সরকার-এনসিপি ঘনিষ্ঠ বিএনপি চরম ক্ষুব্ধ

নিখিল মানখিন : অন্তর্বর্তী সরকার-ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দল ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’র (এনসিপি) ঘনিষ্ঠতায় ক্ষুব্ধ বিএনপি। উপদেষ্টাসহ সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে যুক্ত আছেন একাধিক ছাত্র প্রতিনিধি। বিভিন্ন সময়ে বক্তব্য প্রদান ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সরকার ও এনসিপির একাত্মতা দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। এনসিপি জন্ম নেওয়ার অনেক আগেই ছাত্রদের রাজনৈতিক দল গঠন নিয়ে কথা বলতে গিয়ে সমালোচনায় পড়েন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস। এসব কিছুর প্রেক্ষিতে সরকারের সহায়তা নিয়ে নতুন দল গঠন করলে জনগণ মেনে নেবে না এমন সতর্কবার্তা দিয়ে রেখেছেন বিএনপির মহাসচিব  মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে ইতোমধ্যে প্রশ্ন তুলেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও। সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচন নিয়ে এনসিপির  উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলমের হুঁশিয়ারিতে আরও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে বিএনপি। 
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নানা প্রেক্ষাপটে সরকার ও এনসিপির মধ্যে গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান। অভ্যুত্থান, প্রধান উপদেষ্টা পদে ড. ইউনূসকে আনয়ন এবং উপদেষ্টা পরিষদে অনেক উপদেষ্টাকে নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নেতাদের (বর্তমান এনসিপি নেতা) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বৈষম্যবিরোধী নেতাদের ঘোষিত অনেক এজেন্ডা বাস্তবায়নে সরকারের আন্তরিকতার বিষয়টি প্রত্যক্ষ করছে দেশবাসী। অর্থাৎ সরকার ও এনসিপিতে মিশে আছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র নেতারা। এক কথায় সরকার ও এনসিপি অনেকটা মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। তাদের বাড়তি পাওনা হচ্ছে ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’। সরকার ও এনসিপির সুরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যাচ্ছে জামায়াত। আর এই অঘোষিত জোটের বিপরীতে অনেকটা একা হয়ে পড়ছে বিএনপি। 
হাসিনার ফাঁসির আগে নির্বাচন নয় এনসিপি : আওয়ামী লীগের বিচার না হওয়া পর্যন্ত আগামী নির্বাচন হবে না বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম। গত মঙ্গলবার তিনি বলেন, যতদিন না পর্যন্ত খুনি হাসিনার ফাঁসি দেখছি, ততদিন যেন কেউ ভুলক্রমেও নির্বাচনের কথা না বলে। খুনি হাসিনা লাশ কই ফেলেছে, তা জানা যায়নি। মায়েরা লাশ খুঁজতে ছুটে বেড়াচ্ছেন। খুনির বিচার না হওয়া পর্যন্ত কীভাবে এই বাংলাদেশে অন্যকিছু চিন্তা করব।
এর আগে গত ২৫ জানুয়ারি অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেছেন, যে সংস্কারগুলো না করলেই নয়, নির্বাচনের পূর্বে আমরা সেই সংস্কারগুলো করব। হাসিনা যে প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করে দিয়েছে, যে প্রতিষ্ঠানগুলো হাসিনাকে টিকিয়ে রেখেছে, সেগুলোকে একইভাবে রেখে আমরা নির্বাচন দিতে পারি না। নির্বাচন করার আগে অবশ্যই হাসিনার এ প্রতিষ্ঠানে ফ্যাসিবাদের যে দালালগুলো আছে তাদেরকে উৎখাত করে এবং খুনিদের বিচার করেই নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।
তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা থাকার সময় বিএনপি  নিয়ে কড়া বক্তব্য দিয়েছিলেন মো. নাহিদ ইসলাম। বিএনপি মহাসচিবের নিরপেক্ষ সরকারের দাবি মূলত আরেকটা ১/১১ সরকার গঠনের ইঙ্গিত বহন করে বলে মন্তব্য করেন তিনি। গত ২৫ জানুয়ারি তিনি বলেন, ‘১/১১ এর বন্দোবস্ত থেকেই আওয়ামী ফ্যাসিজমের উত্থান ঘটেছিলো। বিএনপি মহাসচিবের বক্তব্যে সামনে আরেকটা ১/১১ সরকার, সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও নতজানু পররাষ্ট্রনীতির ধারাবাহিকতা এবং গুম-খুন ও জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়ার আলামত রয়েছে।’
সদ্য পদত্যাগ করা অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামকে ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী বলে আলোচনায় আসেন প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব অপূর্ব জাহাঙ্গীর। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন নাহিদ ইসলাম। পদত্যাগপত্র জমা দেওয়ার পর ফেসবুকে নাহিদ ইসলামকে নিয়ে এমন পোস্ট দেন অপূর্ব জাহাঙ্গীর। পোস্টে তিনি লেখেন, ‘একদিন তিনি প্রধানমন্ত্রী হবেন। আপনি বাজি ধরতে পারেন।’
গত ৩০ জানুয়ারি একটি আন্তর্জাতিক মিডিয়াকে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের মুখে ছাত্রদের রাজনৈতিক দল গঠনের বিষয়টি জানতে পারে দেশবাসী। এর মধ্যে ছাত্রদের দল গঠনের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার অবগত থাকার বিষয়টি প্রকাশ পায়।
সুইজারল্যান্ডের দাভোসে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের বার্ষিক সম্মেলনের ফাঁকে বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে র‌্যাচম্যানের এক প্রশ্নের জবাবে ড. ইউনূস জানান, তিনি নির্বাচনের সম্ভাব্য যে দুটি সময়ের কথা বলেছেন, তা ভালো সময়। কারণ, তিনি জাতীয় ঐক্য ধরে রাখছেন। তিনি এটা থেকে বিচ্যুত হতে চান না। এর মধ্যে একটা সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে যে, ছাত্ররা নিজেরাই হয়তো একটি দল গঠন করবে। বাংলাদেশে ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের সম্ভাবনা আছে, যেটিকে কাজে লাগাতে তারা এর মধ্যেই দেশজুড়ে প্রচার চালাচ্ছে, মানুষজনকে সংগঠিত করছে। 
