তাকী মোহাম্মদ জোবায়ের
প্রকাশ : ০৩ মে ২০২৫ ১১:০৯ এএম
শেয়ারবাজারে আস্থা হারাচ্ছে বিদেশিরা
দেশের পুঁজিবাজারে দীর্ঘদিন ধরেই খরা চলছে। গত সারে ৮ মাসে দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ডিএসই’র সূচক কমেছে সারে ১৪ শতাংশ। বাজার মূলধন কমেছে প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা। এই পরিস্থিতিতে বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও বাংলাদেশ ছাড়া অব্যাহত রেখেছেন। প্রতিদিনই কোনো না কোনো বিনিয়োগকারী দেশের শেয়ারবাজার থেকে বের হয়ে যাচ্ছেন।
গত এপ্রিল মাসেই ১৩৪ জন বিদেশি ও প্রবাসী বিনিয়োগকারী বাংলাদেশ ছেড়ে গেছেন। দেখা গেছে, ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকেই বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশ ছাড়া শুরু করেছেন যা এখনও অব্যাহত রয়েছে।
একটি শেয়ারবাজার কতটা শক্তিশালী তা পরিমাপের অন্যতম সূচক হচ্ছে বিদেশি বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ও বিনিয়োগের পরিমাণ।
বিদেশি বিনিয়োগকারী বেড়িয়ে যাওয়া হলো বাজার দুর্বল হওয়ার ইঙ্গিত। এই বিনিয়োগকারীর হিসাব পাওয়া যায় বিও বা বেনিফিশিয়ারি ওনার্স একাউন্টের সংখ্যা গুণে। বিও হলো শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের জন্য ব্রোকারেজ হাউস অথবা মার্চেন্ট ব্যাংকে একজন বিনিয়োগকারীর খোলা হিসাব। এই বিও হিসাবের মাধ্যমেই বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজারে লেনদেন করেন।
এই হিসাবে, ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত দেড় বছরে ৯ হাজারের বেশি বিদেশি ও প্রবাসী বিনিয়োগকারী বাংলাদেশ ছেড়েছেন। অর্থাৎ, এই সংখ্যাক বিও হিসাব বন্ধ হয়েছে আলোচ্য সময়ে। বিও হিসাবের তথ্য রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করে সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিডিবিএল)। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে পড়ে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন শেখ হাসিনা। পদত্যাগ করে তিনি দেশে ছেড়ে পালিয়ে যান। সরকার পতনের পর ৮ আগস্ট দেশ চালানোর দায়িত্ব নেয় অন্তর্র্বর্তী সরকার।
এরই মধ্যে এই সরকারের ৮ মাস পার হয়েছে। হাসিনার সরকার পতনের পর প্রথম চার কার্যদিবস শেয়ারবাজারে বড় উত্থান হলেও অন্তর্র্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর শেয়ারবাজারে পতনের পাল্লা ভারী হয়েছে। এই সময়ে বিদেশি ও প্রবাসী বিনিয়োগকারীর সংখ্যা কমছে। সিডিবিএলের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বিদেশি ও প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব আছে ৪৬ হাজার ৩৬০টি। ২০২৪ সাল শেষে বিদেশি ও প্রবাসীদের বিও হিসাব ছিল ৪৬ হাজার ৬৯১টি। অর্থাৎ চলতি বছরে বিদেশি ও প্রবাসীদের বিও হিসাব কমেছে ৩৩১টি। এর মধ্যে এপ্রিল মাসেই কমেছে ১৩৪টি।
