ভোরের আকাশ ডেস্ক
প্রকাশ : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১১:৩২ এএম
ছবি: সংগৃহীত
ঈদে মিলাদুন্নবী কি ও ঈদে মিলাদুন্নবী পালন করা কি ইসলামের দৃষ্টিতে সঠিক কি না -সেই বিষয়েই আল কোরআন ও হাদিসের দলিলসহ আলোচনা করা হলো।
ঈদে মিলাদুন্নবী কি?
ঈদে মিলাদুন্নবী; যার আরবি প্রতিশব্দ হলো “مَوْلِدُ النَبِيِّ”। ঈদে মিলাদুন্নবী হলো ইসলামের শেষ নবী ও রাসুল হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর আগমন উপলক্ষে মুসলিমদের মাঝে পালিত এক আনন্দ উৎসব। মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) ১২ ই রবিউল আউয়াল হিজরিতে জন্মগ্রহণ করেন।
মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর জন্ম তারিখ ১২ রবিউল আউয়াল কিনা এই বিষয়ে অনেকের মাঝেই মত পার্থক্য থাকলেও তিনি যে ১২ই রবিউল আউয়াল হিজরিতেই ওফাত বরন (শেষ নিশ্বাস ত্যাগ) করেন এই বিষয়ে কারোর মাঝে কোন মতো বিরোধ নাই। অর্থাৎ রাসুল (সা.) এর জন্মদিন ও মৃত্যুদিন একই দিনে।।
যেহেতু জন্ম দিন ও মৃত্যু দিন একই দিনে, সেহেতু মুসলিম সমাজের জন্য এটি একিই সাথে যেমন আনন্দের আবার তেমনি কষ্টদায়ক। আর এই কারণেই অনেকেই এই দিনে আনন্দ উৎসব পালন করেন না ও পালনে নিরুৎসাহিত করে থাকেন। আমাদের বাংলাদেশে এই দিনটাকে মিলাদুন্নবী হিসেবে বলা হলেও অন্যান্য জায়গায় অন্যান্য নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। যেমন পশ্চিমবঙ্গের মুসলিমগণ এই দিনটাকে নবী দিবস হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকেন।
ঈদে মিলাদুন্নবীর উৎপত্তি কীভাবে?
মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর মৃত্যুর ও অনেক পরে থেকে এই মিলাদুন্নবীর প্রচলনে ঘটে। মহানবী (সা.) এর জীবদ্দশায় ও সাহাবিদের সময়কালেও এই ঈদে মিলাদুন্ন নামে কোন কিছুই ছিল না। মহানবী হযরত মোহাম্মদ সা. প্রতি সোম ও বৃহস্পতিবার করে রোজা রাখতেন এবং তাকে এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে জবাবে তিনি বলেন, সোমবারে তিনি জন্ম গ্রহন করেছেন এবং এই দিনেই তিনি নবুয়ত প্রাপ্ত হয়েছেন আর সেই কারণেই শুকরিয়া স্বরূপ এই দিনে রোজা রাখতেন।
প্রতি সোমবারে বিশ্বনবী কেন রোজা রাখতেন এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন –
ﻋَﻦْ ﺍَﺑِﻰ ﻗَﺘَﺪَﺓَ ﺍﻻَﻧْﺼﺎَﺭِﻯ ﺭَﺿِﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋَﻨﻪُ ﺍَﻥَّ ﺭَﺳُﻮﻝَ
ﺍﻟﻠﻪِ ﺻَﻠَّﻰ ﺍﻟﻠﻪُ ﻋَﻠَﻴْﻪِ ﻭَﺳَﻠَّﻢَ ﺱﺀﻝ ﻋَﻦْ ﺻَﻮْﻡِ ﻳَﻮْﻡ ﺍﻻِﺛْﻨَﻴْﻦِ ﻗَﻞَ ﺫَﺍﻙَ ﻳَﻮْﻡٌ ﻭُﻟِﺪْﺕُ ﻓِﻴْﻪِ ﺑُﻌِﺜْﺖُ ﺍَﻭْﺍُﻧْﺰِﻝَ ﻋَﻠَﻰَّ ﻓِﻴْﻪِ –
