তাকী মোহাম্মদ জোবায়ের
প্রকাশ : ৩০ এপ্রিল ২০২৫ ১০:২০ এএম
সরে যেতে হচ্ছে বিএসইসি চেয়ারম্যান মাকসুদকে!
বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে ২০২৪ সারে ১৮ আগস্ট আবির্ভূত হন ‘অচেনা মুখ’ খন্দকার রাশেদ মাকসুদ। ওই দিন তাকে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি’র চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেয় সরকার।
অভিযোগ রয়েছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একজন উপদেষ্টার ‘সুপারিশে’ শেয়ারবাজারের অভিভাবকের আসনে বসেন মাকসুদ। কিন্তু তার ‘অপরিণত’ অভিভাবকত্বে দিনে দিনে তছনছ হয়েছে পুঁজিবাজার। হৃদয় ভাঙে বিনিয়োগকারীদের, যারা আওয়ামী সরকারের পতনের পর একটি শক্তিশালী বাজারের স্বপ্ন দেখেছিলেন।
মাকসুদের দায়িত্ব গ্রহণের দিন থেকে গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত ১৭৪ কার্যদিবসে দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ডিএসই’র সূচক কমেছে ৮৪৩ পয়েন্ট। শতাংশীয় হিসাবে যা সারে ১৪ শতাংশের বেশি। বাজার মূলধন কমেছে ৪৪ হাজার ৭৪৬ কোটি টাকা। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যানের পদত্যাগের দাবিতে প্রায়ই রাস্তায় আন্দোলন করতে দেখা যাচ্ছে ‘সাধারণ’ বিনিয়োগকারীদের। পরিস্থিতি বিবেচনায় বিএসইসিতে নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগের কথা ভাবছে সরকার। নির্ভরযোগ্য সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
ব্যাংক খাতে পুরো ক্যারিয়ার কাটানো রাশেদ মাকসুদের দায়িত্ব গ্রহণের দিনে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ছিল ৫ হাজার ৭৭৮ পয়েন্ট। এরপর এই সূচক সামান্য বাড়লেও দিন দিন তা তলানির দিকেই গেছে। গতকাল মঙ্গলবার সূচক নেমে ৪ হাজার ৯৩৫ পয়েন্টে ঠেকেছে। অথচ সরকার পতনের পর আশায় বুক বেঁধেছিলেন বিনিয়োগকারীরা। পুরো আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দুর্দশায় থাকা সাধারণ বিনিয়োগকারী বাজারমুখী হয়েছিলেন। ওই সময়ে ডিএসইর প্রধান সূচক স্পর্শ করেছিল ৭ হাজার ১০০ পয়েন্টের ঘর। দৈনিক লেনদেনের পরিমাণ বেড়ে ২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়।
গত বছরের ১১ আগস্ট লেনদেন হয় ২ হাজার ১০ কোটি টাকার শেয়ার। এই সময়ে বিএসইসি ছিল নেতৃত্বশূন্য। কিন্তু রাশেদ মাকসুদ দায়িত্ব গ্রহণের দিনই লেনদেন কমে ৪৮০ কোটি টাকা হয়। গতকাল ডিএসইতে লেনদেন হয়েছে ২৯১ কোটি টাকার। ডিএসইর লাগাতার পতনের পাশাপাশি লেনদেন খরাও চলছে। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি অসন্তোষ দেখা দিয়েছে ব্রোকারেজ হাউসগুলোতেও। নামমাত্র লেনদেন হওয়ায় তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
এদিকে দৈনিক পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব বিনিয়োগকারীরা কয়েকদিন পর পর রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ সমাবেশ করছেন। আর এসব কিছু সামাল দিতে বিএসইসির পক্ষ থেকে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে সেগুলোর কোনো সুফল এখনো মিলছে না। এজন্য বিএসইসিতে ক্যারিশম্যাটিক ও পুঁজিবাজারের জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ নেতৃত্ব চেয়ে সভা-মিছিল করছেন বিনিয়োগকারীরা।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে আরও কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া দরকার ছিল এক্সচেঞ্জ কমিশনের। ভালো মানের কোম্পানির তালিকাভুক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বাড়ানোর দৃশ্যমান উদ্যোগ নিলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা অনেকটাই ফিরতো। সামনে এই বিষয়গুলো গুরুত্ব না দিলে দীর্ঘ মেয়াদে শেয়ারবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন বাজার বিশ্লেষকরা। রাশেদ মাকসুদ কমিশনে আস্থা না পাওয়ায় বাজার থেকে হাত গুটিয়ে নিয়েছেন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা। সামনে বাজারের আরও পতনের শঙ্কায় নতুন কোনো বিনিয়োগে যেতে চাইছে না অনেকেই। তারা এখন অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছে বলে জানা গেছে।
