নিখিল মানখিন
প্রকাশ : ১০ মে ২০২৫ ০৭:৪১ পিএম
গরমে হাঁসফাঁস জনজীবন
দেশের ৪৫টি জেলায় বয়ে যাচ্ছে তাপপ্রবাহ। এর মধ্যে গতকাল শুক্রবার চুয়াডাঙ্গায় বয়ে গেছে তীব্র তাপপ্রবাহ। রাজধানীতে রেকর্ড হয়েছে ৩৯ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তপ্ত গরমে অতীষ্ঠ দেশবাসী। খরায় শুকিয়ে খাঁ খাঁ করছে মাঠ প্রান্তর। সূর্যের তীর্যক রশ্মির আঘাতে মাঠে বেশিক্ষণ একটানা কাজ করতে পারছেন না শ্রমিকরা। বাতাসে আর্দ্রতা বেশি থাকায় কিছুক্ষণ হাটলেই ঘেমে ভিজে যাচ্ছে শরীর। ঘরের ভেতরে ও বাইরে প্রায় একই অবস্থা। ঘন ঘন বিদু্যুৎ বিভ্রাটে বেড়ে যায় গরমে যন্ত্রণার তীব্রতা। এমন প্রাকৃতিক দুর্ভোগ প্রশমিত হওয়ার সুখবর নেই আবহাওয়া অফিসে। বৈশাখের শেষবেলায় এসে দেশজুড়ে বয়ে চলা তাপপ্রবাহের মধ্যেই নতুন করে আরো তিনদিনের সতর্কতা জারি করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এমন ভ্যাপসা গরম ও চড়া রোদে হিটস্ট্রোকের বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা।
আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, বাতাসে বেশি আর্দ্রতা, কম বৃষ্টিপাত এবং সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পার্থক্য হ্রাসের কারণেই বেড়েছে ভ্যাপসা গরম। শুক্রবার দুপুর ২টা থেকে পরবর্তী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে কোথাও কোথাও তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। যদি তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার বেশি পৌঁছায়, তবে তা স্বাস্থ্যঝুঁকি ও কৃষি উৎপাদনে প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. হাফিজুর রহমান ভোরের আকাশকে বলেন, এপ্রিল মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে তাপপ্রবাহ ছিল। কিন্তু তাপপ্রবাহ এত বিস্তৃত ছিল না। গত বুধবার থেকে দেশের বিস্তৃত এলাকায় তাপপ্রবাহ শুরু হয়। আজ (শুক্রবার) দেশের ৪৫ জেলায় তাপপ্রবাহ চলছে। এটি চলবে আগামীকাল ও পরশু পর্যন্ত। আগামী রোববার থেকে সারদেশের তাপমাত্রা কমে আসবে।
তিনি আরও বলেন, এখন দেশের অধিকাংশ এলাকায় ৩৬ ডিগ্রির উপরে তাপমাত্রা। আগামী দুইদিন পর ধীরে ধীরে কমে আসবে তাপমাত্রা। এরপর কিছু কিছু এলাকায় বৃষ্টি হয়ে তাপমাত্রা সহনীয় হয়ে আসবে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, দেশে সবচেয়ে বেশি গরম থাকে এপ্রিল মাসে। এর গড় তাপমাত্রা ৩৩ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর মে মাস হলো দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উষ্ণ মাস। এ সময় গড় তাপমাত্রা থাকে ৩২ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
গতকাল শুক্রবার দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে চুয়াডাঙ্গায়, ৪১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর আগে চলতি বছরে দুই দিন সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ২৮ মার্চ চুয়াডাঙ্গায় এবং ২৩ এপ্রিল যশোরে- ৩৯ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর রাজধানীর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৩৯ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এটাও এ বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বলে জানান আবহাওয়াবিদ বজলুর রশীদ।
এর আগে ২৮ মার্চ রাজধানীর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৩৮ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাপমাত্রা ৩৬ থেকে ৩৭ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত থাকলে তাকে মৃদু তাপপ্রবাহ বলা হয়। তাপমাত্রা ৩৮ থেকে ৩৯ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে তা মাঝারি তাপপ্রবাহ। তাপমাত্রা ৪০ থেকে ৪১ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে তীব্র তাপপ্রবাহ ধরা হয়। তাপমাত্রা ৪২-এর বেশি হলে তা অতি তীব্র তাপপ্রবাহ বলে গণ্য হয়।