অপরদিকে হাসিনা সরকার পতনের সময় বিদেশি ও প্রবাসীদের বিও হিসাব ছিল ৪৭ হাজার ৮৪টি। আর অন্তর্র্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার দিন ছিল ৪৭ হাজার ৮১টি। অর্থাৎ বিদেশি ও প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব ধারাবাহিকভাবে কমেছে। এর মধ্যে অন্তর্র্বর্তী সরকারের মেয়াদে কমেছে ৭২১টি। বিদেশিদের বাংলাদেশের শেয়ারবাজার ছাড়ার এই প্রবণতা চলছে আরও আগে থেকেই। ২০২৩ নভেম্বর থেকে ধারাবাহিকভাবে বিদেশি ও প্রবাসীদের বিও হিসাব কমছে। ২০২৩ সালের ২৯ অক্টোবর বিদেশি ও প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের নামে বিও হিসাব ছিল ৫৫ হাজার ৫১২টি।
এ হিসাবে ২০২৩ সালের ২৯ অক্টোবরের পর দেশের শেয়ারবাজারে বিদেশি ও প্রবাসীদের নামে বিও হিসাব কমেছে ৯ হাজার ১৫২টি। দেশে বিনিয়োগের খরা কাটছেই না। উল্টো তলানিতে থাকা বিনিয়োগ আরো কমেছে। বিনিয়োগের সম্ভাবনা নিয়ে সব সময় আশার কথা শোনানো হলে বাস্তবতা বলছে ভিন্নকথা। বিনিয়োগ কম হওয়ার বিরূপ প্রভাব দৃশ্যমান হয়েছে অর্থনীতিতেও।
সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগও তলানিতে : শুধু শেয়ারবাজার নয়, পাঁচ বছরের সর্বনিম্ন অবস্থানে পৌঁছেছে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই।
জানা গেছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে নেট ৮২ কোটি ৪০ লাখ ডলারের এফডিআই এসেছে বাংলাদেশে। আগের অর্থবছরের একই সময় ১০৩ কোটি ২০ লাখ ডলার এসেছিল। সে হিসাবে আট মাসে বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ২০.১৫ শতাংশ। বছরের হিসেবে ২০২৪ সালে গত পাঁচ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম নেট বা প্রকৃত এফডিআই এসেছে বাংলাদেশে। দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক সংকট, ডলার ঘাটতি এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে। বিশেষ করে ব্যবসার অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত না হওয়ায় বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানো সম্ভব হয়নি বলে মত দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
গবেষণা সংস্থা সিপিডি জানিয়েছে, বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে হলে অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাাশি গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহের দিকে নজর দিতে হবে। একই সঙ্গে রিজার্ভ পরিস্থিতির উন্নতি করা প্রয়োজন। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যদি ব্যবসার মুনাফা নিজ দেশে ফেরত নিয়ে যেতে না পারেন তাহলে তারা নিরুৎসাহিত হবেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বার্ষিক বিবেচনায়ও বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে। ২০২৪ সালে দেশে মোট নিট এফডিআই এসেছে ১.২৭ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ১৩.২৫ শতাংশ কম। ২০২৩ সালে এই অঙ্ক ছিল ১.৪৬ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলার কমেছে এফডিআই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২১ সালে দেশে নিট এফডিআই এসেছিল ১.