ট্রাম্পের শুল্কনীতি
তাকী মোহাম্মদ জোবায়ের
প্রকাশ : ২৪ মে ২০২৫ ০৪:৩০ পিএম
সমঝোতার পথে বাংলাদেশ
ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্কের খড়গ থেকে বাঁচতে সমঝোতার পথে এগোচ্ছে বাংলাদেশ। এর অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি হওয়া ১শটি পণ্যের শুল্ক প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তবে বাংলাদেশ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডাব্লিউটিও) সদস্য হওয়ায় সকল দেশের জন্যই এই সুবিধা দিতে হচ্ছে। এতে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য থেকেই বছরে ৬শ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব হারাবে বাংলাদেশ। দেশটি থেকে ওই একশ পণ্য আমদানিতে বছরে ব্যয় হয় ২৮ হাজার কোটি টাকার মতো। পাশাপাশি ওয়াশিংটনের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি বা এফটিএ স্বাক্ষরের জন্যও উদ্যোগ নিচ্ছে ঢাকা, যদিও এটি বেশ সময়-সাপেক্ষ বিষয়। তবে বাংলাদেশের সঙ্গে এফটিএ’র বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ নেই বলে জানা গেছে।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, শুধু শুল্ক প্রত্যাহার করলেই সমস্যার সমাধান হবে না, প্রয়োজন রাজনৈতিক সমঝোতার। যুক্তরাষ্ট্রের ১৩শ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি দূর করতে গত ২ এপ্রিল বাংলাদেশ সহ ৫৭টি দেশের পণ্য আমদানিতে উচ্চ শুল্ক আরোপ করে ট্রাম্প প্রশাসন।
গত ৯ এপ্রিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই পাল্টা শুল্ক চীন ব্যতীত অন্যান্য দেশের জন্য তিন মাসের জন্য স্থগিত করেছেন এবং বিদ্যমান শুল্কের থেকে বাড়তি ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন। এই স্থগিতাদেশের মেয়াদ আগামী ৮ জুলাই শেষ হওয়ার কথা। সেক্ষেত্রে ‘ট্রাম্পতোষণে’ মাত্র দেড় মাস সময় রয়েছে বাংলাদেশের হাতে।
যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ রপ্তানি বাজার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ প্রায় ২.২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে, বিপরীতে রপ্তানি করেছে ৮.৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। বাংলাদেশের মোট রপ্তানির প্রায় ১৭ শতাংশ যায় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে এবং এর সঙ্গে নারীসহ প্রায় আট লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থান জড়িত। এই বাজার ধরে রাখতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে ঢাকা। তাই বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি কিভাবে কমানো যায় সেটি নিয়ে দেশটির কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে ইউনূস প্রশাসন। নিজেদের আগ্রহ দৃশ্যমান করতে একশ পণ্যে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারসহ আরো কিছু প্রস্তাব দেবে ঢাকা। এজন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয় সম্মিলিতভাবে কাজ করছে বলে জানা গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের যেসব পণ্যে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দেওয়া হচ্ছে সেসবের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি, যন্ত্রাংশ, তৈরি পোশাক শিল্পে ব্যবহৃত কাঁচামাল, মানব তৈরি তন্তু, উল, শিল্পের বর্জ্যপানি শোধনাগার (ইটিপি), ডায়ালাইসিস ফিল্টার, অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র এবং কিছু নির্দিষ্ট ধরনের অস্ত্র। এসব পণ্যে বর্তমানে সর্বোচ্চ ৩৭ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপিত রয়েছে। তবে বাংলাদেশ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্য হওয়ায় এই সংস্থার আইন অনুযায়ী শুধু একটি দেশের জন্য শুল্ক সুবিধা দিতে পারছে না। সকল দেশের জন্যই এই সুবিধা দিতে হচ্ছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বাজেট নিয়ে হওয়া এক বৈঠকে এসব পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এতে প্রধান উপদেষ্টার সম্মতিও মিলেছে।
