নিখিল মানখিন
প্রকাশ : ৩১ মে ২০২৫ ০৮:২৭ এএম
প্রতীকী ছবি
দেশে অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে সিজারে সন্তান জন্মদান। অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের জন্য এক শ্রেণীর চিকিৎসক অপ্রয়োজনে সন্তান সম্ভবা মায়েদের সিজারিয়ান পদ্ধতিতে ডেলিভারি করাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, কর্তব্যরত চিকিৎসক ও নার্সদের তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তের ওপরই নির্ভর করতে হয় গর্ভবতী মা ও স্বজনদের। থানাপর্যায়ে অনেক ক্ষেত্রে সিজার করার আগে পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করা হয় না।অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ানের খপ্পড়ে পড়ে অনেক গর্ভবতী মা অকাল মৃত্যুর শিকার হচ্ছেন। আর বেঁচে থাকা অনেক মা পড়ছেন মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিজারিয়ান সেকশন এখন দেশের বেশির ভাগ প্রাইভেট হাসপাতাল-ক্লিনিকের বড় ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। এ প্রবণতা রোধ তো করা যাচ্ছেই না, বরং দিন দিন প্রাইভেট হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলো আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে। কোনো প্রসূতি পেলেই প্রাইভেট হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোর এক শ্রেণীর চিকিৎসক থেকে শুরু করে সবাই বিভিন্ন অজুহাতে রোগীকে নরমাল ডেলিভারির বিষয়ে কৌশলে মানসিকভাবে ভীতসন্ত্রস্ত করে তোলে।
এমনকি সিজার না হলে মা কিংবা নবজাতকের ক্ষতি হওয়ার ভয়ও দেখানো হয় অনেক ক্ষেত্রে। নিরূপায় হয়ে প্রসূতি ও তার স্বজনরা নিরাপদ মাতৃত্ব ও সুস্থ সন্তানের স্বার্থে হাসপাতালের প্রত্যাশায় সায় দেয়। আর সিজারিয়ানের মাধ্যমে প্রসব পদ্ধতিতে রাজি হলেই শুরু হয় টাকা হাতানোর হিসাব কষাকষি।
অভিযোগ উঠেছে, নরমাল ডেলিভারির চেয়ে সিজারিয়ানে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক বেশি টাকা পায়। হাসপাতাল বা ক্লিনিক কর্তৃপক্ষেরও এতে ব্যবসা বেশি। কারণ বেশি সময় হাসপাতালে থাকতে হয়, ওষুধ বেশি লাগে, অপারেশন থেকে শুরু করে অন্যান্য খরচও বেশি আদায় করা হয়। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে অপারেশনের পর প্রসূতির অনেক সময় বিভিন্ন ধরনের জীবাণু আক্রমণ দেখা দেয়।
এতে হাসপাতালের ব্যবসা বেড়ে যায়। আর নরমাল ডেলিভারি হলে রোগী এক-দুইদিনের মধ্যে বাসায় চলে যেতে পারে। কিন্তু সিজারিয়ান হলে আগে-পরে মিলিয়ে রোগীকে প্রায় এক সপ্তাহ থাকতে হয়। এতে হাসপাতালের কেবিন বা বেড ভাড়া ও বিভিন্ন সার্ভিস চার্জের নামে বেশি টাকা আদায় করা সম্ভব। প্রাইভেট হাসপাতাল-ক্লিনিকের দেখাদেখি এখন সরকারি ও বিভিন্ন এনজিও’র হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোয়ও সিজারিয়ানের প্রবণতা বাড়ছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।
সিজারিয়ান নিয়ে বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে (বিডিএইচএস) এর সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা হাসপাতাল কেন্দ্রিক প্রসব বাড়ার কারণে সি-সেকশন বা সিজারিয়ানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৭ সালের তুলনায় ২০২২ সালে সিজারের ঘটনা বেড়ে ৩৪ শতাংশ থেকে ৪৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। সিজারের বেশির ভাগই হয়ে থাকে বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে। ২০২২ সালে এসে দেশের মোট সিজারে জন্মদানের ৮৪ শতাংশই হয়েছে বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে। এছাড়া ১৪ শতাংশ হয়েছে সরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলোতে। বাকি ২ শতাংশ হয়েছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় (এনজিও)।