তীব্র গরমে হাঁসফাঁস জনজীবন : গত শুক্রবার বেলা ১২টা। রাজধানীর কারওয়ানবাজার খুচরা মার্কেটের খোলা জায়গায় শাক-সবজির পসরা সাজিয়েছেন মো. কামাল। কিছুক্ষণ পরপর তিনি শাকের ওপর পানি ছিটাচ্ছেন। তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, তাবু টাঙানো নিষেধ। পানি না দিলে শাক তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যায়। চড়া রোদ সহ্য করেই বসে থাকতে হচ্ছে বলে জানান মো. কামাল। কিছু দূর এগিয়ে যেতেই চোখে পড়ে দা-বঁটির দোকান। তীব্র গরমের মাঝেই তাদের কেউ কেউ দা-বটি তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। আগুনের ফুলকির মাঝে ঘেমে ভিজে যাচ্ছে তাদের অনেকের শরীর।
খাঁ খাঁ রোদের মাঝে রেললাইনের ওপর অস্থায়ী মাছের পসরা জানিয়েছেন অনেক বিক্রেতা। তাদের বেশির ভাগই মাছগুলো কুড়িয়ে পেয়েছেন বলে জানা গেছে। তাদের অনেকের শরীর ঘেমে ভিজে গেছে। মলা, পুটিসহ বিভিন্ন প্রকারের গুঁড়া মাছগুলো যেন অতিরিক্ত রোদে নষ্ট হতে বসেছে। মগবাজার লিংরোডের (বাংলা মোটর-মগবাজার মোড়) ওয়াকফ ভবনের সামনে রিকশা পার্কিং করিয়ে চা দোকানের সামনে বসে আছেন সালাম মিয়া। পল্টন টাওয়ারের (পুরানা পল্টন) সামনে যাওয়ার অফার তিনি ফিরিয়ে দিলেন।
তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, কিছুক্ষণ আগে মেরুল বাড্ডা থেকে যাত্রী নিয়ে এসেছি। রোদ ও গরমে শরীরের অবস্থা শেষ। আধা ঘণ্টা বিশ্রাম নেওয়ার পর আবার শুরু করবো বলে জানান সালাম মিয়া।
একই স্থানে ব্যবসা জমে উঠেছে ঠান্ডা শরবতের ব্যবসা। দোকান মো. মাসুদ ভোরের আকাশকে বলেন, বিট লবন, লেবু ও বরফের পানি মিশিয়ে এক গ্লাস শরবতের দাম ১৫ টাকা। এই গরমে বিক্রি বেড়েছে। গত এক সপ্তাহ ধরে ভালো ব্যবসা চলছে বলে জানান মো. মাসুদ।
বেলা দেড়টার দিকে ভিক্টর বাস থেকে বিজয়নগর পানির ট্যাঙ্কির সামনে নামলেন এক যাত্রী। চা দোকানের সামনে কথা হয় তার সঙ্গে। তার নাম বেলাল হোসেন। তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, ছুটির দিনেও যাত্রীভর্তি ছিল বাসটি। দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে আধা ঘণ্টা। বাসে ছিল না ফ্যান। গরমে ভিজে গেছি বলে জানান বেলাল হোসেন।
ভ্যাপসা গরমের তীব্রতার আঘাত হানে গ্রামাঞ্চলেও। ভোরের আকাশের নিজস্ব প্রতিনিধি (চুয়াডাঙ্গা) জানান, ‘চুয়াডাঙ্গায় পারদ চড়েছে ৩৯.৭ ডিগ্রিতে। সাধারণত বেশিরভাগ দিনে বেলা ১২টায় মাঝারি তাপপ্রবাহ দেখা দেয় না। এই সময়ে তাপমাত্রা বেশি হলেও তা থাকে তাপপ্রবাহের নিচে কিংবা মৃদু তাপপ্রবাহের আওতায়। আজ এর ব্যতিক্রম হলো।
এদিন সকাল থেকেই তীব্র রোদ আর গরমের কারণে মানুষের স্বাভাবিক চলাফেরা ছিল কম। নিম্নআয়ের মানুষ রোদে ও গরমে কাজ করতে পারছেন না। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া মানুষ ঘরের বাইরে বের হচ্ছেন না। সকাল থেকে শহর ঘুরে দেখা গেছে, রিকশা ও ভ্যানচালকরা কাজ করতে হাঁপিয়ে ওঠছেন। অনেককে গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিতে দেখা গেছে। রোদ-গরমের মধ্যেই অনেক দিনমজুরকে জরুরি কাজ করতে দেখা গেছে। ঘামে তাদের পুরো শরীর ভিজে গেছে।
নিজস্ব প্রতিনিধি (ময়মনসিংহ) জানান, প্রচণ্ড রোদ ও ভ্যাপসা গরমের কারণে অতি প্রয়োজন না হলে নগরবাসী বাসা থেকে বের হচ্ছেন না। ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে বিশেষ করে সার্কিট হাউসের পাশের পার্কের গাছের ছায়ায় মানুষের ভিড়।
হিটস্ট্রোকের বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ চিকিৎসকদের : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ ভোরের আকাশকে বলেন, হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার আগেই সতর্ক থাকতে হবে। দীর্ঘক্ষণ রোদে থাকা যাবে না। প্রচুর পরিমাণ তরল জাতীয় বিশেষ করে ‘ওরস্যালাইন ’ খেতে হবে। ঢিলেঢালা জামা পরিধান করতে হবে। আর হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হলে তাকে ছায়ায় নিতে হবে। শরীর মুছে দিতে হবে। এতে আক্রান্তের অবস্থার উন্নতি না হলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
তিনি বলেন, হিটস্ট্রোকে আক্রান্তের আগে শরীরে তাপমাত্রা স্বাভাবিক অবস্থার বেশি থাকবে। শরীর দুর্বল হয়ে পড়বে। বমি বমি ভাব দেখা দেবে। মাথা ঘুরতে থাকবে। প্রস্রাব কমে যাওয়ার পাশাপাশি রক্তের চাপও কমে যাবে। এসব লক্ষণ দেখা দিলেই ছায়াচ্ছন্ন স্থানে বিশ্রাম নিতে হবে। হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার আগেই বিশেষ সতর্ক থাকার ওপর বেশি জোর দিয়েছেন তিনি।
ভোরের আকাশ/এসএইচ