এনবিআর কর্মকর্তাদের মতে, এসব পণ্যে আমদানি শুল্ক প্রত্যাহারের ফলে রাজস্ব ঘাটতি খুব একটা হবে না। বরং এতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়বে এবং দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর ক্ষেত্রে সহায়ক হবে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মইনুল খান বলেন, ট্রাম্প প্রশাসনের মনোভাব হচ্ছে, আলোচনায় মার্কিন অংশীদাররা এমন কিছু বাস্তব পদক্ষেপ দেখতে চায়, যেখানে মার্কিন বাণিজ্যের মৌলিক স্বার্থগুলো বিবেচনায় আনা হয়েছে; যার মূল লক্ষ্য হচ্ছে মার্কিন পণ্যের রপ্তানির প্রসার ঘটানো। তবে অধ্যাপক রেহমান সোবহানের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা শুধু আমদানি-রপ্তানির ইস্যু নয়, রাজনৈতিকও বটে। সে দেশের বাণিজ্য প্রতিনিধির কার্যালয়ের সঙ্গে আলোচনায় শুল্ক শর্ত মানা হলে তারা নতুন ইস্যু তৈরি করবে। শুধু দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য নয়, বরং উচ্চ পর্যায়ের সম্পর্ক অন্যতম বিষয়। সে ক্ষেত্রে দরকষাকষিতে বাংলাদেশকে রাজনৈতিক কৌশল নিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দরকষাকষিতে অন্য দেশ কোন পথে এগোচ্ছে, তা বুঝে নিজেদের কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। সম্প্রতি সিপিডি’র এক সংলাপে তিনি এসব কথা বলেছেন।
এদিকে বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের সাবেক সদস্য মোস্তফা আবিদ খান বলেন, প্রথমেই বুঝতে হবে যুক্তরাষ্ট্র যা আরোপ করেছে, তা পারস্পরিক শুল্ক নয়। ফলে বাংলাদেশ যেভাবে যতই সাড়া দিক না কেন, তাতে কোনো লাভ নেই। বরং বুঝতে হবে, যুক্তরাষ্ট্র কী চায়। আরেকটি ভালো উপায় হতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এফটিএ করা। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এফটিএ করা সহজ নয়।
এর আগেও বহুবার বাংলাদেশ এ প্রস্তাব দিয়েছিল। তখন যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, বাংলাদেশ এফটিএ করার জন্য প্রস্তুত নয়।
প্রসঙ্গত, রপ্তানি বাজারে প্রধান প্রতিযোগী ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এফটিএ করার চেষ্টা করছে। ভারতও একই চেষ্টা করছে।
জানা গেছে, বাংলাদেশ নিয়ে মার্কিন প্রশাসনের বড় আপত্তির জায়গাটি হচ্ছে ইউনাইটেড স্টেটস ট্রেড রিপ্রেজেনটেটিভের (ইউএসটিআর) রিপোর্ট ২০২৫-এ উল্লিখিত বাণিজ্য বাধা। এতে শুল্ক ও অশুল্ক নিয়ে মোট আটটি সমস্যার কথা বলা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, এসব কারণে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য বাংলাদেশে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে প্রবেশ করতে পারছে না।
ওই মার্কিন প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের আমদানি শুল্কের সহজ গড় (সিম্পল অ্যাভারেজ) প্রায় ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ। ছায়া শুল্কের হিসাব অন্তর্ভুক্ত করলে এই গড় দাঁড়ায় প্রায় ২৭ শতাংশ। আমদানি স্থলে অন্যান্য কর যুক্ত করে সামগ্রিক সহজ গড় হয় ৫৭ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের আমদানির ক্ষেত্রে এই সহজ গড় ৫৪ শতাংশ।
এছাড়া ওই প্রতিবেদনে অশুল্ক বাধা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে সরকারি কেনাকাটায় জটিলতা ও অনিয়ম, বিনিয়োগসংক্রান্ত মূলধন প্রত্যাবাসনে বিলম্ব, ডব্লিউটিওর শুল্কমূল্য বাস্তবায়নে অপূর্ণতা, মেধাসম্পদ সুরক্ষার ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগের দুর্বলতা, ই-কমার্স ও সাইবার নিরাপত্তার প্রশ্নবিদ্ধ মানদণ্ড, বিনিয়োগের নানা স্তরের দীর্ঘসূত্রতা ও জটিলতা, শ্রম অধিকার রক্ষায় ঘাটতি এবং ঘুষ ও দুর্নীতির বিস্তারের কথা। এসব অশুল্ক বাধা দূর করার বিষয়েও বাংলাদেশ সরকারের প্রচেষ্টার কথা ট্রাম্প প্রশাসনকে বোঝানোর চেষ্টা করা হবে বলে জানা গেছে।
