শুধু হারের গল্প নয়, আত্মমর্যাদার অপমৃত্যু
রাজীব দাশ
প্রকাশ : ২৪ মে ২০২৫ ০৯:৫৬ পিএম
ক্রিকেটে ব্যর্থতার এক প্রতিচ্ছবি
একটি হার অনেক সময় চোখে জল এনে দেয়, কিন্তু কিছু হার থাকে, যেগুলো বুকে আগুন ধরিয়ে দেয়। সংযুক্ত আরব আমিরাতের কাছে বাংলাদেশের টানা হার তেমনই এটা শুধু স্কোরলাইনে লেখা একটি সিরিজের পরাজয় নয়, এটি এক জাতির ক্রিকেট স্বপ্নের চরম ব্যর্থতার দলিল। এমন হার আমাদের ভাবিয়ে তোলে এই দলটি কি আসলেই বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছে? এই দলটির পেছনে যে বোর্ড, যে কাঠামো, যে কোচিং স্টাফ তারা কি আদৌ জানেন কীভাবে একটি জাতীয় দল পরিচালনা করতে হয়?
একটি দুর্ঘটনা, নাকি পরিকল্পিত আত্মসমর্পণ: প্রথম ম্যাচে ২০৫ রান করে হার, দ্বিতীয় ম্যাচে ব্যাটিং ধস, তৃতীয় ম্যাচে আত্মবিশ্বাসের চরম ঘাটতি সব মিলিয়ে বাংলাদেশ দল যেন ম্যাচ খেলতে নয়, ম্যাচ ‘পুরণে’ নেমেছিল। একটি ম্যাচ হারা যেতে পারে, কিন্তু একই দলের কাছে টানা দুটি ম্যাচ হার মানে শুধুই ব্যর্থতা নয়, এটা একটি ধসে পড়া মানসিক কাঠামোর প্রকাশ। যে মানসিকতা একসময় হাবিবুল বাশার, মাশরাফি বিন মর্তুজা, কিংবা শফিকুল হকের দলের মাঝে দেখা যেত, আজ তা নিখোঁজ।
পরিকল্পনার অভাব ও চেতনার সংকট: বাংলাদেশ দলের বোলিং লাইনআপে ছিল না কোনো নতুনত্ব, ছিল না কৌশলগত চিন্তা। প্রতিপক্ষ ব্যাটারদের বিপক্ষে একঘেয়ে লেন্থে বল করে গেছে পুরো সিরিজজুড়ে। বোলিংয়ে না ছিল আগ্রাসন, না ছিল ম্যাচ রিডিং করার চেষ্টা। পুরো সিরিজে একটি সঠিক ইয়র্কার পর্যন্ত চোখে পড়েনি। কোথাও যেন ‘জেতার পরিকল্পনা’ই ছিল না। তার থেকেও হতাশাজনক ছিল খেলোয়াড়দের শরীরী ভাষা। মাঠে তাদের উপস্থিতি ছিল প্রাণহীন, যেন কোনো চাকরির অংশ হিসেবে তারা মাঠে এসেছে। না ছিল আগ্রাসী মনোভাব, না ছিল লড়াইয়ের স্পৃহা। তারা যেন খেলছিল না, শুধুই উপস্থিত ছিল।
দলের অভ্যন্তরীণ বিচ্ছিন্নতা ও নেতৃত্বের সংকট: জাকের আলীর মত একজন ব্যাটার যখন অষ্টম উইকেট জুটিতে স্ট্রাইক না নিয়ে একজন পেসার তানজিমকে স্ট্রাইক দেন, তখন প্রশ্ন ওঠে গেম সেন্স নিয়ে। দলীয় সমন্বয়, পরস্পরের বোঝাপড়া, পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত সব কিছুতেই রয়েছে বড় ধরনের ঘাটতি। মাঠে একেকজন যেন একেকদিকে টানছে, নেতৃত্বে নেই নির্ভরতা, আর খেলোয়াড়দের মধ্যে নেই আত্মবিশ্বাসের যোগসূত্র।
শুধু অজুহাত দিয়ে দায় এড়ানো যাবে না: হারের পর অধিনায়ক যখন শিশিরের কথা বলেন, তখন সেটি কেবল দায়িত্ব এড়ানোর অপচেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়। একটি পেশাদার আন্তর্জাতিক দলের উচিত পরিবেশ অনুযায়ী নিজেদের মানিয়ে নেওয়া। শিশির যদি সমস্যা হয়ে থাকে, তাহলে সেটি প্রতিপক্ষের জন্যও সমান প্রযোজ্য। এই অজুহাত শোনার পর দর্শক বুঝে যায় এই দল শুধুই মাঠে হারে না, তারা মানসিকভাবে পরাজিতও।