠক শেষ হয়। অথচ এই বৈঠকেই বাংলাদেশের ঋণ পাওয়ার বিষয়টি সুরাহা হওয়ার কথা ছিল। এই সময়ে শ্রীলঙ্কাকে ঋণের পঞ্চম কিস্তি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে সংস্থাটি। প্রাথমিক চুক্তিও (স্টাফ লেভেল এগ্রিমেন্ট) হয়েছে দেশটির সঙ্গে। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে উল্টো ঘটনা ঘটেছে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে এখন পর্যন্ত ঋণের কোনও কিস্তি পায়নি বাংলাদেশ। ঋণের চতুর্থ কিস্তি পাওয়ার কথা ছিল গত ডিসেম্বরে। শর্ত পূরণ না হওয়ায় সেটি মার্চে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মার্চেও মেলেনি কিস্তির ১১৫ কোটি ডলার। বেশ কিছু শর্তে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি একত্রে জুনে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল আন্তর্জাতিক এই ঋণদাতা সংস্থাটি।
জানা গেছে, আগামী জুন মাসে আইএমএফের পর্ষদ সভায় বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বিদ্যমান ঋণ চুক্তির কিস্তি ছাড়ের অনুমোদন হবে। এর এক মাস আগেই পর্ষদ সভার এজেন্ডায় ঋণ প্রস্তাবগুলো উঠতে হবে। ঋণ প্রস্তাব উঠতে হলে স্টাফ লেভেল এগ্রিমেন্ট করতে হবে বাংলাদেশকে। এ ধরনের কোনও চুক্তি এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সঙ্গে করেনি সংস্থাটি।
বৈঠক সূত্র জানায়, দুই দফার আলোচনায় আইএমএফ বেশিরভাগ শর্তে ছাড় দিতে নমনীয়তা দেখায়। পাশাপাশি বাংলাদেশও কিছুটা সময় নিয়ে মুদ্রা বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করাসহ রাজস্ব ও আর্থিক খাতের সংস্কারে রাজি হয়। তবে ডলার বিনিময় হার সংক্রান্ত আরেকটি শর্তে এসে আলোচনা আটকে যায়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ বিবেচনায় গভর্নর আহসান এইচ মনসুর এই শর্তে অসম্মতি প্রকাশ করেন। তবে সমঝোতা ছাড়াই আলোচনা শেষ হলেও ওই শর্তটিতে রাজি হওয়ার জন্য বাংলাদেশকে একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। ওই সময়সীমার মধ্যে বাংলাদেশ মত পাল্টালে আইএমএফের সঙ্গে স্টাফ লেভেল এগ্রিমেন্ট হতে পারে।
আইএমএফের ঋণ বাংলাদেশের জন্য কেন গুরুত্বপূর্ণ : আইএমএফের ঋণের দুই কিস্তি না পেলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে সতর্ক করেছেন বিশ্লেষকরা। যদিও গণমাধ্যমের কাছে গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, এই ঋণ না পেলে বাংলাদেশের কোনও সমস্যা হবে না। তবে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, রিজার্ভের চাপ এবং আমদানি-রপ্তানির ভারসাম্যহীনতার প্রেক্ষাপটে আইএমএফ থেকে ঋণ পাওয়া বাংলাদেশের জন্য কৌশলগত ও অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
অর্থনীতিবিদদের মতে, সংস্থাটি ঋণ দিতে অস্বীকৃতি জানালে বাংলাদেশের ঋণমান (ক্রেডিট রেটিং) কমে যেতে পারে। এতে আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং লেনদেন ব্যাহত হতে পারে। আমদানি-রপ্তানি ঋণপত্রের (এলসি) খরচ বৃদ্ধি পাবে এবং বৈদেশিক বাণিজ্যে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। পাশাপাশি বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) সহ অন্যান্য দাতা সংস্থা থেকে ঋণ প্রাপ্তি কঠিন হতে পারে।