একটি ব্যাংকের শেয়ার বিভাগের প্রধান নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, এখন অধিকাংশ ব্যাংকই শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ বন্ধ রেখেছে। কারণ ব্যাংকগুলো আস্থা পাচ্ছে না বিনিয়োগে। আগে যেই বিনিয়োগ করেছে সেগুলো এখন তলানিতে রয়েছে। এটা নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তায় ব্যাংকগুলোর শীর্ষ কর্তারা। এর মধ্যে নতুন করে বিনিয়োগের ঝুঁকিই নিতে চাচ্ছেন না তারা।
জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে শেয়ারবাজারে পতন চলতে থাকায় বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ১৮ লাখ থেকে কমে ৭ লাখে নেমে এসেছে। বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বাংলাদেশ ক্যাপিটাল মার্কেট ইনভেস্টর অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ইকবাল হোসাইন বলেছেন, গত আট মাসে পুঁজিবাজারের সূচক শুধু নিচেই নেমেছে, ওপরে উঠেনি। এ সময় বিনিয়োগকারীদের অনেকেই ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ পুঁজি হারিয়েছেন।
বাজারের পরিস্থিতি প্রসঙ্গে বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, ট্রেজারি বিল ও বন্ডে সুদ হার বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংক সহ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা ওদিকে আগ্রহ দেখাচ্ছে। সরকারি বিল ও বন্ডের সুদের হার বেড়ে ১২ শতাংশ ছাড়িয়েছে। এখানে বিনিয়োগ লাভজনক ও ঝুঁকিমুক্ত হওয়ায় বাজার থেকে টাকা নিয়ে ওখানে বিনিয়োগ করছেন অনেকে। সামনে বাজেটে পুঁজিবাজারের জন্য প্রণোদনা দেওয়া দরকার বলে উল্লেখ করেন এই অর্থনীতিবিদ।
সংকটে ব্রোকারেজ হাউসগুলো : পুঁজিবাজারে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হচ্ছে ব্রোকারেজ হাউসগুলো। বিনিয়োগকারীদের শেয়ার কেনাবেচায় সহায়তা দেওয়ার পাশাপাশি তারা বিভিন্ন ধরনের আর্থিক সেবা প্রদান করে, যার বিপরীতে কমিশন কিংবা সার্ভিস চার্যভিত্তিক আয় করে থাকে।
এর মধ্যে সবচেয়ে বড় আয়ের উৎস হলো লেনদেন কমিশন। প্রতিটি শেয়ার কেনাবেচার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট একটি কমিশন হার ধার্য করা হয়। বিনিয়োগকারীদের প্রতিটি অর্ডারের বিপরীতে ব্রোকাররা এই কমিশন পেয়ে থাকেন, যা তাদের প্রধান আয়ের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দৈনিক লেনদেনের পরিমাণ ৩০০ থেকে ৪০০ কোটির ঘরে থাকায় এ আয় নেমেছে তলানিতে। এতে ব্রোকার হাউসগুলো রয়েছে চরম সংকটের মধ্যে। হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে।
একটি শীর্ষ ব্রোকারেজ হাউসের প্রধান নির্বাহী হতাশা প্রকাশ করে বলেছেন, এমন চরম দুঃসময় আমাদের আর কখনোই আসেনি। বর্তমানে যে হারে লেনদেন হচ্ছে এতে আমাদের ব্যবসা পরিচালনা কঠিন হয়ে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে ব্যবসা পরিচালনা সম্ভব হবে না।
বছরের সর্বনিম্ন লেনদেন, বিক্ষোভ : গতকাল দেশের শেয়ারবাজারে দরপতনের ধারা অব্যাহত ছিল। একই সঙ্গে ছিল লেনদেনের খরা। গতকাল মঙ্গলবার ডিএসইতে চলতি বছরের সর্বনিম্ন লেনদেনের ঘটনা ঘটেছে। একই সঙ্গে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম কমার পাশাপাশি কমেছে সবকটি মূল্যসূচক। অন্য শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম কমার পাশাপাশি কমেছে সবকটি মূল্যসূচক। তবে লেনদেনের পরিমাণ কিছুটা বেড়েছে।