“এই দিনে আমার বেলাদত শরীফ হয়েছে, এই দিনে আমি প্রেরিত হয়েছি এবং পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফ এই দিনেই আমার উপর নাজিল হয়েছে।”
সোমবার রোজা রাখার দলিল :
সহিহ মুসলিম শরীফ ২য় খণ্ড, ৮১৯ পৃষ্ঠা।
বায়হাকী: আহসানুল কুবরা,৪র্থ খণ্ড, ২৮৬ পৃষ্ঠা।
মুসনাদে আহমদ ইবনে হাম্বল,৫ম খণ্ড, ২৯৭ পৃষ্ঠা।
এছাড়াও প্রতি সোমবার রোজা রাখার পেছনে আরেকটি কারণ উল্লেখ করে রাসুল (সা.) বলেন –
عن أبي هريرة : أن رسول الله صلى الله عليه و سلم قال تعرض الأعمال يوم الإثنين والخميس فأحب أن يعرض عملي وأنا صائم
“হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূল ﷺ ইরশাদ করেছেন: সোমবার ও বৃহস্পতিবার আমল উপস্থাপন করা হয় [আল্লাহর কাছে]।আর আমার আমল উপস্থাপন করার সময় রোযারত থাকাকে পছন্দ করছি।”
এই হাদিসের দলিল :
সুনানে তিরমিজী, হাদিস নাম্বার -৭৪৭
সুনানে নাসায়ী কুবরা, হাদিস নাম্বার -২৬৬৭
মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নাম্বার -২১৭৫৩
হিজরি ৪র্থ শতাব্দীর প্রায় মাঝের দিকে ঈদে মিলাদুন্নবীর প্রথম প্রচলন শুরু হয়। পরবর্তীতে ৭ম হিজরির দিকে এই মিলাদুন্নবী ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এই মিলাদুন্নবীর প্রথম প্রবর্তনা খলিফা আল মুয়িজ্জু লি-দীনিল্লাহ। ৪র্থ হিজরি থেকে এটি শুরু হলেও আনুষ্ঠানিক রূপ পায় ৭ম হিজরিতে। তাই এটা বলায় যায় রাসূল (সাঃ), সাহাবী গনদের সময়ে কোন ঈদে মিলাদুন্নবী বলতে কিছুই ছিল না। এই ৭ম হিজরি ছিল ইসলাম পরবর্তী বর্বর যুগ। এই যুগে মুসলিমগণ বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল আর তাদের মাঝে প্রায়ই গৃহযুদ্ধ লেগে থাকত।
ঈদে মিলাদুন্নবীর স্বপক্ষে দলিল :
এখন, যারা ঈদে মিলাদুন্নবী পালন করেন ও এটিকে সমর্থন করেন তাদের দেওয়া কিছু যুক্তি হলো। আল্লাহ তায়ালা আল কোরআনে বলেন।
“আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমত প্রাপ্তিতে খুশি পালন কর যা তোমাদের সমস্ত ধন দৌলত অপেক্ষা শ্রেয়।” – (সূরা ইউনুস-৫৮)
অপর একটি আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, “আমি নিশ্চয় আপনাকে পুরো বিশ্বের জন্য রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছি”।
তো এখান থেকে বোঝা যায় যে, যেহেতু এই দিনে রাসুল সাঃ এর আগমন ও নবুয়ত প্রাপ্তি হয়েছে তাই আমরা চাইলেই এই দিনটাকে ঈদ হিসেবে পালন করতেই পারি। কিন্তু সমস্যা হলো এই একিই দিনে আবার রাসূল সাঃ ওফাত বরন করেন। তাহলে যেদিন আমাদের রাসুল সাঃ মৃত্যুবরণ করলেন সেইদিনে কীভাবে একজন মুসলিম হিসেবে আপনি আনন্দ উৎসব করতে পারেন?
