ভারত-পাকিস্তান সংঘাত
তাকী মোহাম্মদ জোবায়ের
প্রকাশ : ০৯ মে ২০২৫ ১১:০৭ এএম
ঝুঁকিতে দেশের অর্থনীতি
দক্ষিণ এশিয়ার দুই পরমাণু শক্তিধর দেশ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার উত্তেজনা দীর্ঘস্থায়ী হলে বা পূর্ণ যুদ্ধে রূপ নিলে বাংলাদেশের অর্থনীতি মারাত্মক ক্ষতির শিকার হবে বলে আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা। পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে আমদানি ও রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ব্যয় বৃদ্ধির ঝুঁকির কথা জানিয়েছেন তারা। তাই পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে এখুনি বিকল্প সরবরাহ উৎস খুঁজে বের করার প্রতি জোর দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
পাশাপার্শি সংঘর্ষে জড়িয়ে যাওয়া দেশ দুটির আন্তর্জাতিক কার্যাদেশ বাংলাদেশ বাগিয়ে নিয়ে কিভাবে অর্থনৈতিক সুবিধা নিতে পারে সেটিও খতিয়ে দেখার পরামর্শ তাদের। তবে যুদ্ধের ঝুঁকি কিংবা বিকল্প উৎস নিরূপণে সরকার কিংবা বাণিজ্যিক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনও বৈঠক হয়নি বলে জানা গেছে। ভারত-অধিকৃত কাশ্মীরে সপ্তাহ দুয়েক আগে এক ভয়াবহ হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করার পর বুধবার ভোররাতে ভারত ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালে দুই পরমাণুশক্তিধর দেশের মধ্যে যুদ্ধাবস্থার সৃষ্টি হয়। এই ঘটনায় পাকিস্তান উপযুক্ত জবাব দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।
এই সংঘাত ভারত ও পাকিস্তানের মুদ্রাকে মার্কিন ডলারের বিপরীতে দুর্বল করেছে। আক্রমণের শিকার হওয়ায় পাকিস্তানের শেয়ারবাজারে ভয়াবহ ধস নেমেছে। তবে উল্টো বেড়েছে ভারতের শেয়ারবাজার। এই সংঘাতে ইতোমধ্যে বাংলাদেশকে প্রভাবিত করেছে। কারণ ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর আকাশপথে নিরাপত্তা ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ায় বুধবার রাতে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করা অন্তত তিনটি আন্তর্জাতিক ফ্লাইটকে রুট পরিবর্তন করে অন্য দেশে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
অর্থনীতিবিদরা জানিয়েছেন, এই দ্বিপক্ষীয় সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী হলে ব্যবসা ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা ও অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। বাংলাদেশ ভারত থেকে প্রচুর পরিমাণে অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যপণ্য আমদানি করে এবং যুদ্ধের কারণে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাদের দেশে উৎপাদিত পণ্য সংরক্ষণের জন্য বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারে। বাংলাদেশের মোট আমদানির প্রায় ১৫ শতাংশ আসে প্রতিবেশি দেশ ভারত থেকে।
এর মধ্যে বেশিরভাগই নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য দ্রব্য ও শিল্পের কাঁচামাল। এছাড়া সংকট কাটাতে বর্তমানে পাকিস্তান থেকে চাল আমদানি করছে বাংলাদেশ। তাই দেশ দুটি দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে জড়ালে খাদ্য নিরাপত্তা ও শিল্পের কাঁচামাল সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
অর্থনীতি বিশ্লেষক মো. মাজেদুল হক ভোরের আকাশ’কে বলেন, যেকোন যুদ্ধের সরাসরি প্রভাব পার্শ্ববর্তী দেশের ওপর পড়ে। পশ্চিমের যেকোন দেশ থেকে পণ্য আমদানি কিংবা এসব দেশে রপ্তানি করতে গেলে ভারত ও পাকিস্তানের সীমান্ত পাড় হতে হয়। এমনকি পণ্যবাহী বিমান কিংবা জাহাজ এসব দেশে ট্রানজিট নেয়। তাই দেশ দুটি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে বাংলাদেশের আমদানি ও রপ্তানি মারাত্মকভাবে ব্যহত হবে। বাংলাদেশের পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। এর প্রভাবে শিল্প কারখানায় উৎপাদনও ব্যহত হবে।
তিনি বলেন, দেশ দুটির মধ্যকার উত্তেজনাকর পরিস্থিতি বেশিদিন চললে শিপমেন্ট বাতিল হতে পারে। নতুন রুটে শিপমেন্ট করতে হলে পরিবহন ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে। বাংলাদেশের বিনিময় ভারসাম্য বা ব্যালেন্স অব পেমেন্টে বড় ধাক্কা খেতে হবে যদি যুদ্ধ লেগে যায়, বলেন এই অর্থনীতিবিদ।
বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারকদের সাংগঠন বিজিএমইএ’র সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল ভোরের আকাশ’কে বলেন, ভারত ও পাকিস্তান যুদ্ধে জড়ালে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের ওপর। আমাদের শিল্পের অনেক কাঁচামাল ভারত থেকে আসে। দেশটি যুদ্ধে জড়িয়ে গেলে আমাদের শিল্পের সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। তাই আমাদের এখুনি বিকল্প উৎস নিয়ে ভাবতে হবে। বিষয়টি নিয়ে শিগগিরই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বসার কথা জানিয়েছেন এই ব্যবসায়ী নেতা।
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের প্রভাব নিয়ে নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ’র সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, আমাদের সুতা, কাপড়সহ নানা কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে আমদানি-রপ্তানি বিঘ্নিত হবে, যার সরাসরি প্রভাব পড়বে আমাদের শিল্প খাতে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, যুদ্ধ শুরু হলে বাংলাদেশে আমদানি বিপাকে পড়তে পারে। কারণ দেশটি ভারত থেকে প্রচুর শিল্প খাতের মধ্যবর্তী পণ্য ও অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যপণ্য আমদানি করে। সম্ভাব্য ঝুঁকি এড়াতে ব্যবসায়ী ও সরকারের নীতিনির্ধারকদের বিকল্প সরবরাহ উৎস খোঁজার পরামর্শ দেন এই অর্থনীতিবিদ।
তিনি বলেন, যুদ্ধরত দেশ থেকে রপ্তানি কার্যাদেশ সরিয়ে নিতে পারে বিশে^র অনেক দেশ। ওই কার্যাদেশগুলো যাতে বাংলাদেশ নিজের কাছে নিয়ে আসতে পারে সেই প্রস্তুতি রাখতে হবে আমাদের।
ভোরের আকাশ/এসএইচ