এদিকে শেয়ারবাজারে অব্যাহত দরপতন হওয়ায় রাজধানীর মতিঝিলে এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সামনে বিক্ষোভ করেন বিনিয়োগকারীরা। এসব বিক্ষোভ থেকে বিএসইসি চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদকে অপসারণ ও তার দুর্নীতি দ্রুত অনুসন্ধান করার দাবি জানান বিনিয়োগকারীরা।
এর আগে গত সপ্তাহের পাঁচ কার্যদিবস এবং তার আগের সপ্তাহে চার কার্যদিবস অর্থাৎ টানা ৯ কার্যদিবস শেয়ারবাজারে দরপতন হয়। তবে চলতি সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবস রোববার ডিএসইতে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম বাড়ার পাশাপাশি বাড়ে মূল্যসূচক। অবশ্য সিএসইতে পতনের ধারা অব্যাহত থাকে। সোমবার ডিএসই ও সিএসই উভয় বাজারে দরপতন হয়।
এ পরিস্থিতিতে মঙ্গলবার ডিএসইতে লেনদেন শুরু হয় বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম কমার মাধ্যমে। ফলে লেনদেনের শুরুতে সূচক ঋণাত্মক হয়ে পড়ে। মাঝে কিছু সময়ের জন্য সূচক একটু ঊর্ধ্বমুখী হলেও শেষদিকে আবার দরপতনের পাল্লা ভারী হয়। ফলে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম কমার পাশাপাশি সবকটি মূল্যসূচক কমেই দিনের লেনদেন শেষ হয়। দিনের লেনদেন শেষে সব খাত মিলে ডিএসইতে ১৩৬টি কোম্পানির শেয়ার ও ইউনিট দাম বাড়ার তালিকায় নাম লেখাতে পেরেছে। বিপরীতে দাম কমেছে ২১১টির। আর ৫০টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। সার্বিকভাবে দাম কমার তালিকায় বেশি প্রতিষ্ঠান থাকায় ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স আগের দিনের তুলনায় ১৭ পয়েন্ট কমে ৪ হাজার ৯৩৫ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে।
ভোরের আকাশ/এসএইচ
তাকী মোহাম্মদ জোবায়ের
প্রকাশ : ২ ঘন্টা আগে
আপডেট : ১৫ মিনিট আগে
সরে যেতে হচ্ছে বিএসইসি চেয়ারম্যান মাকসুদকে!
বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে ২০২৪ সারে ১৮ আগস্ট আবির্ভূত হন ‘অচেনা মুখ’ খন্দকার রাশেদ মাকসুদ। ওই দিন তাকে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি’র চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেয় সরকার।
অভিযোগ রয়েছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একজন উপদেষ্টার ‘সুপারিশে’ শেয়ারবাজারের অভিভাবকের আসনে বসেন মাকসুদ। কিন্তু তার ‘অপরিণত’ অভিভাবকত্বে দিনে দিনে তছনছ হয়েছে পুঁজিবাজার। হৃদয় ভাঙে বিনিয়োগকারীদের, যারা আওয়ামী সরকারের পতনের পর একটি শক্তিশালী বাজারের স্বপ্ন দেখেছিলেন।
মাকসুদের দায়িত্ব গ্রহণের দিন থেকে গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত ১৭৪ কার্যদিবসে দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ডিএসই’র সূচক কমেছে ৮৪৩ পয়েন্ট। শতাংশীয় হিসাবে যা সারে ১৪ শতাংশের বেশি। বাজার মূলধন কমেছে ৪৪ হাজার ৭৪৬ কোটি টাকা। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যানের পদত্যাগের দাবিতে প্রায়ই রাস্তায় আন্দোলন করতে দেখা যাচ্ছে ‘সাধারণ’ বিনিয়োগকারীদের। পরিস্থিতি বিবেচনায় বিএসইসিতে নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগের কথা ভাবছে সরকার। নির্ভরযোগ্য সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
ব্যাংক খাতে পুরো ক্যারিয়ার কাটানো রাশেদ মাকসুদের দায়িত্ব গ্রহণের দিনে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ছিল ৫ হাজার ৭৭৮ পয়েন্ট। এরপর এই সূচক সামান্য বাড়লেও দিন দিন তা তলানির দিকেই গেছে। গতকাল মঙ্গলবার সূচক নেমে ৪ হাজার ৯৩৫ পয়েন্টে ঠেকেছে। অথচ সরকার পতনের পর আশায় বুক বেঁধেছিলেন বিনিয়োগকারীরা। পুরো আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দুর্দশায় থাকা সাধারণ বিনিয়োগকারী বাজারমুখী হয়েছিলেন। ওই সময়ে ডিএসইর প্রধান সূচক স্পর্শ করেছিল ৭ হাজার ১০০ পয়েন্টের ঘর। দৈনিক লেনদেনের পরিমাণ বেড়ে ২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়।
