আফগানিস্তানে ভূমিকম্পে নিহতের সংখ্যা ১৪০০ ছাড়াল, আহত ৩ হাজার
আফগানিস্তানে ভয়াবহ ভূমিকম্পে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১ হাজার ৪১১ জন হয়েছে। আহত হয়েছেন ৩ হাজার ১২৪ জন। ধ্বংস হয়ে গেছে ৫ হাজার ৪০০টির বেশি বাড়িঘর। পূর্বাঞ্চলের দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলের গ্রামগুলোতে উদ্ধার কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। তালেবান সরকারের মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ এ তথ্য জানিয়েছেন।আফগানিস্তানের রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি জানিয়েছে, ধ্বংসস্তূপের নিচে অনেক মানুষ আটকে থাকতে পারেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। অন্যদিকে দেশটিতে জাতিসংঘের সমন্বয়কারী বলেছেন, মৃত্যুর সংখ্যা আরো বাড়তে পারে। স্থানীয় সময় গত রোববার মধ্যরাতে আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলজুড়ে আঘাত হানা ওই ভূমিকম্পের তীব্রতা ছিল রিখটার স্কেলে ৬। মাত্র ১০ কিলোমিটার গভীরে ছিল এর উৎপত্তিস্থল। এতে কুনার ও নানগারহার প্রদেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।কুনার প্রদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রধান এহসানুল্লাহ এহসান বলেন, ভূমিকম্পে সেখানকার চারটি গ্রাম মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গত সোমবার সেখানে উদ্ধার অভিযান চালানো হয়। আরো দুর্গম পার্বত্য এলাকায় পৌঁছানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।এহসান বলেন, আমরা অনুমান করতে পারছি না, ঠিক কতগুলো মরদেহ এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে। আমাদের লক্ষ্য হলো, যত দ্রুত সম্ভব উদ্ধার অভিযান শেষ করা এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর মধ্যে ত্রাণ বিতরণ শুরু করা। পাহাড়ি ভূপ্রকৃতি ও প্রতিকূল আবহাওয়া কারণে পাকিস্তান সীমান্তসংলগ্ন দুর্গম এলাকায় পৌঁছাতে বাধার মুখে পড়ছেন উদ্ধারকর্মীরা। ভূমিকম্পে সেখানে শত শত কাদামাটি ও ইটের তৈরি ঘরবাড়ি ধসে পড়েছে।এহসান আরো বলেন, সরু পাহাড়ি সড়কে যানবাহন চলাচল করতে না পারায় অভিযান ব্যাহত হচ্ছে। সড়কের ধ্বংসাবশেষ অপসারণ করতে ভারী যন্ত্রপাতি আনা হচ্ছে। মঙ্গলবার প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়ি সড়কে সারি সারি অ্যাম্বুলেন্স কুনারের গ্রামগুলোর দিকে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। দুর্গম গ্রামে হেলিকপ্টারে করে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছানো হচ্ছে। আহত ব্যক্তিদের হাসপাতালে নিতেও ব্যবহার করা হচ্ছে হেলিকপ্টার।ভূমিকম্পের তীব্রতা এত বেশি ছিল যে কেন্দ্রস্থল থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে বেশ কয়েক সেকেন্ড কম্পন টের পাওয়া গেছে। প্রায় ৪০০ কিলোমিটার দূরে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে কম্পন অনুভূত হয়েছে।জাতিসংঘ মানবিক সংস্থার প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, রোববার গভীর রাতে পূর্ব আফগানিস্তানে আঘাত হানা ছয় মাত্রার এই ভূমিকম্পে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে এই ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থলের সবচেয়ে কাছে অবস্থিত পাহাড়ি কুনার প্রদেশে। দুর্গম এবং পাহাড়ি এলাকাটিতে উদ্ধারকাজ কঠিন হয়ে পড়েছে। হেলিকপ্টারের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত এসব এলাকায় পৌঁছানোর চেষ্টা করছেন উদ্ধারকারীরা।