নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০৭ মার্চ ২০২৫ ১২:১১ এএম
তীব্র গ্যাস সংকটে চরম ভোগান্তি
শিপংকর শীল: বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ বাড়ানোর কারণে বাসাবাড়িতে গ্যাস সংকট বেড়েছে। অনেক জায়গায় চুলা জলে নিভু নিভু। কখনো কখনো রাত জেগে রান্না করতে হচ্ছে। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন মানুষ। অনেকে বাধ্য হয়ে ইলেকট্রিক চুলা ব্যবহার করছেন।
জানা গেছে, এ মাসের শুরুতে বাড়তে শুরু করেছে তাপমাত্রা। চলছে সেচ মৌসুম। ফলে মার্চে এসে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে। আবার এখন চলছে রমজান মাস। সব মিলিয়ে গ্যাসের চাহিদাও তুলনামূলক বেশি। কিন্তু বাসাবাড়িতে সরবরাহ কম।
জানা গেছে, প্রথম রমজানে সারা দেশে ২ হাজার ৮৫৬ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়। কিন্তু চাহিদা ৪ হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি। সংকটের মধ্যে তাপমাত্রা বাড়ার কারণে গতকাল গ্রিডের বিদ্যুৎকেন্দ্রে ৯১৬ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে। তাপমাত্রা কম থাকায় গত মাসের শেষের দিকে গ্রিডের বিদ্যুৎকেন্দ্রে ৮৩০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হতো। ২৫ ফেব্রুয়ারির গ্যাস সরবরাহের চিত্রে দেখা গেছে, ওই দিন বিদ্যুৎকেন্দ্রে ৮৩০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে। তাপমাত্রা বাড়ার কারণে বর্তমানে বিদ্যুৎকেন্দ্রে দৈনিক ৮৬ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস বেশি সরবরাহ করা হচ্ছে। এতে সংকটে পড়েছে আবাসিকসহ অন্যান্য খাত।
রাজধানীর আসাদগেটের বাসিন্দা ইয়াসমিন আক্তার জানান, সারা বছর গ্যাসের কষ্ট করতে হয়, এই রমজানেও একই অবস্থা। সন্ধ্যা ৬টায় গ্যাস এলে মানুষ ইফতারের আয়োজন কখন করবে?’
একই অভিযোগ করেন পুরান ঢাকার বাসিন্দা ফয়সাল হোসেনের। তিনি বলেন, প্রথম রোজায় কিনেই ইফতার খেতে হলো। গ্যাস এসেছে রাত ১১টা নাগাদ। এভাবে প্রতিদিন কি ইফতার কিনে খাওয়া সম্ভব?
এই অভিযোগ শুধু রাজধানীর ওই দুই এলাকার মানুষের নয়। অনেক এলাকায় দুপুর গড়ানোর আগেই গ্যাস কমে, বিকাল নাগাদ গ্যাস থাকেই না। এর মধ্যে রয়েছে পুরান ঢাকায় অনেক এলাকা, রামপুরা, উলন, হাজারীবাগ, খিলগাঁওয়ের কিছু অংশ, মিরপুর ও উত্তরার কিছু অংশ, মোহাম্মদপুর, মানিকনগর, বাসাবোসহ আশপাশের বেশিরভাগ এলাকা।
রাজধানীর কাঁঠালবাগানের বেশিরভাগ বাসিন্দাই তাই রান্না করেন ঘরে তৈরি চুলার সাহায্যে। তারা জানান, বেশিরভাগ সময় ভুগতে হলেও, রোজা এলে ভোগান্তি বাড়ে কয়েকগুণ। গ্যাস কখন আসবে তা নিয়ে থাকতে হয় অনিশ্চয়তায়।