৫৭ বিলিয়ন ডলার, এরপর থেকে প্রতিবছর আগের বছরের তুলনায় এফডিআই কমেছে। সব মিলিয়ে ২০২০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৪ সালে সবচেয়ে কম এফডিআই এসেছে। ২০২৪ সালে আসা মোট এফডিআইয়ের মধ্যে ৬২২ মিলিয়ন ডলার ছিল রিইনভেস্টেড আর্নিংস অর্থাৎ পুরনো বিনিয়োগ থেকে আয় আবার বিনিয়োগ করা। এটি মোট এফডিআইয়ের প্রায় ৪৯ শতাংশ। এ ছাড়া ইক্যুইটি ক্যাপিটাল এসেছে ৫৪৫ মিলিয়ন ডলার এবং ইন্ট্রা-কোম্পানি লোন বা আন্ত কোম্পানি ঋণ এসেছে ১০৪ মিলিয়ন ডলার।
রি-ইনভেস্টমেন্ট বিষয়ে জানা গেছে, বিনিয়োগকারীরা অনেক সময় ডলার সংকট ও অন্যান্য প্রতিবন্ধকতায় আয় ফিরিয়ে নিতে পারেন না। তাই বাধ্য হয়ে পুনর্বিনিয়োগ করেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ এসেছে ব্যাংকিং খাতে-৪১৬ মিলিয়ন ডলার। এরপর রয়েছে টেক্সটাইল ও গার্মেন্ট খাত-৪০৭ মিলিয়ন ডলার। ওষুধ ও রাসায়নিক, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জ্বালানি এবং খাদ্য খাতেও উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ এসেছে।
বিদেশি বিনিয়োগে শীর্ষে থাকা ৮ কোম্পানি : প্রতিদিনই বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশ ছেড়ে গেলেও এখনও আটটি কোম্পানিতে তাদের আস্থা ধরে রেখেছে। এসব কোম্পানির এক দশমাংশের বেশি শেয়ার বিদেশিদের হাতে রয়েছে। এসব কোম্পানির মধ্যে রয়েছে অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ, ব্র্যাক ব্যাংক, বিএসআরএম লিমিটেড, বেক্সিমকো ফার্মা, ইসলামী ব্যাংক, নাভানা ফার্মা, রেনেটা ও স্কয়ার ফার্মা। এগুলোতে বিদেশিদের বিনিয়োগ রয়েছে ১০ শতাংশ থেকে ৩৪ শতাংশের বেশি। বর্তমানে অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজে বিদেশিদের সর্বোচ্চ বিনিয়োগ রয়েছে। এই বিনিয়োগের পরিমাণ ৩৪.২৫ শতাংশে পৌঁছেছে।
গত বছর ৩১ জুন কোম্পানিটিতে বিদেশিদের শেয়ার ছিল ২৩.৯৭ শতাংশ, যা পরে ১০.২৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই কোম্পানিটি ২০২৪ সালে বিনিয়োগকারীদের ১০ শতাংশ ক্যাশ ডিভিডেন্ড দিয়েছে। ২০২৩ সালে যেখানে ডিভিডেন্ড দিয়েছিল ৬০ শতাংশ। আগের বছরগুলোতে কোম্পানিটির ডিভিডেন্ডের পরিমাণ ৪০ শতাংশের নিচে নামেনি। বিদেশি বিনিয়োগের দিক দিয়ে এর পরেই রয়েছে ব্র্যাক ব্যাংকের অবস্থান। এখানে বিনিয়োগ রয়েছে ৩২.২০ শতাংশ। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে কোম্পানিটিতে বিদেশিদের শেয়ার ছিল ৩২.০৯ শতাংশ। ফেব্রুয়ারি মাসে ০.১১ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২.২০ শতাংশে। ২০২৪ সালে কোম্পানিটি ১০ শতাংশ ক্যাশ ও ১০ শতাংশ বোনাস ডিভিডেন্ড দিয়েছে। ২০২৩ সালে ডিভিডেন্ড দিয়েছিল ৭.৫০ শতাংশ ক্যাশ ও ৭.৫০ শতাংশ বোনাস।