এই দিনে আনন্দ মিছিল ও উৎসবের আয়োজন করা একেবারেই যুক্তিহীন।
ঈদে মিলাদুন্নবী তে আমাদের করণীয় কি?
ইসলামে সন্দেহের কোন অবকাশ নাই। আর ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করতেও সম্পূর্ণ নিষেধ করেছেন রাসুল (সা.)। এই সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা আল কোরআনে ইরশাদ করেছেন।
“কিতাবধারী হে! নিজেদের ধর্ম নিয়ে অযথা বাড়াবাড়ি কোরো না। আর (ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করে) তোমাদের আগে যারা নিজেরা পথভ্রষ্ট হয়ে ও অন্যদেরকে পথভ্রষ্ট করে সহজ সরল পথচ্যুত হয়েছে, তাদের পথ অবলম্বন কোরো না।” (সুরা মায়িদা : ৭৭)
“হে কিতাবধারীরা! তোমরা তোমাদের ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়িতে লিপ্ত হয়ো না। আর আল্লাহ সম্বন্ধে যথাযথ বলো।” (সুরা নিসা : ১৭১)
উপরের আয়াত দুইটির মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে, ইসলামে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ির কোন স্থান নাই। তাই আমাদের উচিত না এসব বিষয় নিয়ে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করা। যেহেতু এই বিষয় নিয়ে ইসলাম বিশেষজ্ঞদের মাঝে মতো বিরোধ রয়েছে আর এটি কোন ফরজ বা ওয়াজিব বা সুন্নাত কোন ইবাদত ও না অথবা এটি এমন কিছুও না যে যেটি না করলে আমাদের গুনাহ হবে, তাই এসব এড়িয়ে চলায় আমাদের জন্য উত্তম।
বিদায় হজের ভাষণে রাসূল (সা.) সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে যে ভাষণ দিয়েছিলেন, সেখানে তিনি বলেছিলেন-
“আমি তোমাদের জন্য দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি যতদিন আকড়ে ধরবে ততদিন পথভ্রষ্ট হবে না। একটি হলো আল্লাহর কিতাব এবং অপরটি আমার সুন্নাহ্” (মিশকাত-১ম খন্ড হাদিস নং-১৭৭)
অর্থাৎ রাসুল (সাঃ) আমাদের বলে গেছেন আমরা যেন কেবল মাত্র আল্লাহ প্রদত্ত আল কোরান ও রাসূল (সাঃ) এর হাদিস অনুসরণ করি তাহলেই আমরা কখনো পথভ্রষ্ট হব না। আর আমাদের ও সেটিই করা উচিত৷ বর্তমান সময়ে। আর যেহেতু কোরান হাদিসে এই মিলাদুন্নবী সম্পর্কে সরাসরি কোন হুকুম নাই তাই আমাদের উচিত এসব থেকে দূরে থাকা।
কোরআন হাদিসের মাধ্যমে আমাদের উপর যে হুকুম গুলো দেয়া হয়েছে সেই সবের বাইরে গিয়ে কোন কিছু করা মানেই ঝামেলায় জড়ানো। একজন মুসলিম হিসেবে নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকাত সহ অন্যান্য সকল ফরজ সুন্নত ও ওয়াজিব আমাদের পালন করা উচিত। এইসব নফল বা মুস্তাহাব বিষয় নিয়ে নিজেদের মাঝে ফেতনা সৃষ্টি করা নেহাত বোকামি ছাড়া আর কিছুই না। যেহেতু হযরত মোহাম্মদ সাঃ শেষ রাসুল ও নবী এবং এর কোন নবী রাসুল এই পৃথিবীতে আসবে না, তাই আমাদের উচিত হলো কোরান হাদিস অনুসরণ করে সেই অনুযায়ীই জীবনযাপন করা।
ভোরের আকাশ/মো.আ.