শুধু কাঁঠালবাগানই নয়, তীব্র গ্যাস সংকটে বিপাকে পড়েছেন রাজধানীর কলাবাগান, হাতিরপুল, সেন্ট্রাল রোড এলাকার বাসিন্দারা। বাধ্য হয়েই রান্না করতে হচ্ছে ইলেকট্রিক, সিলিন্ডার কিংবা লাকড়ির চুলায়। এতে একদিকে জ্বালানির খরচ যেমন বেড়েছে, তেমনি গ্যাস না পেলেও গুনতে হচ্ছে বিল।
গ্রাহকরা বলছেন, কোনো কোনোদিন রাত ১২টা থেকে ভোর ৪টা পর্যন্ত গ্যাস পাওয়া গেলেও দিনের পুরোটা সময়ে দেখা মেলে না গ্যাসের। গ্যাস না থাকলেও মাস শেষে বিল ঠিকই দিতে হচ্ছে।
এদিকে, রমজানের শুরুতেই রাজধানীর সিএনজি স্টেশনগুলোতেও দেখা দিয়েছে গ্যাস সংকট। গাড়িগুলোর দীর্ঘ সারি জমছে স্টেশনগুলোতে। গ্যাসের চাপ কম থাকায় ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন যানবাহন চালক ও মালিকরা।
রাজধানীর কল্যানপুরের বাসিন্দা মারজানা হোসেন গ্যাস না থাকায় পড়েছেন বিড়ম্বনায়। তিনি বলেন, অফিস থেকে বাসায় ফিরেই দেখি গ্যাস নেই। জানতে পারি সকাল থেকেই গ্যাস ছিল না। কোনো উপায় না পেয়ে বাইরে থেকে ইফতার কিনে আনতে হয়েছে।
বাড্ডায় বাসিন্দা আসলাম তালুকদার একই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন। তিনি বলেন, গতকাল সন্ধ্যা থেকেই গ্যাস ছিল না। সেহরির আগে কিছু সময়ের জন্য গ্যাস আসে। গ্যাসের চাপ কম থাকলেও রান্নার কাজ শেষ করতে পেরেছিলাম। কিন্তু সকাল থেকেই গ্যাস নেই। আমদের ইফতার সাহরির আয়োজন সব উলট-পালট হয়ে গেছে।
শুধু তারাই নয় গ্যাস না থাকায় বাইরে থেকে খাবার কিনে এনে ইফতার ও সেহরি করেছেন রাজধানীর বেশ কয়েকটি এলাকার অধিকাংশ মানুষ।
রাজধানীর বাড্ডা, সাতারকুল, বেরাইদ, খিলবাড়িরটেক, নতুনবাজার, ফাঁসেরটেক, বসুন্ধরা, কালাচাঁদপুর, নর্দ্দা, কুড়িল, ভাটারা, ছোলমাইদ, বনশ্রী, রামপুরাসহ ঢাকার বেশ কয়েকটি এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, রোববার সকাল থেকেই গ্যাস সংকটে পড়েছেন তারা। এছাড়া মিরপুর ১১ নম্বরের মদিনা নগর, আদর্শ নগর, সবুজ বাংলা, লালমাটিয়া, বাউনিয়াবাঁধ, ৫৪ প্লট, মিরপুর ১২ নম্বর ডি ব্লক, ই ব্লক, মিরপুর ১০ নম্বর সি ব্লক, প্যারিস রোড, এভিনিউ ফাইভ, দারুস সালাম, কোট বাড়ি, বর্ধন বাড়ি, বাগ বাড়ি, হরিরাম পুর, ভাষানটেক, ৬০ ফিট, মিরপুর ১৩ নম্বরের বি ব্লক, সি ব্লক, বাইশটেকি, কাফরুল, ইব্রাহিম পুর, মিরপুর ১ নম্বর, কল্যাণপুর, দক্ষিণ পাইক পাড়া, মিরপুর ৭ নম্বর আরামবাগ, রূপনগর এলাকায় তীব্র গ্যাস সংকট চলছে। গ্যাস না থাকায় অনেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেদের ক্ষোভের কথা জানিয়ে স্ট্যাটাসও দিয়েছেন। গ্যাস সংকটে বাড়িতে হাঁড়ি না চড়ায় বাধ্য হয়ে ক্যাফে ও রেস্টুরেন্টগুলোতে খাবার কিনতে ভিড় জমাচ্ছেন মানুষ। সেখানে দেখা গেছে উপচেপড়া ভিড়।
