আদমদীঘি (বগুড়া) প্রতিনিধি
প্রকাশ : ২৫ মে ২০২৫ ০৬:৩৪ পিএম
আদমদীঘির শতবর্ষী সোনারা মেলা
মেলা গ্রামীণ ও দেশজ সাংস্কৃতির ঐতিহ্য বহন করে। গ্রামীণ মেলা দেশজ মেল-বন্ধনের এক অন্যতম নিদর্শন। বাঙালির প্রাণের অনুষ্ঠান ঈদ বা পূজা-পার্বনের মতই মেলাতেও সবাই উঠে মেতে। মেলা উপলক্ষ্যে সবার সাথে দেখা-সাক্ষাৎ এবং কুশল বিনিময়ের সুযোগ সৃষ্টি হয়। এই এলাকায় ঈদের পরেই স্থানীয়রা এই গ্রামীণ সোনারা মেলাকে গুরুত্ব দেয়।
বগুড়া জেলার আদমদীঘি উপজেলার নসরতপুর ইউনিয়নের শাঁওইল গ্রামে সোনারা মেলা বসছে একশ বছরের বেশি সময় ধরে। প্রতি বছর বাংলা জৈষ্ঠ্য মাসের দ্বিতীয় রবিবার এই সোনারা মেলা চিরাচরিত নিয়মে পালিত হয়ে আসছে। মূলত এই মেলা চলে তিন দিন। তবে মূল মেলা চলে দুইদিন। মূল মেলার পরের দিন মহিলাদের জন্য মেলা চালু রাখা হয়।
প্রতি বছরই এই মেলাকে ঘিরে আদমদীঘি, তিলকপুর, আক্কেলপুর, দুপচাঁচিয়া, ক্ষেতলাল, কালাই, কাহালু উপজেলাসহ আশেপাশের উপজেলার গ্রামে গ্রামে চলে উৎসবের আমেজ। আত্মীয়-স্বজনের সমাগম আর কেনাকাটায় সরগমর হয়ে উঠে এলাকাটি। ব্যস্ততা বেড়ে যায় প্রতিটি বাড়ীতে। মেলা উপলক্ষে জামাতা ও আত্মীয়স্বজনকে আমন্ত্রণ করে আপ্যায়ন করার রেওয়াজ বহুকাল আগের। বাড়িতে বাড়িতে বানানো হয়েছে খই, মুড়কি, নারকেল ও চালের আটার নাড়ু। মেলা থেকে বড় মাছ ও ফলমূল কিনে আনার দায়িত্ব পড়ে নতুন জামাইদের উপর।
মেলায় বসেছে হরেক রকমের দোকানপাট। বড় বড় মাছ, রস গোল্লা, কাঠের সামগ্রী, নারীদের চুরি-ফিতা, গোশতের দোকান, ফলের দোকান, কাঁচা বাজার ও হরেক ধরনের আচারের দোকান। আগে এই মেলাতে চুন বেচাকেনা হতো। তবে এখন তেমন আর চোখে পড়ে না।
ছাট ছেলেমেয়েদের জন্য মেলায় রয়েছে নাগরদোলা, চড়কি এবং নৌকা দোল। এছাড়াও প্রায় ৬০টিরও বেশি খেলনার দোকান রয়েছে।
রোববার দুপুরে সরেজমিনে মেলায় গিয়ে দেখা গেল, পণ্যের পসরা নিয়ে এসেছেন ব্যবসায়ীরা। মিষ্টান্ন, খেলনা, চুড়ি, ফিতা, আলতা থেকে শুরু করে গৃহস্থালির কাজে ব্যবহৃত বিচিত্র জিনিসপত্র। এই মেলায় শুধু জিলাপি ভাজা হচ্ছে ৫০টির বেশি দোকানে। বিক্রিও হচ্ছে ভাল। সকাল থেকে একটানা চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত বেচা-বিক্রি। ঝুড়ি ভাঁজা (হুরুম) এই মেলার ঐতিহ্য।
মেলায় এসেছেন পাশবর্তী জেলার আক্কেলপুর উপজেলার গুডুম্বা এলাকার মিষ্টি ব্যবসায়ী কামরুল ইসলাম। তিনি জানান, একটানা কয়েক বছর এই মেলায় মিষ্টির দোকান নিয়ে আসি। এবারও বেচাকেনা ভাল হয়েছে। তবে বিকেলে সবচেয়ে বেশি বেচা-বিক্রি হয়। আশা করছি ভাল বেচাবিক্রি হবে।
তিনি অভিযোগ করে জানান, গতবছর প্রতি দোকান থেকে ১ হাজার টাকা করে খাজনা উঠানো হয়েছিল। এতে আমরা লাভ করতে পারতাম না। তবে এবছর খাজনা উঠানো হবে না বলে মাইকিং করা হয়েছে। খাজনা না দিলে অনেক দোকানদার এই মেলায় পণ্য নিয়ে আসবে। ফলে মেলা হবে আরও জমজমাট। আর বিক্রিও বাড়বে।
কোমারপুর চারমাথায় মিষ্টান্নের দোকান বসিয়েছে স্থানীয় জিনইর গ্রামের আহসান হাবীব। তিনি জানান, মেলায় মিষ্টি বিক্রি করে লাভবান হই। প্রতিবছরই এই মেলায় আমরা দোকান বসাই। প্রচুর লাভ করি। আবহাওয়া ভাল থাকলে এবছর প্রায় ৮ লক্ষ টাকার মিষ্টি বিক্রি হবে।
মেলায় দুপচাঁচিয়া উপজেলা থেকে এসেছেন তানভীর নামের এক যুবক। তিনি জানান, আমি স্থানীয়দের কাছে থেকে শুনে এই মেলা দেখতে এসেছি। মেলায় সবকিছুই আছে। তবে ইলেকট্রনিকস পণ্যের কোন দোকান দেখতে পাইনি। এছাড়া সবকিছুই ভাল লেগেছে।
সোনারা মেলার নামকরন সম্পর্কে স্থানীয় এক প্রবীণ জানান, যেই পুকুর পাড়ে সোনারা মেলা বসে সেটি অনেক দিনের পুরাতন। আমরা আমার দাদা-দাদীদের কাছে শুনেছি-যে মেয়ের সোনার জন্য বিয়ে হতো না, সে যদি ওই পুকুরে ডুব দিত। তবে সে সোনার গয়না পেয়ে যেত। সেখান থেকেই এই মেলার নামকরণ করা হয়েছে সোনারা মেলা।
ভোরের আকাশ/এসআই