দেখা গেছে, বাংলাদেশের রিজার্ভ গত কয়েক বছরে উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। ২০২১ সালে রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার থাকলেও বর্তমানে তা ২৭ বিলিয়ন ডলারের নিচে আছে। আইএমএফের ঋণ রিজার্ভ বাড়িয়ে আমদানি ও বিদেশি ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা বাড়াবে, যা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য। পাশাপাশি আইএমএফের ঋণ অন্যান্য ঋণদাতা সংস্থা যেমন বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকার কাছে বাংলাদেশের সুনাম বাড়ায়।
আইএমএফের শর্ত পূরণ করলে এসব সংস্থা থেকে সহজ শর্তে ঋণ পাওয়া যায়। এটি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ায় এবং বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণে সহায়ক। তবে অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন, আইএমএফের ঋণ স্বল্পমেয়াদে সহায়তা করলেও এর শর্ত যেমন বিভিন্ন খাতে সরকারি ভর্তুকি কমানো, সুদের হার বাড়ানোর মতো বিষয়গুলো সাধারণ মানুষকে দীর্ঘমেয়াদে কষ্টে ফেলতে পারে। তারা সতর্কবার্তা দিয়ে যাচ্ছেন, ইন্দোনেশিয়া ও আর্জেন্টিনার মতো দেশ আইএমএফের ঋণ নেওয়ার পর সংকটে পড়েছিল, যা বাংলাদেশকে বিবেচনায় নেওয়া উচিত।
এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নিতে গেলে তারা যে শর্তগুলো দেয়, তা সাধারণ মানুষের বিপক্ষে যায়। কারণ তারা ভর্তুকি কমাতে বলে, সুদের হার বাড়াতে বলে। সরকারের অন্যান্য গণমুখী নীতি থেকে বের হয়ে সরকারের ব্যয়ের চাপ কমাতে বলে। বাংলাদেশকে কিন্তু ২০১২ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত আইএমএফের ঋণ নিতে হয়নি। নিরুপায় হয়ে ২০২৩ সালে ঋণ নিয়েছে বাংলাদেশ।
তিনি বলেন, আইএমএফের ঋণে সংকট কাটানোর উদাহরণ তেমন একটা নেই। যেমন ইন্দোনেশিয়া বিপদে পড়ে আইএমএফের ঋণ নিয়েছিল। প্রাথমিকভাবে আইএমএফের প্রেসক্রিপশন তাদের অর্থনীতিকে ওলট-পালট করে দিয়েছিল। অনেক পরে এখন তারা সংকট কাটিয়ে উঠেছে। একই অবস্থায় পড়েছিল আর্জেন্টিনা। যে কারণে ১৯৯৭ সালে সংকটে পড়েও মালয়েশিয়া এই সংস্থাটির ঋণ নেয়নি। নিজেরাই সংস্কার করে সংকট কাটিয়ে উঠেছিল।
আইএমএফের ঋণ নিয়ে উপকৃত হয়েছে এমন রেকর্ড খুঁজে পাওয়া কষ্টকর উল্লেখ করে অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বলেন, তাদের ঋণ নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে অনেক দেরি হয়। কারণ, আইএমএফের প্রেসক্রিপশনের প্রধান উদ্দেশ্য কোনো দেশকে সংকট থেকে উদ্ধার করা নয়। তাদের এজেন্ডার মধ্যে ‘প্রো-ক্যাপিটালিস্ট’ বায়াস থাকে। এর প্রভাবে মানুষের আয় বৈষম্য বাড়ে, ধনীদের সম্পদ অনেক বেশি বেড়ে যায়। তিনি বলেন, আইএমএফের মূল দৃষ্টি থাকে যেই ঋণ আমরা নিচ্ছি, সেটা যেন ফেরত দিতে পারি।
এদিকে গত ২৫ এপ্রিল ওয়াশিংটনে গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, আইএমএফের ঋণ এখন দেশের অর্থনীতির জন্য খুব বেশি প্রয়োজনীয় নয়। তাদের ঋণের কিস্তি না পাওয়া গেলেও কোনো ক্ষতি হবে না। দেশের অর্থনীতি যেমন আছে, তেমনই চলবে। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে স্থানীয় সময় গত শুক্রবার আইএমএফের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের পর বাংলাদেশ মিশনের প্রেস মিনিস্টার গোলাম মর্তুজাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে গভর্নর এসব কথা বলেছেন।