এদিকে বেক্সিমকো ফার্মায় বিদেশিদের শেয়ার ধারন বেড়েছে। বর্তমানে ২৭.১২ শতাংশ শেয়ার বিদেশিদের কাছে। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে কোম্পানিটিতে এই শেয়ার ছিল ২৭.১১ শতাংশ। ফেব্রুয়ারি মাসে ০.০১ শতাংশ বেড়েছে। কোম্পানিটি ২০২৪ সালে ৪০ শতাংশ ক্যাশ ডিভিডেন্ড দিয়েছে। ২০২৩ সালে ডিভিডেন্ড দিয়েছিল ৩৫ শতাংশ ক্যাশ। ইসলামী ব্যাংকেও বিদেশি শেয়ার বেড়েছে। বর্তমানে ১৭.৮৯ শতাংশ শেয়ারধারী বিদেশি।
গত বছর ৩১ জুন কোম্পানিটিতে এই শেয়ার ছিল ১৩.১৬ শতাংশ। এরপর বিদেশিরা কোম্পানিটিতে ৪.৭৩ শতাংশ মালিকানা বাড়িয়েছেন। কোম্পানিটি ২০২৪ সালে ১০ শতাংশ ক্যাশ ডিভিডেন্ড দিয়েছে। ২০১৯ সাল থেকে কোম্পানিটি একই পরিমাণ ১০ শতাংশ ক্যাশ ডিভিডেন্ড দিয়ে আসছে। বিএসআরএম লিমিটেডে বিদেশি শেয়ার কমেছে। এখানে এই শেয়ার রয়েছে ১৭.০৮ শতাংশ। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে কোম্পানিটিতে বিদেশিদের শেয়ার ছিল ১৭.১২ শতাংশ। ফেব্রুয়ারি মাসে তাদের শেয়ার ০.০৪ শতাংশ কমেছে। নাভানা ফার্মায় বিদেশিদের শেয়ার বেশ কমেছে। বর্তমানে রয়েছে ১৯.৬৪ শতাংশ।
গত বছর ৩১ জুন কোম্পানিটিতে বিদেশিদের শেয়ার ছিল ২৭.৭৩ শতাংশ। চলতি বছর ৮.৯৩ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ১৯.৬৪ শতাংশে। রেনেটা ফার্মায় বিদেশিদের শেয়ার রয়েছে ২০.৮৯ শতাংশ। গত বছর ৩১ জুন কোম্পানিটিতে বিদেশিদের শেয়ার ছিল ২২.২৩ শতাংশ, যা ১.৩৪ শতাংশ কমে বর্তমানে ২০.৮৯ শতাংশে নেমেছে। স্কয়ার ফার্মায় বিদেশি বিনিয়োগকারীদের শেয়ার রয়েছে ১৫.৪৫ শতাংশ। গত বছর ৩১ জুন কোম্পানিটিতে বিদেশিদের শেয়ার ছিল ১৩.৭৬ শতাংশ, যা পরবর্তীতে বেড়ে ১.৬৯ শতাংশ হয়েছে।
ভোরের আকাশ/এসএইচ
তাকী মোহাম্মদ জোবায়ের
প্রকাশ : ১ দিন আগে
আপডেট : ১ ঘন্টা আগে
শেয়ারবাজারে আস্থা হারাচ্ছে বিদেশিরা
দেশের পুঁজিবাজারে দীর্ঘদিন ধরেই খরা চলছে। গত সারে ৮ মাসে দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ডিএসই’র সূচক কমেছে সারে ১৪ শতাংশ। বাজার মূলধন কমেছে প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা। এই পরিস্থিতিতে বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও বাংলাদেশ ছাড়া অব্যাহত রেখেছেন। প্রতিদিনই কোনো না কোনো বিনিয়োগকারী দেশের শেয়ারবাজার থেকে বের হয়ে যাচ্ছেন।
গত এপ্রিল মাসেই ১৩৪ জন বিদেশি ও প্রবাসী বিনিয়োগকারী বাংলাদেশ ছেড়ে গেছেন। দেখা গেছে, ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকেই বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশ ছাড়া শুরু করেছেন যা এখনও অব্যাহত রয়েছে।
একটি শেয়ারবাজার কতটা শক্তিশালী তা পরিমাপের অন্যতম সূচক হচ্ছে বিদেশি বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ও বিনিয়োগের পরিমাণ।
বিদেশি বিনিয়োগকারী বেড়িয়ে যাওয়া হলো বাজার দুর্বল হওয়ার ইঙ্গিত। এই বিনিয়োগকারীর হিসাব পাওয়া যায় বিও বা বেনিফিশিয়ারি ওনার্স একাউন্টের সংখ্যা গুণে। বিও হলো শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের জন্য ব্রোকারেজ হাউস অথবা মার্চেন্ট ব্যাংকে একজন বিনিয়োগকারীর খোলা হিসাব। এই বিও হিসাবের মাধ্যমেই বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজারে লেনদেন করেন।
