এসআই বাঁধন
প্রকাশ : ০৮ মে ২০২৫ ০৮:৪০ এএম
বাঘের ভয়েও দমে যান না মাহফুজা
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরা। সুন্দরবন ঘেঁষা এই এলাকার মানুষের প্রধান পেশা মাছ শিকার। নারী, পুরুষ, শিশু- সবারই একই পেশা। ঝড়-ঝঞ্ঝার সঙ্গে তাদের নিত্য লড়াই করতে হয়। এর পাশাপাশি কুমির আর বাঘের সঙ্গেও তাদের লড়াই করতে হয়। কখনো তারা হারেন; আবার কখনো জেতেন- এভাবেই টিকে আছেন তারা। এই লড়াকুদের একজন মাহফুজা বেগম। ৫২ বছর বয়সী এই যোদ্ধা প্রতিদিন দক্ষ হাতে নৌকা চালিয়ে সুন্দরবনের গভীরে নদীতে মাছ শিকার করেন। তিনি গলদা চিংড়ি ধরেন।
এই মাছ স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে যা আয় হয় তা দিয়েই চলে নানি-নাতনির সংসার। সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে সাপের মতো আঁকাবাঁকা নদী দিয়ে তিনি একাই নৌকা চালিয়ে গেছেন অনেক সময়। পৃথিবীর সব চেয়ে বড় শ্বাসমূলীয় এই বনের (ম্যানগ্রোভ বন) ভিতর দিয়ে বহু ছোটবড় খাল-নদী বয়ে গেছে। কোথাও কোথাও সূর্যের আলোও ঠিক মতো পৌঁছাতে পারে না। বনের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় আসন্ন বিপদ সম্পর্কে সদা সচেতন থাকতে হয়। এখানে জল-স্থল উভয় স্থানে বিপদ। জলে থাকে কুমির আর ডাঙ্গায় বাঘ। এগুলোর উপস্থিতি তিনি সহজেই আঁচ করতে পারেন। জলের সামান্য কম্পন কিংবা গাছের একটু নড়াচড়া বলে দেয় কুমির বা বাঘ ধারে-কাছেই রয়েছে। বলেন, পানি হয়তো শান্ত; কিন্তু সামান্য নড়াচড়া দেখেই বুঝতে পারি কুমির ডুবে আছে কাছেই।
মাহফুজা বলেন, বনে আগে এত পশুপাখির দেখা পাওয়া যেত না। ওরা থাকত বনের ভেতরেই; কিন্তু বন কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে ওরা আমাদের কাছাকাছি চলে আসছে। আমরা ওদের জায়গা দখল করেছি। ওরাও আমাদের জায়গা দখল করে নিতে চাচ্ছে। কুমির এখন প্রায়ই দেখা যায়। বৈঠা দিয়ে পানি ঠেললে ওরা নৌকার কাছাকাছি চলে আসে। তাই নৌকার কিনারে বসা যায় না। নৌকার সঙ্গে সঙ্গে চলতে চলতে ওরা আক্রমণ করতে চায়। তিনি এতো বাঘের সাক্ষাৎ পেয়েছেন যে সেগুলোর সংখ্যা মনে রাখা সম্ভব হয়নি। বেশিরভাগ সময়ই বাঘ দেখেছেন একটুখানির জন্য। গভীর জঙ্গলের ভেতর থেকে তাকিয়ে আছে একজোড়া জ্বলন্ত চোখ, দেখলেই গায়ে কাঁপুনি ওঠে! সম্প্রতি আলাপকালে মাহফুজা এক অভিজ্ঞতার কথা জানালেন।
তিনি বলেন, ২০১৯ সালের এক সকাল। তিনি জাল টানছিলেন। হঠাৎ খেয়াল করলেন পাখির ডাকাডাকি কমে গেছে। বাঘের উপস্থিতি টের পেলেই পাখিরা চুপ হয়ে যায়। তিনি ঘুরে তাকিয়ে দেখেন কয়েক হাত দূরেই নদীর তীরে একটি বাঘ দাঁড়িয়ে আছে। এটির দৃষ্টি তার দিকেই। তিনি একটা ধাতব পাত্র নিয়ে নৌকায় আঘাত করলেন; কিন্তু বাঘের নড়ার লক্ষণ নেই। ঠায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর বাঘটি আস্তে আস্তে বনের ভেতরে ঢুকে যায়।