আহসান মনসুর জোর দিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশের লক্ষ্য নিজস্ব আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার স্বাধীনভাবে বাস্তবায়ন করা।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে চলমান সংস্কার নিয়ে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতি নিয়ে বিশ্বে একটা ঝড় বইছে। এর প্রভাব বিশ্ব অর্থনীতিতে এবং বাংলাদেশে কতুটুক পড়বে, তা নিয়ে পর্যালোচনা চলছে। এ জন্য আইএমএফও কিছুটা পিছিয়ে রয়েছে। এসব কারণে তাদের সঙ্গে সমাধানের গন্তব্যে এখনও যাওয়া সম্ভব হয়নি। কিছু জায়গায় তাদের আরও কাজ করতে হবে। তাদের সঙ্গে দরকষাকষি বা নীতি আলোচনা চলছে। কিস্তি পাওয়া গেলে ভালো। না পেলেও কোনো ক্ষতি হবে না। তাদের সঙ্গে এখনও ঐকমত্য পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। পৌঁছাতে না পারলে খুব একটা অসুবিধা হবে, তাও নয়। বাংলাদেশের অবস্থা ভঙ্গুর নয়। যদি ঋণ না হয়, বাংলাদেশের অর্থনীতি যেভাবে চলছে, সেভাবেই চলবে।
গভর্নরের এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, গভর্নর যেটা বলেছেন সেটাই হয়তো ঠিক। কোনো আর্থিক সমস্যা নাও হতে পারে। তবে এতে বাংলাদেশের ইমেজ নষ্ট হবে। কারণ শর্ত পূরণ করতে না পারায় বাংলাদেশ ঋণ পায়নি এটি ভালো দেখাবে না।
তিনি বলেন, সম্প্রতি একটি বিনিয়োগ সম্মেলন হয়ে গেল, সরকার যেটিকে সফল হিসেবে দাবি করেছে। এখন যদি আইএমএফের সঙ্গে আমাদের ঝামেলা হয় তাহলে সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীরা শঙ্কিত হতে পারে।
আইএমএফের কর্মকর্তাদের বিভিন্ন সময়ের বক্তব্য থেকে জানা গেছে, চতুর্থ কিস্তিতে অর্থ পেতে বাংলাদেশের জন্য শর্ত ছিল চারটি। সেগুলো হলো- অর্থনীতির বহিঃচাপ সামাল দিতে রাজস্ব আদায় জোরদার করা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আরও সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি, বিদেশি মুদ্রার বিনিময় হার পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করা এবং জলবায়ু পরিবর্তন প্রশ্নে সবুজ প্রবৃদ্ধি নিশ্চিতে নীতিমালার বাস্তবায়ন।
এর মধ্যে বিনিময় হার ও রাজস্ব আহরণ নিয়ে শর্ত পূরণের অগ্রগতি নিয়ে ওই সময় আইএমএফ সন্তুষ্ট হতে পারেনি। পরে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি পেতে আরও কিছু শর্ত জুড়ে দেয় সংস্থাটি। এর মধ্যে চারটি শর্তের বিষয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে। এগুলো হলো, রাজস্ব আয়ের ভালো প্রবৃদ্ধি না হওয়া, বিনিময় হার বাজারভিত্তিক না হওয়া, ভর্তুকি না কমা এবং ব্যাংক খাতের আশানুরূপ উন্নতি না হওয়া। এসবের বাইরেও আরেকটি অপ্রকাশিত শর্ত নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা চালিয়েছে সংস্থাটি। ওই শর্তে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত পুরোপুরি অনমনীয়। শেষ পর্যন্ত ওই শর্তের জালেই আটকে যেতে পারে আইএমএফের ঋণের অর্থ। তবে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, বাংলাদেশ যদি নিজেদের জাতীয় স্বার্থ অক্ষুণ্ন রেখে ঋণের অর্থ আদায় করে নিতে পারে, সেটি বড় সাফল্য হবে।
ভোরের আকাশ/এসএইচ
শর্ত পূরণে বাংলাদেশ অনড়
তাকী মোহাম্মদ জোবায়ের
প্রকাশ : ২৩ ঘন্টা আগে
আপডেট : ২৬ মিনিট আগে
আইএমএফের ঋণ অনিশ্চিত
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের সাথে বাংলাদেশের ঋণ চুক্তির চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। মুদ্রা বিনিময় হার সংক্রান্ত একটি শর্তে ঋণ প্রক্রিয়াটি আটকে গেছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। আইএমএফ কর্তৃপক্ষ শর্ত পূরণের জন্য সময়সীমা বেঁধে দিলেও বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত এই বিষয়ে অনড় অবস্থান বজায় রেখেছে। এমন অবস্থায় ঋণ সংক্রান্ত আলোচনায় সমাধানে পৌঁছানো ছাড়াই ঢাকার উদ্দেশ্যে ওয়াশিংটন ত্যাগ করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। আইএমএফের সঙ্গে বিদ্যমান ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তির চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির ১৩০ কোটি ডলার পাওয়ার কথা ছিল আগামী জুনের শেষে।
বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের বসন্তকালীন সভায় যোগ দিতে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে গভর্নর সহ উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল যুক্তরাষ্ট্র সফর করে। গত ২১ এপ্রিল থেকে ২৬ এপ্রিল অনুষ্ঠিত এই সভার অবসরে আইএমএফের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দুই দফায় বৈঠকে বসেন উপদেষ্টা ও গভর্নরসহ ১২ সদস্যের প্রতিনিধিদল।
জানা গেছে, কোনো সমাধান ছাড়াই দুটি বৈঠক শেষ হয়। অথচ এই বৈঠকেই বাংলাদেশের ঋণ পাওয়ার বিষয়টি সুরাহা হওয়ার কথা ছিল। এই সময়ে শ্রীলঙ্কাকে ঋণের পঞ্চম কিস্তি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে সংস্থাটি। প্রাথমিক চুক্তিও (স্টাফ লেভেল এগ্রিমেন্ট) হয়েছে দেশটির সঙ্গে। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে উল্টো ঘটনা ঘটেছে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে এখন পর্যন্ত ঋণের কোনও কিস্তি পায়নি বাংলাদেশ। ঋণের চতুর্থ কিস্তি পাওয়ার কথা ছিল গত ডিসেম্বরে। শর্ত পূরণ না হওয়ায় সেটি মার্চে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মার্চেও মেলেনি কিস্তির ১১৫ কোটি ডলার। বেশ কিছু শর্তে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি একত্রে জুনে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল আন্তর্জাতিক এই ঋণদাতা সংস্থাটি।
জানা গেছে, আগামী জুন মাসে আইএমএফের পর্ষদ সভায় বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বিদ্যমান ঋণ চুক্তির কিস্তি ছাড়ের অনুমোদন হবে। এর এক মাস আগেই পর্ষদ সভার এজেন্ডায় ঋণ প্রস্তাবগুলো উঠতে হবে। ঋণ প্রস্তাব উঠতে হলে স্টাফ লেভেল এগ্রিমেন্ট করতে হবে বাংলাদেশকে। এ ধরনের কোনও চুক্তি এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সঙ্গে করেনি সংস্থাটি।
বৈঠক সূত্র জানায়, দুই দফার আলোচনায় আইএমএফ বেশিরভাগ শর্তে ছাড় দিতে নমনীয়তা দেখায়। পাশাপাশি বাংলাদেশও কিছুটা সময় নিয়ে মুদ্রা বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করাসহ রাজস্ব ও আর্থিক খাতের সংস্কারে রাজি হয়। তবে ডলার বিনিময় হার সংক্রান্ত আরেকটি শর্তে এসে আলোচনা আটকে যায়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ বিবেচনায় গভর্নর আহসান এইচ মনসুর এই শর্তে অসম্মতি প্রকাশ করেন। তবে সমঝোতা ছাড়াই আলোচনা শেষ হলেও ওই শর্তটিতে রাজি হওয়ার জন্য বাংলাদেশকে একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। ওই সময়সীমার মধ্যে বাংলাদেশ মত পাল্টালে আইএমএফের সঙ্গে স্টাফ লেভেল এগ্রিমেন্ট হতে পারে।
আইএমএফের ঋণ বাংলাদেশের জন্য কেন গুরুত্বপূর্ণ : আইএমএফের ঋণের দুই কিস্তি না পেলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে সতর্ক করেছেন বিশ্লেষকরা। যদিও গণমাধ্যমের কাছে গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, এই ঋণ না পেলে বাংলাদেশের কোনও সমস্যা হবে না। তবে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, রিজার্ভের চাপ এবং আমদানি-রপ্তানির ভারসাম্যহীনতার প্রেক্ষাপটে আইএমএফ থেকে ঋণ পাওয়া বাংলাদেশের জন্য কৌশলগত ও অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