এই হিসাবে, ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত দেড় বছরে ৯ হাজারের বেশি বিদেশি ও প্রবাসী বিনিয়োগকারী বাংলাদেশ ছেড়েছেন। অর্থাৎ, এই সংখ্যাক বিও হিসাব বন্ধ হয়েছে আলোচ্য সময়ে। বিও হিসাবের তথ্য রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করে সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিডিবিএল)। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে পড়ে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন শেখ হাসিনা। পদত্যাগ করে তিনি দেশে ছেড়ে পালিয়ে যান। সরকার পতনের পর ৮ আগস্ট দেশ চালানোর দায়িত্ব নেয় অন্তর্র্বর্তী সরকার।
এরই মধ্যে এই সরকারের ৮ মাস পার হয়েছে। হাসিনার সরকার পতনের পর প্রথম চার কার্যদিবস শেয়ারবাজারে বড় উত্থান হলেও অন্তর্র্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর শেয়ারবাজারে পতনের পাল্লা ভারী হয়েছে। এই সময়ে বিদেশি ও প্রবাসী বিনিয়োগকারীর সংখ্যা কমছে। সিডিবিএলের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বিদেশি ও প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব আছে ৪৬ হাজার ৩৬০টি। ২০২৪ সাল শেষে বিদেশি ও প্রবাসীদের বিও হিসাব ছিল ৪৬ হাজার ৬৯১টি। অর্থাৎ চলতি বছরে বিদেশি ও প্রবাসীদের বিও হিসাব কমেছে ৩৩১টি। এর মধ্যে এপ্রিল মাসেই কমেছে ১৩৪টি।
অপরদিকে হাসিনা সরকার পতনের সময় বিদেশি ও প্রবাসীদের বিও হিসাব ছিল ৪৭ হাজার ৮৪টি। আর অন্তর্র্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার দিন ছিল ৪৭ হাজার ৮১টি। অর্থাৎ বিদেশি ও প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব ধারাবাহিকভাবে কমেছে। এর মধ্যে অন্তর্র্বর্তী সরকারের মেয়াদে কমেছে ৭২১টি। বিদেশিদের বাংলাদেশের শেয়ারবাজার ছাড়ার এই প্রবণতা চলছে আরও আগে থেকেই। ২০২৩ নভেম্বর থেকে ধারাবাহিকভাবে বিদেশি ও প্রবাসীদের বিও হিসাব কমছে। ২০২৩ সালের ২৯ অক্টোবর বিদেশি ও প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের নামে বিও হিসাব ছিল ৫৫ হাজার ৫১২টি।
এ হিসাবে ২০২৩ সালের ২৯ অক্টোবরের পর দেশের শেয়ারবাজারে বিদেশি ও প্রবাসীদের নামে বিও হিসাব কমেছে ৯ হাজার ১৫২টি। দেশে বিনিয়োগের খরা কাটছেই না। উল্টো তলানিতে থাকা বিনিয়োগ আরো কমেছে। বিনিয়োগের সম্ভাবনা নিয়ে সব সময় আশার কথা শোনানো হলে বাস্তবতা বলছে ভিন্নকথা। বিনিয়োগ কম হওয়ার বিরূপ প্রভাব দৃশ্যমান হয়েছে অর্থনীতিতেও।
সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগও তলানিতে : শুধু শেয়ারবাজার নয়, পাঁচ বছরের সর্বনিম্ন অবস্থানে পৌঁছেছে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই।