গত ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের পরের মাস ২৫ সেপ্টেম্বর মাহফুজ আলমকে ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়ে আলোচনায় আসেন ড. ইউনূস। এখানেও সরকার ও এনসিপির গভীর সেতুবন্ধন প্রকাশ পেয়েছে। ওই দিন জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনের ফাঁকে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের ‘ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ লিডারস স্টেজ’ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস আবেগে মাহফুজ আলমকে সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলন ও পরে সরকার পতনের ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন। ওই সময় মাহফুজ আলম সরকার ও ছাত্র সংগঠনের কোনো পদধারী ছিলেন না। পরবর্তীতে ছাত্রনেতাদের বক্তব্যে বেরিয়ে আসে তাদের সঙ্গে মাহফুজ আলমের সম্পৃক্ততা। 
সরকার ও এনসিপির সুরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যাচ্ছে জামায়াতে ইসলামী। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, দেশে যেনতেনভাবে নির্বাচন হতে দেওয়া যাবে না। নির্বাচনের মতো নির্বাচন চাই, সুষ্ঠু নির্বাচন চাই। তবে নির্বাচনের আগে ভোটার তালিকা সংশোধন করতে হবে। ভুয়া ভোটার বাদ দিতে হবে। আগে প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে, পরে অবাধ সুষ্ঠু একটি নির্বাচন হতে হবে।
সরকার ও বৈষম্যবিরোধী নিয়ে ক্ষুব্ধ বিএনপি : শেখ হাসিনার বিচারের সঙ্গে নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। গতকাল বুধবার তিনি বলেন, নির্বাচিত সরকারও হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের অপরাধীদের বিচার করার বিষয় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে। শুধু শেখ হাসিনা নয়, আওয়ামী লীগের বাকি অপরাধীদেরও বিচারের আওতায় আনতে হবে। বিচারিক বিষয় আইনি প্রক্রিয়া। এর সঙ্গে সরকার পরিবর্তনের কোনো সম্পর্ক নাই। স্বাধীন বিচার বিভাগ বিশ্বাস করলে, নির্বাচন নিয়ে অহেতুক বির্তক সৃষ্টি হওয়া কাম্য নয়।
নাগরিক পার্টির নেতাদের বক্তব্যের সমালোচনা করে বিএনপির এই নেতা বলেন, জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে নানা প্রস্তাব জুড়ে দেওয়া ফ্যাসিবাদী চরিত্রের মতো। সরকার দ্রুত নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করবে দেশের মানুষ এটাই প্রত্যাশা করে।
এক প্রশ্নের জবাবে আমীর খসরু বলেন, নিজস্ব প্রস্তাব বাস্তবায়ন করতেই হবে এমন মনোভাব শেখ হাসিনার স্বৈরাচারকে মনে করিয়ে দেয়।
গত ১ ফেব্রুয়ারি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সরকারে কিছু থাকবেন, আবার কিছু লোক সরকারের সহায়তায় দল গঠন করবেন এটা হতে পারে না। সরকারের লোকজন সংঘাতময় কোনো বক্তব্য দেবেন না। নিরপেক্ষ থেকে নির্বাচন দিতে হবে। নয়তো জনগণ মেনে নেবে না।
গত ২৭ ফেব্রুয়ারি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, দেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নিরপেক্ষতাই হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারের সবচেয়ে বড় পুঁজি। কিন্তু সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে ইতিমধ্যেই জনমনে সন্দেহ-সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। নিজেদের নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আরও সতর্কতা অবলম্বনের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
তারেক রহমান বলেন, বিভিন্ন সময়ে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য জনমনে ইতিবাচক ধারণা সৃষ্টি করলেও এ নিয়ে কোনো কোনো উপদেষ্টার বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য-মন্তব্য স্বাধীনতাপ্রিয়, গণতন্ত্রকামী জনগণের জন্য হতাশার কারণ হয়ে উঠছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি বিএনপিসহ গণতন্ত্রের পক্ষের সব রাজনৈতিক দলের নিঃশর্ত সমর্থন থাকলেও সরকার এখনো নিজেদের কর্মপরিকল্পনার অগ্রাধিকার নির্ধারণ করতে পারছে না। তিনি বলেন, সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থাকবেন। নির্বাচন অবশ্যই এ দেশে হবে। নির্বাচন হতে হবে, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে। আমরা চাইব অন্তর্বর্তী সরকার সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থেকে এই নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে।
এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক প্রফেসর ড. দিলারা চৌধুরী দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, গণতান্ত্রিক দেশে যে কেউ তার মতামত প্রদান করতে পারেন। এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দলের নেতারা বলেছেন শেখ হাসিনার বিচার না হওয়া পর্যন্ত ভোট হবে না। এটার তাদের মতামত। বিএনপি তাদের মতামত প্রদান করছে। তিনি বলেন, শেখ হাসিনাসহ অপরাধীদের বিচার হওয়া যেমন জরুনি তেমনি প্রকৃত গণতন্ত্রের স্বাদ পেতে নির্বাচিত একটি সরকারও জরুরি। অন্যথায় অস্থিরতা আরো বাড়বে। 
 

ভোরের আকাশ/মি