প্রতিবেদনে আরও জানানো হয়, ২০২২ সালে ঘরে শিশু জন্মদান হয়েছে ১২ লাখ ৬২ হাজার ৩২৪ জন, সরকারিতে ৬ লাখ ৪৭ হাজার ৪৩৮ জন, বেসরকারি হাসপাতালে ১৬ লাখ ৩১ হাজার ২৫৫ জন ও এনজিওতে ৬১ হাজার ৪৮৯ জন। আর এদের মধ্যে সরকারি হাসপাতালে সিজার হয়েছে ২ লাখ ৩৩ হাজার ৭৮ জনের। বেসরকারিতে ১৩ লাখ ৫৩ হাজার ৯৪২ জনের সিজার হয়েছে। এছাড়া এনজিওতে সিজার হয়েছে ২২ হাজার ১৩৬ জনের।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি ও প্রসূতি বিভাগের চিকিৎসক ডা. আছমা খাতুন অরোরা ভোরের আকাশকে বলেন, গর্ভবতী মায়ের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর প্রয়োজনে সিজারিয়ানের দরকার হতেই পারে। কিন্তু অপ্রয়োজনে সিজারে সন্তান জন্মদান অবশ্যই কাম্য নয়।
তিনি বলেন, বাস্তবে ১৫ থেকে ২০ ভাগের বেশি সিজারিয়ান পদ্ধতির দরকার নেই। কিন্তু এখন ঢাকার বাইরেও সিজারের প্রবণতা বাড়ছে। এর কারণ হিসেবে তিনি বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর ব্যবসায়িক মনোবৃত্তিকে দায়ী করে।
তিনি আরও বলেন, এটা করলে হাসপাতালগুলোর আয় বেশি হয়। এটাই আয়ের প্রধান খাতে পরিণত হচ্ছে। গর্ভবতী মা ও পরিবারের মধ্যে এক ধরনের মনোভাব তৈরি হয়েছে যে সিজারিয়ান পদ্ধতি নিরাপদ। কিন্তু অপ্রয়োজনে সিজার মায়ের মৃত্যুঝুঁকি এবং নানা ধরনের শারীরিক জটিলতার আশঙ্কা অনেক বাড়িয়ে দেয়।
ডা. আছমা খাতুন আরও বলেন, এটি শুধু একটি অপারেশন নয়। রোগীকে অজ্ঞান করতে হয়। ফলে তার ঝুঁকি বেড়ে যায়। একবার সিজার করলে পরবর্তীতেও সিজার করতে হয়। অনেক সময় জরায়ু কেটে ফেলে দিতে হয়। প্রসবের থলিও ফেটে যায়। অনেক সময় এত রক্তপাত হয় যে মাকে আর রক্ষা করা যায় না। সিজার কমাতে হলে সবাইকে সচেতন করতে হবে। আর এই সচেতনতা রোগী ও চিকৎসক সবার মাঝেই তৈরি হতে হবে বলে জানান ডা. আছমা খাতুন।
সিজারিয়ান ব্যবসা
হাসপাতালে প্রসবের হার বাড়ায় মাতৃ ও শিশুমৃত্যু কিছুটা কমলেও ব্যাপকভাবে বেড়েছে সিজারিয়ান। খরচও গেছে নাগালের বাইরে। ১৫ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকায় সম্পন্ন হওয়া সিজারিয়ানের খরচ কোথাও কোথাও ২ লাখও ছুঁয়েছে। অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ান মায়ের শারীরিক ও আর্থিক ক্ষতি বাড়ালেও এর দায় নিচ্ছেন না কেউ। ১১ বছরে সিজারিয়ানের হার দ্বিগুণ হয়ে ৪৫ শতাংশে ঠেকেছে, যার ৮৪ শতাংশই বেসরকারিতে। বিশেষজ্ঞদের শঙ্কা, শিগগিরই ৯০ শতাংশ ছাড়াবে।
রাজধানী ঢাকায় রয়েছে স্বাভাবিক প্রসব ও সিজারিয়ানের সর্বোচ্চ সুযোগ। মূলত সারাদেশের জটিল রোগীরা রেফার হয়ে আসেন ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে। তবে রোগীদের স্রোতের কারণে সেবার পাশাপাশি বাণিজ্যের বলিও হন মায়েরা। রাজধানীর হাতেগোনা কয়েকটি হাসপাতালে রোগীরা সন্তুষ্টচিত্তে প্রসব করাতে পারেন। এর একটি রাজধানীর মোহাম্মদ ফার্টিলিটি সেন্টার।
