আসন্ন বাজেট
তাকী মোহাম্মদ জোবায়ের
প্রকাশ : ১৪ মে ২০২৫ ০৮:২৮ এএম
অর্থসংস্থানে দুশ্চিন্তা কাটল
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল জুন মাসে বাংলাদেশের ঋণের দুটি কিস্তি ছাড় করতে রাজি হওয়ায় প্রায় ২৯৫ কোটি ডলার বা ৩৬ হাজার কোটি টাকার অর্থসংস্থান নিশ্চিত হলো বাংলাদেশের। এর মাধ্যমে আগামী জাতীয় বাজেটের জন্য অর্থসংস্থান নিয়ে বড় দুশ্চিন্তা কাটলো অন্তর্বর্তী সরকারের। নানা শর্তে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহিবল বা আইএমএফের ঋণের দুই কিস্তির ১৩০ কোটি ডলার ঝুলে যাওয়ায় শঙ্কা তৈরি হয়েছিল বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক ও জাইকার ১৬৫ কোটি ডলারের ঋণপ্রাপ্তি নিয়ে। কারণ- সংস্থাগুলোও আইএমএফের সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে ছিল। এখন আইএমএফ ঋণের কিস্তি ছাড়ে রাজি হওয়ায় এই সংস্থাগুলো থেকেও ঋণপ্রাপ্তি নিশ্চিত হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো থেকে ঋণ না পেলে বাজেটে অর্থসংস্থান অনিশ্চিত হয়ে পড়াসহ আরও কিছু সংকট তৈরি হতে পারে, এই আশঙ্কায় আইএমএফের সঙ্গে সমঝোতায় আসে বাংলাদেশ।আইএমএফের শর্ত মেনে ডলারের বিনিময় হার পুরোপুরি বাজারমুখী করার বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করে আসলেও শেষ পর্যন্ত নমনীয় হয়েছে ঢাকা। এখন বাংলাদেশ ডলারের বিনিময় হার বাজারে ছেড়ে দিবে বলে আইএমএফকে জানিয়েছে। তবে ডলারের বিনিময় হারের একটি ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে দেওয়া হবে যেটি বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশ করবে না বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে আজ দেশের সকল ব্যাংকের (এডি) ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের ডেকে নির্দেশনা জানিয়ে দেবেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। বৈঠকে দুবাই থেকে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হবেন গভর্নর। ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) সঙ্গে বৈঠকের পর ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হয়ে সংবাদ সম্মেলনে আইএমএফের ঋণপ্রাপ্তির বিষয়টি সাংবাদিকদের জানাবেন তিনি।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাজেট প্রণয়ন কাজে সংযুক্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমান বাজেটের তুলনায় আগামী বাজেটে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। চলতি বাজেটে বৈদেশিক ঋণের লক্ষ্য ৯০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। আগামী বাজেটে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ বাড়িয়ে ১ লাখ কোটি টাকা বা ৮১৯ কোটি ডলারে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে।
এর মধ্যে ৫ উন্নয়ন সহযোগীর কাছ থেকেই প্রতিশ্রুতি রয়েছে ৩০০ কোটি ডলার বাজেট সহায়তার। এই প্রতিশ্রুতির মধ্যে আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ প্যাকেজের দুই কিস্তির ১৩০ কোটি ডলার, বিশ^ব্যাংকের ৫০ কোটি ডলার, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ৫০ কোটি ডলার, এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংকের (এআইআইবি) ৪০ কোটি ডলার ও জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) ২৫ কোটি ডলার রয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভোরের আকাশ’কে বলেন, ‘আইএমএফের ঋণপ্রাপ্তি অনিশ্চিত হয়ে পড়ায় আমরা দুশ্চিন্তায় পড়েছিলাম আগামী বাজেটের অর্থ সংস্থান নিয়ে। কারণ, আইএমএফ ঋণ না দিলে অন্যান্য দাতাসংস্থাগুলোও ঋণ দিতে অনীহা প্রকাশ করে। এখন এই সংকট কেটে যাওয়ায় আগামী বাজেটের অর্থসংস্থান নিয়ে অনিশ্চয়তা কেটে গেছে। আশা করি যথাসময়ে আমরা প্রতিশ্রুত ঋণগুলোর অর্থ পাবো।’
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটর আকার হবে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের তুলনায় তা সাত হাজার কোটি টাকা কম। মোট বাজেটের মধ্যে উন্নয়ন বাজেট বা এডিপি ৩৫ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে দুই লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা ও পরিচালন বাজেট ২৮ হাজার কোটি টাকা বেড়ে পাঁচ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা হতে পারে। বাজেট ঘাটতি জিডিপির পাঁচ শতাংশের নিচে থাকবে বলে আশা করছে অর্থ মন্ত্রণালয়। আগামী ২ জুন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ টেলিভিশন ভাষণে বাজেট উপস্থাপন করবেন।
এদিকে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, বড় ঘাটতি নিয়ে সরকার বাজেট দেবে না। গতকাল মঙ্গলবার সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নতুন ভবনে অর্থ উপদেষ্টার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা জানান।
উপদেষ্টা বলেন, আমরা মোটামুটিভাবে বাজেটটাকে বাস্তবায়ন করব। বিরাট একটা গ্যাপ (ঘাটতি) নিয়ে বাজেট করব না। বড়-বড় মেগা প্রজেক্ট নিয়ে ধার করে ডেফিসিট (ঘাটতি) দিয়ে এসব করব না। কিছুটা বাজেট ঘাটতি থাকবে। সেটা আমরা আইএমএফ ও ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের সঙ্গে বসে প্রজেক্টের বিষয়ে নেগোশিয়েট করব।
কল্যাণমুখী বাজেট প্রণয়নের লক্ষ্য : অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সমতাভিত্তিক ও কল্যাণমুখী বাজেট প্রণয়নের চেষ্টা করছে অন্তর্বর্তী সরকার। এবারের বাজেটে থাকছে কর প্রশাসন সহজ করার উপায়। অর্থনীতিতে স্বচ্ছতা আনা এবং বিনিয়োগ ও ব্যবসার উপযোগী পরিবেশ তৈরির কয়েকটি কৌশলও থাকছে এতে। বাজেটের লক্ষ্য থাকছে মূল্যস্ফীতি কমানো এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটানো। বাজেটে ব্যক্তি করমুক্ত আয়সীমা ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বাড়ানো হতে পারে।
সূত্র জানিয়েছে, উন্নয়নের জন্য রাজস্ব অপরিহার্য মনে করে বর্তমান সরকার। তাই রাজস্ব বাড়ানোর কৌশল হিসেবে এ বছরের জাতীয় বাজেটে যৌক্তিকভাবে কর বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে। দেশের উন্নয়ন কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে রাজস্ব আদায় বাড়ানো এখন জরুরি হয়ে পড়েছে বলে মনে করে সরকার। রাজস্ব বাড়ানোর জন্য সরকারের ওপর ব্যাপক চাপ রয়েছে বিধায় রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানোর জন্যই এটি করা হচ্ছে। সরকার মনে করে কাক্সিক্ষত রাজস্ব সংগ্রহ করতে না পারলে অগ্রগতি নিশ্চিত ব্যর্থ হবে।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) পাঁচ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য দেওয়া হতে পারে, যা চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে রয়েছে চার লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। তবে প্রত্যাশা অনুযায়ী কর আদায় না হওয়ায় চলতি অর্থবছরে রাজস্বের লক্ষ্য কমিয়ে চার লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা করা হয়েছে।
ভোরের আকাশ/এসএইচ