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের বিভ্রান্তি ও দিশাহীনতা: এই পরাজয়ের দায় শুধু খেলোয়াড়দের নয়। বরং বড় দায় পড়ে সেই কাঠামোর ওপর, যারা এই খেলোয়াড়দের তৈরি করে, পরিচালনা করে এবং মাঠে পাঠায়। বিসিবির ভেতরে বর্তমানে চলছে চরম নেতৃত্ব সংকট। কে হবেন পরবর্তী সভাপতি, কে থাকবেন পরিচালনা পর্ষদে এসব নিয়ে বিভক্ত মতামত ও গ্রুপিং মাঠের ক্রিকেটের চেয়েও বেশি আলোচিত। ৫ আগস্টের পর বোর্ডে বড় পরিবর্তনের পরও মাঠে তার কোনো ইতিবাচক প্রতিফলন নেই। বরং মিডিয়া ও ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের দুই চেয়ারম্যানের ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য বোঝায় বোর্ড নিজেরাই জানে না তারা কোন পথে হাঁটছে।
কোচ, কাঠামো ও খেলোয়াড় তিন স্তরেই ব্যর্থতা: দেশি-বিদেশি ব্যাটিং কোচ, টেকনিক্যাল অ্যানালিস্ট সব কিছু থাকার পরও ব্যাটিং ব্যর্থতা বছরের পর বছর ধরে একই জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছে। তাহলে সমস্যা কোচিংয়ে, না খেলোয়াড়দের শেখার আগ্রহে? মিডিয়া কমিটির চেয়ারম্যান ইফতেখার মিঠু বলেন, শেখানোর ঘাটতি নেই, মাঠে প্রয়োগ নেই। ব্যাটাররা না আছে উইকেট মূল্যায়নে দক্ষ, না আছে ইনিংস গড়ার ধৈর্য। দলের মধ্যে নেই নেতৃত্বের দৃঢ়তা, নেই ধারাবাহিকতা। এক ম্যাচ ভালো খেললে তিন ম্যাচ গড়বড় এমন পারফরম্যান্স দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে টিকে থাকা যায় না।
এই কি সেই বাংলাদেশ দল: আমরা একদিন অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়েছি, ভারতকে কাঁপিয়েছি, ইংল্যান্ডকে পর্যুদস্ত করেছি। কিন্তু আজ আমরা সেই সব দিনের মতো গর্বের কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। আজকের দল যেন শুধু ‘জার্সি পরা’ লোকদের একটি দল যারা কাজ শেষ করতে মাঠে যায়, দেশের জন্য লড়াই করতে নয়। যেন একদল কর্মচারী মাঠে আসেন মাস শেষের বেতন পেতে।
এখনই সময় চোখে চোখ রাখার: আমরা যদি এখনই আত্মসমালোচনা না করি, তবে এমন হারই আমাদের ভবিষ্যৎ হবে। এই পরাজয় কেবল স্কোরবোর্ডে লেখা ২-১ সিরিজ নয় এটি আমাদের আত্মবিশ্বাসের অপমৃত্যু। এখনই সময় বোর্ড, খেলোয়াড়, মিডিয়া ও সমর্থকদের এক হয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটকে নতুন করে গড়ে তোলার। বাংলাদেশ ক্রিকেট এখন এক সংকটময় বাঁকে দাঁড়িয়ে। এই দল, এই বোর্ড, এই কাঠামো সবকিছুকে নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। এখনই সিদ্ধান্ত না নিলে, ভবিষ্যতের ক্রিকেট ইতিহাসে ২০২৫ সালের আমিরাত সিরিজ এক বিভীষিকার নাম হয়ে থাকবে। আমিরাতের কাছে এইভাবে হার শুধুমাত্র একটি ম্যাচ হার নয় এটি আত্মপরিচয়, আত্মমর্যাদা এবং জাতিগত ক্রিকেট চেতনার এক ভয়াবহ ক্ষয়। এখনই সময় প্রশ্ন তোলার বাংলাদেশ ক্রিকেট কোথায় যাচ্ছে? এবং সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করে জেগে ওঠার।
ভোরের আকাশ/এসএইচ