সরকারি এ হাসপাতালে ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকার মধ্যেই স্বাভাবিক প্রসব এবং ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার টাকার মধ্যেই সিজারিয়ান করে বাড়ি ফেরা সম্ভব। আশার খবর হলো প্রতিটি অন্তঃসত্ত্বাকেই স্বাভাবিক প্রসবের জন্য চেষ্টা করা হয়। শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করে না পারলে সিজারিয়ানের জন্য অপারেশন থিয়েটারে পাঠানো হয়। এ কারণে রোগীদের বেশির ভাগই সেবা ও খরচ নিয়ে সন্তুষ্ট।
মোহাম্মদপুর ফার্টিলিটি সেন্টারে সিনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. সুচিত্রা সাহা বলেন, একাডেমিক সেশনে কেউ নরমাল ডেলিভারি চাইল, কিন্তু সিজার হলো। কেন সিজার হলো সেখানে আমাদের কি ভুল ছিল তা নিয়ে আলোচনা করা হয়। একইভাবে আশুলিয়া নারী ও শিশু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ১৫ বছরের চেষ্টায় সিজারিয়ানের হার ৭০ শতাংশ থেকে ৩৭ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। লেবার অবজারভেশন, ইনডাকশান ও ডেলিভারির পৃথক রুমে সর্বোচ্চ মানের সেবার পরও স্বাভাবিক প্রসবে ১০ থেকে ১২ হাজার ও সিজারিয়ানে নেওয়া হচ্ছে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা।
প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদের সংগঠন অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের(ওজিএসবি) সাবেক প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. সায়েবা আক্তার বলেন, প্রত্যেকটা অপারেশনে জটিলতা রয়েছে। সিজারের কারণে অনেক রক্তক্ষরণ হতে পারে যার ফলে রোগী মারা যেতে পারে। আমাদের আরো অনেক সোচ্চার হওয়া উচিত যেন সিজারের হার কমিয়ে আনা যায়।
তিনি বলেন, দুর্গম অঞ্চলে সিজারের ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে কেন সিজার হচ্ছে না। কিন্তু দেশে বেসরকারি সেক্টরে সিজারিয়ানের মাত্রা সর্বোচ্চ তা গাইনি পেশাজীবীদের সংগঠন ওজিএসবি উত্তর দিতে পারবে কেন এত বেশি। ঢাকায় হাসপাতালভেদে সিজারিয়ানের খরচ ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। যদিও অধিকাংশ মানুষের পছন্দ কেবিনে থেকে ৯০ থেকে ১ লাখের মধ্যে সিজারিয়ানের পর্ব শেষ করা।
সিজারিয়ানের মূল খরচের একটি কনসালট্যান্ট ফি, অন্যটি কেবিন ভাড়া। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি, কনসালট্যান্টরা তাদের চার্জ বেশি রাখায় কমছে না সিজারিয়ানের খরচ, উল্টো বক্তব্য সার্জনদের। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, কনসালট্যান্টরা সর্বনিম্ন ৩০ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৬০ হাজার টাকা নিয়ে থাকেন। সার্জনরা যদি টাকা কমিয়ে নেন, তাহলে চার্জ অবশ্যই কম আসবে।
ঢাকায় সার্জনের টিম চার্জ ১৫ হাজার থেকে ৮৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। আর কেবিন ভাড়া ২ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। বিশেষজ্ঞদের দাবি, ঢাকা শহরে একটি মানসম্পন্ন সিজারিয়ানের জন্য সর্বোচ্চ ৬০ হাজার টাকার বেশি খরচ হওয়া উচিত নয়।
অধ্যাপক ডা. রওশন আরা বেগম বলেন, আমরা মনে হয় একেবারে উচ্চবিত্ত সার্জন এইটা করে সেখানেও ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকার বেশি হওয়া উচিত না। যোগ্যতা অনুযায়ী কোন কনসালট্যান্টের ফি কত হবে বা কোন হাসপাতালের ফি কেমন হবে, সেটি নির্ধারণ করেন স্বয়ং কনসালট্যান্ট বা সেই হাসপাতাল। এমনকি কোন হাসপাতাল কোন গ্রেডের সেটিও নির্ধারণ করা হয়নি আজও। জনগণ শুধু তার সাধ্যানুযায়ী হাসপাতালে যেয়ে সেবা গ্রহণ করছে। সেখানে তার সন্তুষ্টি বা অসন্তুষ্টিতে চিকিৎসক, হাসপাতাল; এমনকি স্বাস্থ্য বিভাগেরও কোনো যায়-আসে না।
ভোরের আকাশ/এসএইচ