বংশাল ক্যাফে ও রেস্তোরার মালিক ফাহাদুল ইসলাম ফরহাদ বলেন, ইফতার বিক্রিতে, দোকানে উপচেপড়া ভিড় ছিলো। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে ইফতার কিনছে গ্রাহকেরা। বিকাল সাড়ে ৫টার মধ্যে ইফতার বিক্রি শেষ হয়ে গিয়েছিল, সাধারণত এরকম হয় না।
এদিকে, গ্যাস না থাকার বিষয়ে কোনো অগ্রিম নোটিশ দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন অনেকে।
কালাচাঁদপুরের বাসিন্দা মো. আকতার জানান, গ্যাস না থাকার বিষয়ে কোনো অগ্রিম নোটিশ দেওয়া হয়নি। রমজানের প্রথম দিনেই গ্যাস বন্ধ করে লাইনের কাজ করায় ব্যাপক সমালোচনা করেন তিনি।
খিলবাড়িরটেক এলাকার বাসিন্দা ও একটি মাদরাসার অধ্যক্ষ মাওলানা রহমতুল্লাহ বলেন, গ্যাস সংকটের কারণে আমাদের এলাকার অনেক বাসায় মাটির (লাকড়ি) চুলায় রান্না করছে। অন্য সময় গ্যাস না থাকলে আগে থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়। এবার সেটা করা হয়নি। খোঁজ নিয়ে জেনেছি, আমাদের এলাকার কেউই গ্যাস না থাকার বিষয়টি জানতেন না। রমজানের শুরুতেই গ্যাস বন্ধ করে লাইনের কাজ করা হচ্ছে। এটি একেবারেই গ্রহণযোগ্য না।
ছোলমাইদের বাসিন্দা আমেনা বেগম বলেন, আমি সকালে উঠে দেখি গ্যাস নেই। খোঁজ নিয়ে জানলাম, গ্যাস কখন আসবে কেউই বলতে পারছেন না। রান্না করতে না পেরে ইফতার কিনে খেয়েছি। বড় বোনের বাসা গুলশান থেকে সেহরি রান্না করে এনেছি।
গত রোববার দুপুরে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, শেভরন পরিচালিত বিবিয়ানা গ্যাস ফিল্ডে জরুরি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিভিন্ন এলাকায় গ্যাসের স্বল্প চাপের সৃষ্টি হতে পারে। খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলেও উল্লেখ করা হয় বিজ্ঞপ্তিতে।
ভোগান্তির বিষয়ে জানতে চাইলে তিতাসের মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন) প্রকৌশলী কাজী মোহাম্মদ সাইদুল হাসান বলেন, আমাদের যে চাহিদা সে অনুযায়ী গ্যাস পাচ্ছি না। এ মাসের জন্য গড়ে আমরা ১ হাজার ৯৬০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা দিয়েছিলাম। এর মধ্যে গত মঙ্গলবার পেয়েছি ১ হাজার ৫৫৯ মিলিয়নের মতো। গতকাল বুধবার দুপুর নাগাদ কিছুটা বেড়ে ১ হাজার ৫৭০ মিলিয়নের মতো হয়। ঘাটতি থেকে যাচ্ছে ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো।
তিনি বলেন, এলএনজি সরবরাহ বৃদ্ধির কারণে আমরা কিছুটা গ্যাস বেশি পাচ্ছি। তবে রোজায় গ্যাসের চাহিদা যেমন বাড়ে, বিদ্যুতের চাহিদাও বাড়ে। সাহরি, ইফতার, তারাবির সময় লোডশেডিং যাতে না হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হয়। এই অবস্থায় বিদ্যুতে গ্যাসের সরবরাহকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। যদিও আমরা চেষ্টা করছি বাসাবাড়িতেও যাতে সরবরাহ কিছুটা বাড়ানো যায়।
ভোরের আকাশ/মি