জাতীয় সংসদ নির্বাচন
মাজাহারুল ইসলাম
প্রকাশ : ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৯:১৪ এএম
ফাইল ছবি
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে সর্বশেষ ভাষণে বলেছেন, আগামী বছর ফেব্রুয়ারির প্রথম ভাগে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। নির্বাচন কমিশনও ইতোমধ্যে নির্বাচনের পথনকশা ঘোষণা করেছে। বর্তমানে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপিই দ্রুত নির্বাচনের জন্য সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিল। সরকারের সঙ্গে এ বিষয়ে তাদের মতের মিল হচ্ছিল না। প্রধান উপদেষ্টার নির্বাচনের সময়সীমা ঘোষণার পর সমস্যা কেটে গেছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগামী ফেব্রুয়ারিতে হচ্ছে- এটা এখন বলাই যায়।
জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি নির্বাচন পেছানোর জন্য নানা কথা বললেও দুই দলই ভেতরে ভেতরে নির্বাচনের প্রস্তুতি চালাচ্ছে বলে জানা গেছে। সূত্র বলছে, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ না থাকায় বিএনপির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হতে চাইছে জামায়াত ইসলামী ও এনসিপি। এ জন্য ইসলামী আন্দোলনসহ অন্য ইসলামপন্থি দলগুলোর সঙ্গেও কথা বলেছেন দল দুটির নেতারা। অন্যদিকে, পুরোনো মিত্রতার সূত্র ধরে ইসলামপন্থি দলগুলোর সঙ্গে বিএনপিও যোগাযোগ রাখছে। এমনকি কাউকে কাউকে আসন ছাড় দেওয়ার প্রস্তাবও দিয়েছে। নানা হিসাব-নিকাশ চলছে ইসলামী দলগুলো নিয়ে।
ইসলামী দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ফ্যাসিবাদী আমলে ইসলামপন্থি দলগুলো নানাভাবে নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছে। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন বাংলাদেশকে বিবেচনায় নিয়ে আদর্শিক দ্বন্দ্ব ভুলে বৃহত্তর স্বার্থে এক হওয়ার জন্য ঐক্যের প্রক্রিয়া অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছেন তারা। জামায়াতকে সামনে রেখে ইসলামী জোটের সমীকরণ এগোচ্ছে।
গত বছর ৫ আগস্টের পর ইসলামী দলগুলো নিয়ে ঐক্যের ডাক কিংবা এক প্ল্যাটফর্মে আনার আলোচনা শুরু করে জামায়াতে ইসলামী। এরপর এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয় চরমোনাই পীরের দল-ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। এরই মধ্যে বেশ কয়েক দফা বৈঠক করেছে ইসলামী দলগুলো। তবে আসন সমঝোতার বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। আপাতত প্রতিটি দল নিজস্ব সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয়। সামগ্রিক ঐক্যের ব্যাপারে তারা আশাবাদী।
জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগর উত্তরের আমির সেলিম উদ্দীন বলেন, ‘ঐক্যের ব্যাপারে আমরা আশাবাদী। সবাই নিজ নিজ দলে কাজ করছি। মতভেদ, আদর্শিক বিভক্তি এখন আর নতুন বাংলাদেশে কোনো ইস্যু হবে না। ইসলামী দলগুলোর ঐক্যের প্রক্রিয়াটি খুবই পজিটিভলি এগোচ্ছে। ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশ, মতভেদ ভুলে সবাই পাশে থাকবে। ঐক্য হবেই।’
হেফাজতে ইসলামের ঘনিষ্ঠ কওমি মাদরাসাভিত্তিক দলগুলো ৫ আগস্টের পর থেকেই বলছে, আগামী নির্বাচনে লক্ষ্য ইসলামপন্থিদের ভোট ‘এক বাক্সে আনা’। চলতি বছরের ১৭ এপ্রিল খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও নেজামে ইসলাম পার্টি আলোচনার টেবিলে বসে একই লক্ষ্যের কথা বলেছে। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলনও।