এর মধ্যে বিনিয়োগসংক্রান্ত মূলধন প্রত্যাবাসন সহজ করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কাজ শুরু করেছে বলে জানা গেছে। ট্রাম্পের মূল ঘোষণা অনুযায়ী বাংলাদেশের ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্কারোপের কথা বলা হয়েছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশ চীনের ওপর ১৪৫ শতাংশ, ভিয়েতনামের ওপর ৪৬ শতাংশ, কম্বোডিয়ার ৪৯ শতাংশ, ভারতের ২৬ শতাংশ ও পাকিস্তানের ওপর ২৯ শতাংশ হারে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করেছে।
স্থগিতাদেশের ৯০ দিন পার হলে এই হার যদি বহাল হয় তাহলে বাংলাদেশ চীন, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার তুলনায় এগিয়ে থাকলেও অন্যতম প্রতিযোগী দেশ ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের কঠিন চ্যালেঞ্জে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ভারতের পণ্যের মান বাংলাদেশের কাছাকাছি ও একই সঙ্গে তাদের সাম্প্রতিক প্রবৃদ্ধিও লক্ষণীয়।
বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, এ রকম প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হতে হবে প্রতিযোগী দেশগুলোর হারের সমান বা কম হারের আওতায় থাকা। এর প্রধান যুক্তি হচ্ছে, বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যঘাটতির অনুপাত বেশি হলেও মোট পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম। যেমন ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যঘাটতি প্রায় ৪৯ বিলিয়ন, চীনের ৩১৯ বিলিয়ন, ভিয়েতনামের ১৩৯ বিলিয়ন, কম্বোডিয়ার ১৩ বিলিয়ন। আর বাংলাদেশের সঙ্গে এই ঘাটতি মাত্র ছয় বিলিয়ন ডলার।
আলোচনায় এই বিষয়টি সামনে এনে সর্বনিম্ন স্তরে অন্তর্ভুক্ত করাতে পারলে বাংলাদেশ বরং তৈরি পোশাক রপ্তানিতে সুবিধাপ্রাপ্ত হবে বলে ভোরের আকাশ’কে জানিয়েছে বিজিএমইএ’র সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল। তিনি বলেন, চীন, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ায় অধিক শুল্কারোপের ফলে ওই সব দেশের বিনিয়োগ স্থানান্তরিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এতে বাংলাদেশ লাভবান হবে।
বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের সাবেক সদস্য মোস্তফা আবিদ খান ভোরের আকাশ’কে বলেন, মার্কিন তুলা ব্যবহার করে পোশাক তৈরি ও ওই তুলা ব্যবহার করে রপ্তানির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক শুল্কছাড়ের বিষয়টিও আলোচনার টেবিলে আনা যায়। এতে মার্কিন তুলার দাম বেশি হলেও যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক প্রবেশের সময় শুল্কছাড়ের সুবিধার কারণে বেসরকারি পর্যায়ে তুলার আমদানি বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে।
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন ও এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২ হাজার ৫১৫টি পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ। এর মধ্যে ২ হাজার ২১৮টিতে শুল্ক রয়েছে। আর ২৯৭টিতে আমদানি শুল্ক নেই।
গড় শুল্ক ৬ দশমিক ২ শতাংশ।
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয় বাংলাদেশের ১ হাজার ২০৮টি পণ্য, যার মধ্যে ৯২৭টিতে শুল্ক রয়েছে। ২৮১টি পণ্য শুল্কমুক্ত সুবিধা পায়। এতে গড় শুল্ক দাঁড়ায় ১৫ দশমিক ২ শতাংশ। গত বছর বাংলাদেশের পণ্যের আমদানি শুল্ক থেকে ১২৭ কোটি ডলার আয় করেছে যুক্তরাষ্ট্র, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা সাড়ে ১৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানিতে শুল্ক বাবদ ১৮ কোটি ডলার বা ২২শ কোটি টাকা আয় করেছে বাংলাদেশ।
এর মধ্যে যে একশ পণ্যে শুল্ক ছাড় দেওয়া হচ্ছে সেগুলো থেকে আয় হয়েছে ৬১০ কোটি টাকা। এখন শুল্ক ছাড়ের কারণে এই আয় হারাবে বাংলাদেশ। পাশাপাশি এসব পণ্য অন্য অনেক দেশ থেকেও আমদানি হয়। সেসব দেশও শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পাবে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ মোট কত টাকা রাজস্ব হারাবে সেই হিসাব পাওয়া যায়নি ট্যারিফ কমিশন বা রাজস্ব বোর্ডের কাছে।
ভোরের আকাশ/এসএইচ