জানা গেছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে নেট ৮২ কোটি ৪০ লাখ ডলারের এফডিআই এসেছে বাংলাদেশে। আগের অর্থবছরের একই সময় ১০৩ কোটি ২০ লাখ ডলার এসেছিল। সে হিসাবে আট মাসে বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ২০.১৫ শতাংশ। বছরের হিসেবে ২০২৪ সালে গত পাঁচ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম নেট বা প্রকৃত এফডিআই এসেছে বাংলাদেশে। দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক সংকট, ডলার ঘাটতি এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে। বিশেষ করে ব্যবসার অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত না হওয়ায় বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানো সম্ভব হয়নি বলে মত দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
গবেষণা সংস্থা সিপিডি জানিয়েছে, বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে হলে অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাাশি গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহের দিকে নজর দিতে হবে। একই সঙ্গে রিজার্ভ পরিস্থিতির উন্নতি করা প্রয়োজন। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যদি ব্যবসার মুনাফা নিজ দেশে ফেরত নিয়ে যেতে না পারেন তাহলে তারা নিরুৎসাহিত হবেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বার্ষিক বিবেচনায়ও বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে। ২০২৪ সালে দেশে মোট নিট এফডিআই এসেছে ১.২৭ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ১৩.২৫ শতাংশ কম। ২০২৩ সালে এই অঙ্ক ছিল ১.৪৬ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলার কমেছে এফডিআই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২১ সালে দেশে নিট এফডিআই এসেছিল ১.৫৭ বিলিয়ন ডলার, এরপর থেকে প্রতিবছর আগের বছরের তুলনায় এফডিআই কমেছে। সব মিলিয়ে ২০২০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৪ সালে সবচেয়ে কম এফডিআই এসেছে। ২০২৪ সালে আসা মোট এফডিআইয়ের মধ্যে ৬২২ মিলিয়ন ডলার ছিল রিইনভেস্টেড আর্নিংস অর্থাৎ পুরনো বিনিয়োগ থেকে আয় আবার বিনিয়োগ করা। এটি মোট এফডিআইয়ের প্রায় ৪৯ শতাংশ। এ ছাড়া ইক্যুইটি ক্যাপিটাল এসেছে ৫৪৫ মিলিয়ন ডলার এবং ইন্ট্রা-কোম্পানি লোন বা আন্ত কোম্পানি ঋণ এসেছে ১০৪ মিলিয়ন ডলার।
রি-ইনভেস্টমেন্ট বিষয়ে জানা গেছে, বিনিয়োগকারীরা অনেক সময় ডলার সংকট ও অন্যান্য প্রতিবন্ধকতায় আয় ফিরিয়ে নিতে পারেন না। তাই বাধ্য হয়ে পুনর্বিনিয়োগ করেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ এসেছে ব্যাংকিং খাতে-৪১৬ মিলিয়ন ডলার। এরপর রয়েছে টেক্সটাইল ও গার্মেন্ট খাত-৪০৭ মিলিয়ন ডলার। ওষুধ ও রাসায়নিক, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জ্বালানি এবং খাদ্য খাতেও উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ এসেছে।