ফলে ভোটের রাজনীতিতে জামায়াতের পর তারা ধর্মভিত্তিক দ্বিতীয় বৃহত্তম দল। তাদের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, আগামী নির্বাচনে প্রতিটি আসনে সমমনা দলগুলোর সম্মিলিতভাবে একক প্রার্থী থাকবে। তবে যেখানেই যাক, এই পাঁচ দল একসঙ্গে থাকবে। দাবি করা হয়, প্রয়োজনীয় ও মৌলিক সংস্কার শেষে যৌক্তিক সময়ের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন হবে।
জোট কতটা সম্ভব : আদর্শিক বিরোধ থাকলেও চলতি বছরের ২১ জানুয়ারি জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান ও ইসলামী আন্দোলনের আমির সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীমের সাক্ষাৎ হয়। বিএনপির একাধিক নেতা একে ‘স্বাধীনতাবিরোধী এবং ফ্যাসিবাদের সহযোগীর মিলন’ আখ্যা দিয়ে কটাক্ষ করেন। কিন্তু পাঁচদিন পর চরমোনাই পীরের সঙ্গে দেখা করতে ইসলামী আন্দোলনের কার্যালয়ে যান বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ন্যূনতম সংস্কার শেষে দ্রুত সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনসহ ১০ দফায় একমত হয়ে ঘোষণাপত্রে সই করে দল দুটি।
এর আগে চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি খেলাফতে মজলিসের সঙ্গে বৈঠক করে বিএনপি। তবে খেলাফত মজলিসসহ অধিকাংশ ধর্মভিত্তিক দল বৈঠক করে জামায়াতের সঙ্গে। গত ২৯ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে খেলাফতের সম্মেলনে যোগ দিয়ে জামায়াতের আমির বলেছিলেন, ইসলামী দলগুলোর মাথায় আর কেউ কাঁঠাল ভেঙে খেতে পারবে না। ১২ দলীয় জোট, সমমনা দলের সঙ্গে নেতারাও জামায়াতের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। এখন অবশ্য প্রায় সব ইস্যুতে বিএনপির পক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন তারা।
৫ এপ্রিল হেফাজত নেতারা বিএনপির সঙ্গে বৈঠক করেন। দুই খেলাফত মজলিস, জমিয়ত ও নেজামে ইসলামের নেতারা হেফাজতেরও জ্যেষ্ঠ নেতা। ৯ এপ্রিল এনসিপি কার্যালয়ে বৈঠক করেন হেফাজত নেতারা। সেই বৈঠকে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ এবং জুলাই গণহত্যার বিচারে দৃশ্যমান অগ্রগতির দাবির সঙ্গে ঐকমত্য জানায় হেফাজত।
২০ এপ্রিল আবদুল বাসিত আযাদের নেতৃত্বাধীন খেলাফতের সঙ্গে বৈঠক করে এনসিপি। মৌলিক সংস্কারের পর ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই সনদ প্রণয়ন করে দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচনসহ আট দফায় একমত হয় দল দুটি।
আদর্শিক দ্বন্দ্বের কারণে জামায়াতের সঙ্গে বৈঠক করেনি হেফাজত। তাই গত কয়েক মাসে হেফাজত-সংশ্লিষ্ট দলগুলোও জামায়াত থেকে দূরে সরে গেছে। যদিও ৫ আগস্টের পর কাছাকাছি এসেছিল। নিবন্ধিত অপর দুই ইসলামপন্থি দল ইসলামী ঐক্যজোট ও খেলাফত আন্দোলনকেও সমমনা পাঁচ দলের মোর্চায় রাখা হবে বলে সূত্র জানিয়েছে।
দল দুটি ডামি নির্বাচনখ্যাত ৭ জানুয়ারির ভোটে অংশ নেয়। ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান আবদুল হাসনাত আমিনী ও মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহকে ইতোমধ্যে বাদ দেওয়া হয়েছে। ইসলামী ঐক্যজোটের মতো খেলাফত আন্দোলনকেও পরিশুদ্ধ করে আনা হবে বলে একাধিক নেতা জানিয়েছেন।
মাওলানা মামুনুল হকের নেতৃত্বাধীন খেলাফতের যুগ্ম মহাসচিব আতাউল্লাহ আমিন বলেন, বিএনপি ও জামায়াত থেকে সমদূরত্ব রেখে প্রথম লক্ষ্য নিজেদের একতা। পরে অন্য কারও সঙ্গে জোট হবে কিনা তা নির্বাচনের আগের পরিবেশ-পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করবে। ৫ আগস্টের পর চরমোনাই পীরের দলের নেতারা চাঁদাবাজি ও দখলের জন্য বিএনপিকে অভিযুক্ত করে আসছে। বিএনপির নেতারাও তাদেও সমালোচনা করছে।