অর্থনীতিবিদদের মতে, সংস্থাটি ঋণ দিতে অস্বীকৃতি জানালে বাংলাদেশের ঋণমান (ক্রেডিট রেটিং) কমে যেতে পারে। এতে আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং লেনদেন ব্যাহত হতে পারে। আমদানি-রপ্তানি ঋণপত্রের (এলসি) খরচ বৃদ্ধি পাবে এবং বৈদেশিক বাণিজ্যে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। পাশাপাশি বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) সহ অন্যান্য দাতা সংস্থা থেকে ঋণ প্রাপ্তি কঠিন হতে পারে।
দেখা গেছে, বাংলাদেশের রিজার্ভ গত কয়েক বছরে উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। ২০২১ সালে রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার থাকলেও বর্তমানে তা ২৭ বিলিয়ন ডলারের নিচে আছে। আইএমএফের ঋণ রিজার্ভ বাড়িয়ে আমদানি ও বিদেশি ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা বাড়াবে, যা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য। পাশাপাশি আইএমএফের ঋণ অন্যান্য ঋণদাতা সংস্থা যেমন বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকার কাছে বাংলাদেশের সুনাম বাড়ায়।
আইএমএফের শর্ত পূরণ করলে এসব সংস্থা থেকে সহজ শর্তে ঋণ পাওয়া যায়। এটি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ায় এবং বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণে সহায়ক। তবে অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন, আইএমএফের ঋণ স্বল্পমেয়াদে সহায়তা করলেও এর শর্ত যেমন বিভিন্ন খাতে সরকারি ভর্তুকি কমানো, সুদের হার বাড়ানোর মতো বিষয়গুলো সাধারণ মানুষকে দীর্ঘমেয়াদে কষ্টে ফেলতে পারে। তারা সতর্কবার্তা দিয়ে যাচ্ছেন, ইন্দোনেশিয়া ও আর্জেন্টিনার মতো দেশ আইএমএফের ঋণ নেওয়ার পর সংকটে পড়েছিল, যা বাংলাদেশকে বিবেচনায় নেওয়া উচিত।
এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নিতে গেলে তারা যে শর্তগুলো দেয়, তা সাধারণ মানুষের বিপক্ষে যায়। কারণ তারা ভর্তুকি কমাতে বলে, সুদের হার বাড়াতে বলে। সরকারের অন্যান্য গণমুখী নীতি থেকে বের হয়ে সরকারের ব্যয়ের চাপ কমাতে বলে। বাংলাদেশকে কিন্তু ২০১২ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত আইএমএফের ঋণ নিতে হয়নি। নিরুপায় হয়ে ২০২৩ সালে ঋণ নিয়েছে বাংলাদেশ।
তিনি বলেন, আইএমএফের ঋণে সংকট কাটানোর উদাহরণ তেমন একটা নেই। যেমন ইন্দোনেশিয়া বিপদে পড়ে আইএমএফের ঋণ নিয়েছিল। প্রাথমিকভাবে আইএমএফের প্রেসক্রিপশন তাদের অর্থনীতিকে ওলট-পালট করে দিয়েছিল। অনেক পরে এখন তারা সংকট কাটিয়ে উঠেছে। একই অবস্থায় পড়েছিল আর্জেন্টিনা। যে কারণে ১৯৯৭ সালে সংকটে পড়েও মালয়েশিয়া এই সংস্থাটির ঋণ নেয়নি। নিজেরাই সংস্কার করে সংকট কাটিয়ে উঠেছিল।
আইএমএফের ঋণ নিয়ে উপকৃত হয়েছে এমন রেকর্ড খুঁজে পাওয়া কষ্টকর উল্লেখ করে অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বলেন, তাদের ঋণ নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে অনেক দেরি হয়। কারণ, আইএমএফের প্রেসক্রিপশনের প্রধান উদ্দেশ্য কোনো দেশকে সংকট থেকে উদ্ধার করা নয়। তাদের এজেন্ডার মধ্যে ‘প্রো-ক্যাপিটালিস্ট’ বায়াস থাকে। এর প্রভাবে মানুষের আয় বৈষম্য বাড়ে, ধনীদের সম্পদ অনেক বেশি বেড়ে যায়। তিনি বলেন, আইএমএফের মূল দৃষ্টি থাকে যেই ঋণ আমরা নিচ্ছি, সেটা যেন ফেরত দিতে পারি।