দুর্যোগ মোকাবিলা দপ্তরের উদ্ধারকর্মীরা সাধ্যমত সর্বোচ্চ গতিতে তৎপরতা চালাচ্ছেন উল্লেখ করে এহসান বলেন, “আমাদের লক্ষ্য যত শিগগির সম্ভব উদ্ধার তৎপরতা শেষ করে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর মধ্যে খাদ্য ও ত্রাণের বিতারণ শুরু করা।”কুনারের আসাদাবাদ এলাকার প্রাদেশিক হাসপাতালে কর্মরত একজন চিকিৎসক বলেন, ‘হাজার হাজার মানুষ তাদের ঘরবাড়ি হারিয়েছেন। আমাদের তাঁবু দরকার। আমাদের ওষুধ দরকার। রেড ক্রস সহায়তা দিচ্ছে, কিন্তু আমাদের আরও সাহায্যের প্রয়োজন।’তিনি আরও বলেন, ভূমিকম্পে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার এই বাসিন্দা জানান, তার ছোট হাসপাতালেই ২০০ জনেরও বেশি মানুষকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। কিছু দেশ এই দুর্যোগ পরিস্থিতিতে ত্রাণ সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও, ‘এখনও পর্যন্ত আমরা কিছুই পাইনি’।ওই চিকিৎসক বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত তালেবানের সঙ্গে তাদের যেকোনো মতপার্থক্য দূরে সরিয়ে আফগানদের সাহায্য করা এবং সাহায্য পাঠানো।’ অন্যদিকে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত কুনার প্রদেশ খুবই রক্ষণশীল হওয়ায় ওই এলাকার নারীদের চিকিৎসা সাংস্কৃতিক কারণে বিলম্বিত হতে পারে বলেও আশঙ্কা রয়েছে। মতিউল্লাহ শাহাবের বাড়ি কুনার প্রদেশের আসাদাবাদ গ্রামে। গ্রামটি ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল থেকে ১৬ কিলোমিটার বা প্রায় ১০ মাইল দূরে। তাঁর পরিবারের ২৩ জন সদস্য। ওই রাতে সবাই যাঁর যাঁর শোবার ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন। ভয় পেয়েছিলেন, হয়তো দেয়াল ভেঙে তাঁদের ওপর পড়তে পারে। পরে পুরো রাত তাঁদের বাগানে কাটে।শাহাব বলেন, ‘আমরা সবাই ভয় পেয়েছিলাম।’ ভূমিকম্পে আফগানিস্তানের কুনার ও নানগারহার প্রদেশ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে বহু দূরে রাজধানী কাবুল থেকেও কম্পন অনুভূত হয়েছে। প্রতিবেশী পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদেও ভূকম্পন হয়েছে। মতিউল্লাহ শাহাবের বাড়ি কুনার প্রদেশের আসাদাবাদ গ্রামে। গ্রামটি ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল থেকে ১৬ কিলোমিটার বা প্রায় ১০ মাইল দূরে। তাঁর পরিবারের ২৩ জন সদস্য। ওই রাতে সবাই যাঁর যাঁর শোবার ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে আসেন। ভয় পান, হয়তো দেয়াল ভেঙে তাঁদের ওপর পড়তে পারে। পরে পুরো রাত বাগানে কাটে তাঁদের। মতিউল্লাহ শাহাব পেশায় ফ্রিল্যান্স (স্বাধীন) সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী। ভোরের আলো ফোটার পর তিনি গাড়ি চালিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন। গন্তব্য ছিল ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ও আশপাশের প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকা। রাস্তায় বড় বড় পাথর পড়ে ছিল। এ কারণে একপর্যায়ে শাহাবকে গাড়ি থেকে নেমে যেতে হয়। পরে ঘণ্টা দুই হেঁটে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামগুলোয় পৌঁছান।শাহাব যখন আন্দারলাচক গ্রামে পৌঁছান, দেখেন, রাস্তার পাশেই কয়েকটি ছোট শিশুকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। দুটি ছোট শিশু স্ট্রেচারে একসঙ্গে শুয়ে রয়েছে। দুজনের বুকে ও মুখে আঘাতের ছাপ। সেখানে সাদা কাপড়ে মোড়ানো শিশুর মরদেহ দেখেছেন শাহাব। ভূমিকম্পের আঘাতে ওই এক গ্রামেই প্রায় ৭৯ জন নিহত হয়েছেন বলে জানান এ সাংবাদিক। বিবিসিকে তিনি বলেন, ‘আমি অনেকের মরদেহ দেখেছি। ১৭ বার পরাঘাত অনুভব করেছি।’