সমমনা পাঁচ দল বিএনপি বা জামায়াতের সঙ্গে জোট করবে কি-না প্রশ্নে ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব ইউনুস আহমাদ বলেন, সিদ্ধান্ত হয়েছে পাঁচ দল যা করবে, তা একসঙ্গে। যদি কোনো দলের সঙ্গে জোট হয়, সবাই মিলেই করবে। কেউ এককভাবে অন্য কোনো দলের সঙ্গে জোট করবে না।
গত ২৫ জুলাই এক বৈঠকে আগামী নির্বাচন সামনে রেখে ঐক্য প্রক্রিয়াকে আরও গতিশীল করার বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করেন কওমি ঘরানার চার দলের শীর্ষ নেতা। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হক, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ড. আহমাদ আবদুল কাদের, নেজামে ইসলাম পার্টির সহ-সভাপতি মাওলানা আব্দুল মাজেদ আতহারী, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আতাউল্লাহ আমীন ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ থেকে উপস্থিত ছিলেন দলের মহাসচিব অধ্যক্ষ মাওলানা ইউনূস আহমদ।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব অধ্যক্ষ মো. ইউনূস আহমেদ বলেন, জামায়াতসহ ঐক্য হবে এটা মোটামুটি নিশ্চিত। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, নেজামে ইসলাম পার্টি, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন ঐক্যের ব্যাপারে পজিটিভ। আশা করি সমঝোতাও হবে। আপাতত প্রত্যেক দল তার এলাকায় কাজ করছে। আসন সমঝোতার সময় কে কোথায় নির্বাচন করবে, তখন সে সিদ্ধান্ত হবে।
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনসিপি ঘনিষ্ট একটি রাজনৈতিক দলের এক নেতা জানান, আওয়ামী লীগ পালিয়ে যাওয়ায় বিএনপির নির্বাচনী বিজয় প্রায় নিশ্চিত। ভোটের মাঠে বিএনপির চেয়ে অনেক পিছিয়ে থাকা জামায়াতের কাছ থেকে ৫ থেকে ১০ আসন ছাড় পাওয়ার চেয়ে বিএনপির কাছ থেকে এক থেকে দুটি আসন পেলেও সংসদে যাওয়া অধিকতর নিশ্চিত। এ সমীকরণে দলগুলো বিএনপির দিকেই যাবে। ভোটের মাঠে এনসিপি জামায়াতের চেয়ে দুর্বল। এ দলটিকে কারও না কারও সঙ্গে জোট করতে হবে।
জামায়াত ইসলামপন্থি হলেও তাদের মোর্চায় না রাখার বিষয়ে সমমনা একটি ইসলামী দলের এক জ্যেষ্ঠ নেতা বলেন, আবুল আলা মওদুদীর আদর্শ নিয়ে অরাজনৈতিক দেওবন্দ ঘরানার আলেম-ওলামাদের আপত্তি রয়েছে। তাই কওমি মাদরাসাভিত্তিক দলগুলোর পক্ষে জামায়াতের সঙ্গে জোট করা কঠিন। কেন্দ্রীয় পর্যায়ে জোট হলেও তৃণমূলে পারস্পরিক ভোট বিনিময় আরও কঠিন।
এছাড়া এনসিপি এখনও দুর্বল। তারা বিএনপির সঙ্গে জোট করতে পারে বলে মনে হচ্ছে। আবার বিএনপি নির্বাচনের প্রশ্নে ছোট দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য চাইলেও আসন ছাড়বে কিনা তা স্পষ্ট নয়। ইসলামপন্থিদের ইদানীং মৌলবাদী বলতে শুরু করেছেন বিএনপি নেতারা। ইসলামী দলগুলো আর ব্যবহৃত হবে না। ইসলামপন্থিদের ভোট নিতে হলে মূল্য দিতে হবে বিএনপিকে।
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক আলোচনা চলছে। জুলাই সনদ, সংস্কার- এগুলো হয়ে গেলে জোটের বিষয়ে একটা সমাধান হয়ে যাবে। আশা করছি, আমাদের ঐক্য ফলপ্রসূ হবে। আমরা আশাবাদী, সুনির্দিষ্ট হলে আমরা একটা প্ল্যাটফর্মে আসতে পারবো। প্ল্যাটফর্মের নাম এখনো নির্ধারণ হয়নি। যে নামেই হোক, বা যে ফরম্যাটেই হোক একসঙ্গে হবে।
ভোরের আকাশ/এসএইচ