বিদেশি বিনিয়োগে শীর্ষে থাকা ৮ কোম্পানি : প্রতিদিনই বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশ ছেড়ে গেলেও এখনও আটটি কোম্পানিতে তাদের আস্থা ধরে রেখেছে। এসব কোম্পানির এক দশমাংশের বেশি শেয়ার বিদেশিদের হাতে রয়েছে। এসব কোম্পানির মধ্যে রয়েছে অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ, ব্র্যাক ব্যাংক, বিএসআরএম লিমিটেড, বেক্সিমকো ফার্মা, ইসলামী ব্যাংক, নাভানা ফার্মা, রেনেটা ও স্কয়ার ফার্মা। এগুলোতে বিদেশিদের বিনিয়োগ রয়েছে ১০ শতাংশ থেকে ৩৪ শতাংশের বেশি। বর্তমানে অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজে বিদেশিদের সর্বোচ্চ বিনিয়োগ রয়েছে। এই বিনিয়োগের পরিমাণ ৩৪.২৫ শতাংশে পৌঁছেছে।
গত বছর ৩১ জুন কোম্পানিটিতে বিদেশিদের শেয়ার ছিল ২৩.৯৭ শতাংশ, যা পরে ১০.২৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই কোম্পানিটি ২০২৪ সালে বিনিয়োগকারীদের ১০ শতাংশ ক্যাশ ডিভিডেন্ড দিয়েছে। ২০২৩ সালে যেখানে ডিভিডেন্ড দিয়েছিল ৬০ শতাংশ। আগের বছরগুলোতে কোম্পানিটির ডিভিডেন্ডের পরিমাণ ৪০ শতাংশের নিচে নামেনি। বিদেশি বিনিয়োগের দিক দিয়ে এর পরেই রয়েছে ব্র্যাক ব্যাংকের অবস্থান। এখানে বিনিয়োগ রয়েছে ৩২.২০ শতাংশ। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে কোম্পানিটিতে বিদেশিদের শেয়ার ছিল ৩২.০৯ শতাংশ। ফেব্রুয়ারি মাসে ০.১১ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২.২০ শতাংশে। ২০২৪ সালে কোম্পানিটি ১০ শতাংশ ক্যাশ ও ১০ শতাংশ বোনাস ডিভিডেন্ড দিয়েছে। ২০২৩ সালে ডিভিডেন্ড দিয়েছিল ৭.৫০ শতাংশ ক্যাশ ও ৭.৫০ শতাংশ বোনাস।
এদিকে বেক্সিমকো ফার্মায় বিদেশিদের শেয়ার ধারন বেড়েছে। বর্তমানে ২৭.১২ শতাংশ শেয়ার বিদেশিদের কাছে। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে কোম্পানিটিতে এই শেয়ার ছিল ২৭.১১ শতাংশ। ফেব্রুয়ারি মাসে ০.০১ শতাংশ বেড়েছে। কোম্পানিটি ২০২৪ সালে ৪০ শতাংশ ক্যাশ ডিভিডেন্ড দিয়েছে। ২০২৩ সালে ডিভিডেন্ড দিয়েছিল ৩৫ শতাংশ ক্যাশ। ইসলামী ব্যাংকেও বিদেশি শেয়ার বেড়েছে। বর্তমানে ১৭.৮৯ শতাংশ শেয়ারধারী বিদেশি।
গত বছর ৩১ জুন কোম্পানিটিতে এই শেয়ার ছিল ১৩.১৬ শতাংশ। এরপর বিদেশিরা কোম্পানিটিতে ৪.৭৩ শতাংশ মালিকানা বাড়িয়েছেন। কোম্পানিটি ২০২৪ সালে ১০ শতাংশ ক্যাশ ডিভিডেন্ড দিয়েছে। ২০১৯ সাল থেকে কোম্পানিটি একই পরিমাণ ১০ শতাংশ ক্যাশ ডিভিডেন্ড দিয়ে আসছে। বিএসআরএম লিমিটেডে বিদেশি শেয়ার কমেছে। এখানে এই শেয়ার রয়েছে ১৭.০৮ শতাংশ। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে কোম্পানিটিতে বিদেশিদের শেয়ার ছিল ১৭.১২ শতাংশ। ফেব্রুয়ারি মাসে তাদের শেয়ার ০.০৪ শতাংশ কমেছে। নাভানা ফার্মায় বিদেশিদের শেয়ার বেশ কমেছে। বর্তমানে রয়েছে ১৯.৬৪ শতাংশ।
গত বছর ৩১ জুন কোম্পানিটিতে বিদেশিদের শেয়ার ছিল ২৭.৭৩ শতাংশ। চলতি বছর ৮.৯৩ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ১৯.৬৪ শতাংশে। রেনেটা ফার্মায় বিদেশিদের শেয়ার রয়েছে ২০.৮৯ শতাংশ। গত বছর ৩১ জুন কোম্পানিটিতে বিদেশিদের শেয়ার ছিল ২২.২৩ শতাংশ, যা ১.৩৪ শতাংশ কমে বর্তমানে ২০.৮৯ শতাংশে নেমেছে। স্কয়ার ফার্মায় বিদেশি বিনিয়োগকারীদের শেয়ার রয়েছে ১৫.৪৫ শতাংশ। গত বছর ৩১ জুন কোম্পানিটিতে বিদেশিদের শেয়ার ছিল ১৩.৭৬ শতাংশ, যা পরবর্তীতে বেড়ে ১.৬৯ শতাংশ হয়েছে।
ভোরের আকাশ/এসএইচ