মাহফুজা শিখেছেন কীভাবে শব্দ করে, চিৎকার করে, নৌকায় আঘাত করে বাঘকে ভয় দেখাতে হয়; কিন্তু সব সময়ই যে এটা কাজ করে তা না, ক্ষুধার্ত থাকলে বাঘ এসব ভয় পায় না। আর একবার যদি বাঘ আক্রমণ করে কারও কোনো উপায়েই বাঁচা সম্ভব নয়। ১৭ বছর আগের এক ভয়ানক অভিজ্ঞতার কথা জানালেন মাহফুজা। পড়ন্ত বিকেলে তিনি তার বড় ছেলে আলমগীর, বড় ভাই শাহাদাত আর তার স্ত্রীকে নিয়ে দুটি নৌকায় করে মাছ ধরছিলেন। জাল ছিঁড়ে যাওয়ায় তারা বাড়ির দিকে রওয়ানা হলেন। মাহফুজা আর তার ছেলে একই নৌকায়। পেছনের নৌকায় ভাই-ভাবী। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই মাহফুজা শুনতে পেলেন বাঘের গর্জন। নৌকা মাত্র তীরে ভিড়ছে। নৌকা ঘুরিয়ে তারা পেছন দিকে গেলেন তার ভাইয়ের নৌকার দিকে। শাহাদাতের নৌকাটি ছিল তীরের কাছে। একটি বাঘ তাকে আক্রমণ করে বনের ভিতরে নিয়ে যায়। শাহাদাতের স্ত্রী চিৎকার করতে থাকেন।
তিনি বলেন, ‘কিছু বোঝার আগেই বাঘ ভাইকে নিয়ে গেল!’ সেই রাতে প্রায় ১৫০ গ্রামবাসী মশাল হাতে বনে প্রবেশ করে শাহাদাতের খোঁজে। বাঘ সাধারণত রাতে শিকার করে না এবং আগুন ভয় পায়। তারা শাহাদাতের দেহাবশেষ খুঁজে পায়, হাড্ডি-মাংস কিছু নিয়ে আসে মাহফুজার বাড়িতে। এরপরও মাহফুজা ভয়ে ঘরে বসে থাকেননি। কারণ বনে মাছ না ধরলে তারা খাবেন কী?
তিনি বলেন, ‘আমার ক্ষুধা বাঘের ভয় পায় না। ভয় কাটিয়ে আমাকে আবার নদীতে যেতে হয়। যদি কপালে থাকে তাহলে আমিও হয়তো একদিন বাঘের মুখে পড়ব।’ মাহফুজার মতো তার গ্রামে আছে ৮ মৎস্যনারী। তাদের বয়স ৪০ থেকে ৬০ বছর। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তারা মাছ ধরতে যান নদীতে। গ্রামের সবচেয়ে দরিদ্র পরিবারগুলোর একটিতে মাহফুজার জন্ম। বাবা ছিলেন দিনমজুর। নৌকা ভাড়া করার মতো যথেষ্ট টাকা থাকলে মাঝে মাঝে মাছ ধরতেন।
মাহফুজা বলেন, ‘আমার আব্বা গরিবের চেয়েও গরিব ছিল। ছোটবেলায় আমি ভিক্ষা করতাম, মানুষের বাড়ি বাড়ি কাজ করতাম। তাও চলতো না।’ তারা ছিলেন ছয় ভাইবোন। তিনি চতুর্থ। এমন লোকদের কাছে ভিক্ষা করতেন যারা নিজেরাই ঠিক মতো খেতে পেত না। সব সময়ই পেটে ক্ষুধা থাকতো। মানুষের দেয়া ছেঁড়াফাড়া কাপড় পরতেন। আট বছর বয়সের গ্রামের এক লোকের কাছ থেকে মাছ ধরা শিখেন মাহফুজা।
তিনি বলেন, মাছ ধরতে হয় স্রোতের টানে। তখন মাছগুলো খাবার খুঁজতে আসে। পানির টান কমে গেলে ওরাও পানির তলে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। মাছ ধরা শেখার পর তারা দুবেলা পেটপুরে খেতে পান। ১২ বছর বয়স থেকেই মাহফুজা পুরো দস্তুর জেলে হয়ে যান। ১৬ বছর বয়সে এক লোককে বিয়ে করেনি তিনি। স্বামী ছিল দিনমজুর। ২২ বছর আগে তিন সন্তান রেখে অন্য এক নারীর হাত ধরে চলে যান তিনি। তিন সন্তানকে তিনি একাই বড় করেন। এখন তার দুই ছেলে দিনমজুরি করে। মেয়েটির ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিল। আবার বিয়ে করে এখন অন্য জায়গায় থাকে। ছেলেমেয়েরা কেউই তাকে কিছু দেয় না। মেয়ের আগের ঘরের নাতনি লাভলুকে নিয়ে মাহফুজার দিন কাটে। এই কিশোরী ইটভাটায় মাটি টানার কাজ করে। এই নাতিনই তার দুনিয়া।
ভোরের আকাশ/এসএইচ