গত বছরের ১১ আগস্ট লেনদেন হয় ২ হাজার ১০ কোটি টাকার শেয়ার। এই সময়ে বিএসইসি ছিল নেতৃত্বশূন্য। কিন্তু রাশেদ মাকসুদ দায়িত্ব গ্রহণের দিনই লেনদেন কমে ৪৮০ কোটি টাকা হয়। গতকাল ডিএসইতে লেনদেন হয়েছে ২৯১ কোটি টাকার। ডিএসইর লাগাতার পতনের পাশাপাশি লেনদেন খরাও চলছে। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি অসন্তোষ দেখা দিয়েছে ব্রোকারেজ হাউসগুলোতেও। নামমাত্র লেনদেন হওয়ায় তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
এদিকে দৈনিক পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব বিনিয়োগকারীরা কয়েকদিন পর পর রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ সমাবেশ করছেন। আর এসব কিছু সামাল দিতে বিএসইসির পক্ষ থেকে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে সেগুলোর কোনো সুফল এখনো মিলছে না। এজন্য বিএসইসিতে ক্যারিশম্যাটিক ও পুঁজিবাজারের জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ নেতৃত্ব চেয়ে সভা-মিছিল করছেন বিনিয়োগকারীরা।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে আরও কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া দরকার ছিল এক্সচেঞ্জ কমিশনের। ভালো মানের কোম্পানির তালিকাভুক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বাড়ানোর দৃশ্যমান উদ্যোগ নিলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা অনেকটাই ফিরতো। সামনে এই বিষয়গুলো গুরুত্ব না দিলে দীর্ঘ মেয়াদে শেয়ারবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন বাজার বিশ্লেষকরা। রাশেদ মাকসুদ কমিশনে আস্থা না পাওয়ায় বাজার থেকে হাত গুটিয়ে নিয়েছেন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা। সামনে বাজারের আরও পতনের শঙ্কায় নতুন কোনো বিনিয়োগে যেতে চাইছে না অনেকেই। তারা এখন অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছে বলে জানা গেছে।
একটি ব্যাংকের শেয়ার বিভাগের প্রধান নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, এখন অধিকাংশ ব্যাংকই শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ বন্ধ রেখেছে। কারণ ব্যাংকগুলো আস্থা পাচ্ছে না বিনিয়োগে। আগে যেই বিনিয়োগ করেছে সেগুলো এখন তলানিতে রয়েছে। এটা নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তায় ব্যাংকগুলোর শীর্ষ কর্তারা। এর মধ্যে নতুন করে বিনিয়োগের ঝুঁকিই নিতে চাচ্ছেন না তারা।
জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে শেয়ারবাজারে পতন চলতে থাকায় বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ১৮ লাখ থেকে কমে ৭ লাখে নেমে এসেছে। বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বাংলাদেশ ক্যাপিটাল মার্কেট ইনভেস্টর অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ইকবাল হোসাইন বলেছেন, গত আট মাসে পুঁজিবাজারের সূচক শুধু নিচেই নেমেছে, ওপরে উঠেনি। এ সময় বিনিয়োগকারীদের অনেকেই ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ পুঁজি হারিয়েছেন।
বাজারের পরিস্থিতি প্রসঙ্গে বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, ট্রেজারি বিল ও বন্ডে সুদ হার বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংক সহ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা ওদিকে আগ্রহ দেখাচ্ছে। সরকারি বিল ও বন্ডের সুদের হার বেড়ে ১২ শতাংশ ছাড়িয়েছে। এখানে বিনিয়োগ লাভজনক ও ঝুঁকিমুক্ত হওয়ায় বাজার থেকে টাকা নিয়ে ওখানে বিনিয়োগ করছেন অনেকে। সামনে বাজেটে পুঁজিবাজারের জন্য প্রণোদনা দেওয়া দরকার বলে উল্লেখ করেন এই অর্থনীতিবিদ।