এদিকে গত ২৫ এপ্রিল ওয়াশিংটনে গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, আইএমএফের ঋণ এখন দেশের অর্থনীতির জন্য খুব বেশি প্রয়োজনীয় নয়। তাদের ঋণের কিস্তি না পাওয়া গেলেও কোনো ক্ষতি হবে না। দেশের অর্থনীতি যেমন আছে, তেমনই চলবে। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে স্থানীয় সময় গত শুক্রবার আইএমএফের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের পর বাংলাদেশ মিশনের প্রেস মিনিস্টার গোলাম মর্তুজাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে গভর্নর এসব কথা বলেছেন।
আহসান মনসুর জোর দিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশের লক্ষ্য নিজস্ব আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার স্বাধীনভাবে বাস্তবায়ন করা।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে চলমান সংস্কার নিয়ে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতি নিয়ে বিশ্বে একটা ঝড় বইছে। এর প্রভাব বিশ্ব অর্থনীতিতে এবং বাংলাদেশে কতুটুক পড়বে, তা নিয়ে পর্যালোচনা চলছে। এ জন্য আইএমএফও কিছুটা পিছিয়ে রয়েছে। এসব কারণে তাদের সঙ্গে সমাধানের গন্তব্যে এখনও যাওয়া সম্ভব হয়নি। কিছু জায়গায় তাদের আরও কাজ করতে হবে। তাদের সঙ্গে দরকষাকষি বা নীতি আলোচনা চলছে। কিস্তি পাওয়া গেলে ভালো। না পেলেও কোনো ক্ষতি হবে না। তাদের সঙ্গে এখনও ঐকমত্য পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। পৌঁছাতে না পারলে খুব একটা অসুবিধা হবে, তাও নয়। বাংলাদেশের অবস্থা ভঙ্গুর নয়। যদি ঋণ না হয়, বাংলাদেশের অর্থনীতি যেভাবে চলছে, সেভাবেই চলবে।
গভর্নরের এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, গভর্নর যেটা বলেছেন সেটাই হয়তো ঠিক। কোনো আর্থিক সমস্যা নাও হতে পারে। তবে এতে বাংলাদেশের ইমেজ নষ্ট হবে। কারণ শর্ত পূরণ করতে না পারায় বাংলাদেশ ঋণ পায়নি এটি ভালো দেখাবে না।
তিনি বলেন, সম্প্রতি একটি বিনিয়োগ সম্মেলন হয়ে গেল, সরকার যেটিকে সফল হিসেবে দাবি করেছে। এখন যদি আইএমএফের সঙ্গে আমাদের ঝামেলা হয় তাহলে সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীরা শঙ্কিত হতে পারে।
আইএমএফের কর্মকর্তাদের বিভিন্ন সময়ের বক্তব্য থেকে জানা গেছে, চতুর্থ কিস্তিতে অর্থ পেতে বাংলাদেশের জন্য শর্ত ছিল চারটি। সেগুলো হলো- অর্থনীতির বহিঃচাপ সামাল দিতে রাজস্ব আদায় জোরদার করা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আরও সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি, বিদেশি মুদ্রার বিনিময় হার পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করা এবং জলবায়ু পরিবর্তন প্রশ্নে সবুজ প্রবৃদ্ধি নিশ্চিতে নীতিমালার বাস্তবায়ন।
এর মধ্যে বিনিময় হার ও রাজস্ব আহরণ নিয়ে শর্ত পূরণের অগ্রগতি নিয়ে ওই সময় আইএমএফ সন্তুষ্ট হতে পারেনি। পরে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি পেতে আরও কিছু শর্ত জুড়ে দেয় সংস্থাটি। এর মধ্যে চারটি শর্তের বিষয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে। এগুলো হলো, রাজস্ব আয়ের ভালো প্রবৃদ্ধি না হওয়া, বিনিময় হার বাজারভিত্তিক না হওয়া, ভর্তুকি না কমা এবং ব্যাংক খাতের আশানুরূপ উন্নতি না হওয়া। এসবের বাইরেও আরেকটি অপ্রকাশিত শর্ত নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা চালিয়েছে সংস্থাটি। ওই শর্তে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত পুরোপুরি অনমনীয়। শেষ পর্যন্ত ওই শর্তের জালেই আটকে যেতে পারে আইএমএফের ঋণের অর্থ। তবে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, বাংলাদেশ যদি নিজেদের জাতীয় স্বার্থ অক্ষুণ্ন রেখে ঋণের অর্থ আদায় করে নিতে পারে, সেটি বড় সাফল্য হবে।
ভোরের আকাশ/এসএইচ