গ্রামবাসীকে কবর খুঁড়তে সহায়তা করেছেন শাহাব। বলেন, ‘আমি যে গ্রামটিতে গেছি, সেটা প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে।’স্থানীয় একজন তাঁকে বলেছেন, ভূমিকম্পে তাঁর স্ত্রী ও চার সন্তানের প্রাণ গেছে।গ্রামবাসীর করুণ অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে শাহাব বলেন, ‘সবার মুখে, শরীরে ধুলোবালি লেগে রয়েছে। কারও মুখে কথা নেই। সবাই যেন রোবট হয়ে গেছেন। এ বিষয়ে (ভূমিকম্প) কেউ কিছু বলছেন না।’অনেক জায়গায় সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তালেবান প্রশাসনের উদ্ধারকাজ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। অনেক পার্বত্য এলাকায় হেলিকপ্টার দিয়ে উদ্ধারকাজ চালানো হচ্ছে। অনেক জায়গায় এখনো উদ্ধারকারী দলের পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। এমন অনেক জায়গা থেকে খবর আসছে, ধ্বংসস্তূপের নিচে অনেকে আটকা পড়ে আছেন। তাঁদের দ্রুত সহায়তা দরকার। অনেক জায়গায় সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তালেবান প্রশাসন উদ্ধারকাজে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। অনেক পার্বত্য এলাকায় হেলিকপ্টার দিয়ে উদ্ধারকাজ চালানো হচ্ছে। অনেক জায়গায় এখনো উদ্ধারকারী দলের পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। এমন অনেক জায়গা থেকে খবর আসছে, ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনো অনেকে আটকা পড়ে আছেন।তাঁদের দ্রুত সহায়তা দরকার শাহাব বলেন, উদ্ধারকর্মীরা ধ্বংসস্তূপে আটকে থাকাদের বের করে আনতে প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। তিনি নিজেও দুই নারীকে বাড়ির ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার হতে দেখেছেন।এ বিষয়ে শাহাব বলেন, ‘উদ্ধারকর্মীরা তাঁদের বের করে এনেছেন। তাঁদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।’ যদিও উদ্ধার কার্যক্রমের ছবি তোলার অনুমতি পাননি শাহাব। কেননা, তালেবান কখনোই নারীদের ছবি তোলা সমর্থন করে না। শাহাব বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোয় এখনো অনেকে খোলা আকাশের নিচে রয়েছেন। তাঁদের তাঁবু দরকার।কুনার প্রদেশের সোকাই জেলার অধিবাসী এজ্জাতুল্লাহ সাফি জানান, ভূমিকম্পে তাঁর বাড়ির একাংশ গুঁড়িয়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘চিৎকারে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। কম্পনটি বেশ তীব্র ছিল। রাতটা যেন সর্বনাশের অনুভূতি নিয়ে এসেছিল।’সাফি আরও বলেন, ‘ভূমিকম্পের পর প্রবল বাতাস হয়েছে। হালকা বৃষ্টিও। চারপাশ ধুলায় ছেয়ে গেছে। আমার শিশুসন্তানেরা আমাকে জড়িয়ে ধরে ভয়ে কাঁদছিল।’সাফি বলেন, ‘ভূমিকম্পের পর মোবাইল নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আমরা আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি। বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, বিদ্যুৎ নেই এ অবস্থায় মুঠোফোনের আলোয় রাত পার করেছি।’ সকালে সরকারি হেলিকপ্টার আসে। প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকাগুলো থেকে আহত ব্যক্তিদের উদ্ধার করে শুরুতে কুনারের প্রধান মহাসড়কে নিয়ে যায়। সেখান থেকে সড়কপথে তাঁদের বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো হয় বলে জানান সাফি।সাফি বলেন, এলাকায় শোকের আবহ। বিদ্যুৎ নেই। বাজার, দোকানপাট বন্ধ। কিছু জায়গায় এখনো পৌঁছানো যায়নি; বিশেষ করে প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রামগুলোতে। সেখানে যেতে ৫-৬ ঘণ্টা লেগে যায়।ভোরের আকাশ/এসএইচ