সংকটে ব্রোকারেজ হাউসগুলো : পুঁজিবাজারে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হচ্ছে ব্রোকারেজ হাউসগুলো। বিনিয়োগকারীদের শেয়ার কেনাবেচায় সহায়তা দেওয়ার পাশাপাশি তারা বিভিন্ন ধরনের আর্থিক সেবা প্রদান করে, যার বিপরীতে কমিশন কিংবা সার্ভিস চার্যভিত্তিক আয় করে থাকে।
এর মধ্যে সবচেয়ে বড় আয়ের উৎস হলো লেনদেন কমিশন। প্রতিটি শেয়ার কেনাবেচার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট একটি কমিশন হার ধার্য করা হয়। বিনিয়োগকারীদের প্রতিটি অর্ডারের বিপরীতে ব্রোকাররা এই কমিশন পেয়ে থাকেন, যা তাদের প্রধান আয়ের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দৈনিক লেনদেনের পরিমাণ ৩০০ থেকে ৪০০ কোটির ঘরে থাকায় এ আয় নেমেছে তলানিতে। এতে ব্রোকার হাউসগুলো রয়েছে চরম সংকটের মধ্যে। হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে।
একটি শীর্ষ ব্রোকারেজ হাউসের প্রধান নির্বাহী হতাশা প্রকাশ করে বলেছেন, এমন চরম দুঃসময় আমাদের আর কখনোই আসেনি। বর্তমানে যে হারে লেনদেন হচ্ছে এতে আমাদের ব্যবসা পরিচালনা কঠিন হয়ে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে ব্যবসা পরিচালনা সম্ভব হবে না।
বছরের সর্বনিম্ন লেনদেন, বিক্ষোভ : গতকাল দেশের শেয়ারবাজারে দরপতনের ধারা অব্যাহত ছিল। একই সঙ্গে ছিল লেনদেনের খরা। গতকাল মঙ্গলবার ডিএসইতে চলতি বছরের সর্বনিম্ন লেনদেনের ঘটনা ঘটেছে। একই সঙ্গে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম কমার পাশাপাশি কমেছে সবকটি মূল্যসূচক। অন্য শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম কমার পাশাপাশি কমেছে সবকটি মূল্যসূচক। তবে লেনদেনের পরিমাণ কিছুটা বেড়েছে।
এদিকে শেয়ারবাজারে অব্যাহত দরপতন হওয়ায় রাজধানীর মতিঝিলে এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সামনে বিক্ষোভ করেন বিনিয়োগকারীরা। এসব বিক্ষোভ থেকে বিএসইসি চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদকে অপসারণ ও তার দুর্নীতি দ্রুত অনুসন্ধান করার দাবি জানান বিনিয়োগকারীরা।
এর আগে গত সপ্তাহের পাঁচ কার্যদিবস এবং তার আগের সপ্তাহে চার কার্যদিবস অর্থাৎ টানা ৯ কার্যদিবস শেয়ারবাজারে দরপতন হয়। তবে চলতি সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবস রোববার ডিএসইতে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম বাড়ার পাশাপাশি বাড়ে মূল্যসূচক। অবশ্য সিএসইতে পতনের ধারা অব্যাহত থাকে। সোমবার ডিএসই ও সিএসই উভয় বাজারে দরপতন হয়।
এ পরিস্থিতিতে মঙ্গলবার ডিএসইতে লেনদেন শুরু হয় বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম কমার মাধ্যমে। ফলে লেনদেনের শুরুতে সূচক ঋণাত্মক হয়ে পড়ে। মাঝে কিছু সময়ের জন্য সূচক একটু ঊর্ধ্বমুখী হলেও শেষদিকে আবার দরপতনের পাল্লা ভারী হয়। ফলে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম কমার পাশাপাশি সবকটি মূল্যসূচক কমেই দিনের লেনদেন শেষ হয়। দিনের লেনদেন শেষে সব খাত মিলে ডিএসইতে ১৩৬টি কোম্পানির শেয়ার ও ইউনিট দাম বাড়ার তালিকায় নাম লেখাতে পেরেছে। বিপরীতে দাম কমেছে ২১১টির। আর ৫০টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। সার্বিকভাবে দাম কমার তালিকায় বেশি প্রতিষ্ঠান থাকায় ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স আগের দিনের তুলনায় ১৭ পয়েন্ট কমে ৪ হাজার ৯৩৫ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে।
ভোরের আকাশ/এসএইচ