ভোরের আকাশ প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২৬ জুন ২০২৫ ০৩:২৫ এএম
অর্থনীতির গতি কমার আশঙ্কা
নানামুখী চ্যালেঞ্জের কারণে আগামী অর্থবছরে দেশের অর্থনীতির গতি কমে আসার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক সংস্থাসহ বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ঘিরে আগামী বছরটি আরও কঠিন হতে যাচ্ছে। প্রবৃদ্ধির গতি হ্রাস, রাজস্ব ঘাটতি, ব্যাংক খাতের সংকট এবং বিনিয়োগে স্থবিরতা নিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনো এলোমেলো অবস্থায় রয়েছে। সামনের কঠিন চ্যালেঞ্জগুলো উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ পূর্বাভাসে। চলতি অর্থবছরের শেষ দিকে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশের নিচে নামতে পারে এবং আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে সংকট আরও তীব্র হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে দুই আন্তর্জাতিক সংস্থাই।
বিশ্বব্যাংকের মতে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শেষ নাগাদ দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৫ শতাংশের নিচে নামতে পারে। আইএমএফও চলতি বছরের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমিয়ে ৩ দশমিক ৮ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। এই পূর্বভাস বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাম্প্রতিক ৩ দশমিক ৯৭ শতাংশের হিসাব থেকেও কম।
এদিকে গত ২৩ জুন ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত আইএমএফের নির্বাহী বোর্ড সভায় বাংলাদেশকে ১ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলার ঋণের কিস্তি ছাড়ের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি অতিরিক্ত ৮০০ মিলিয়ন ডলার অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সংস্থাটি। তবে এ অর্থায়নের প্রতিশ্রুতির সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে আগামীর অর্থনীতি নিয়ে কঠোর সতর্ক বার্তা।
আইএমএফ বলছে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ, যা বাংলাদেশের বাজেট লক্ষ্যমাত্রা ৬ দশমিক ৫ শতাংশের তুলনায় অনেক কম। সংস্থাটি উল্লেখ করেছে, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, কঠোর মুদ্রানীতি ও ব্যাংক খাতের কাঠামোগত দুর্বলতা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আইএমএফের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক নাইজেল ক্লার্ক বলেছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি বহুস্তরীয় চাপে রয়েছে। কাঠামোগত সংস্কার, রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি এবং আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে কার্যকর নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি।
আর্থিক খাতের দুরবস্থার পাশাপাশি রাজস্ব ঘাটতিও বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৬৬ হাজার ৬৭৮ কোটি টাকা পিছিয়ে রয়েছে। মে মাস পর্যন্ত আদায় হয়েছে ৩ লাখ ২৭ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৮৩ দশমিক ১০ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রা পূরণে জুন মাসেই আদায় করতে হবে আরও ১ লাখ ৩৫ হাজার ৭১৭ কোটি টাকা যা ‘প্রায় অসম্ভব’ বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ব্যাংক খাতের নাজুক অবস্থা। বর্তমানে দেশের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের ২৪ দশমিক ১৩ শতাংশ। বছরের শেষ নাগাদ এটি ৬ লাখ কোটি টাকায় পৌঁছাতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তারল্য সংকটে পড়েছে ব্যাংকগুলো, ফলে নতুন বিনিয়োগে ঋণ দেওয়া প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির কারণে উৎপাদন, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তারা।
এদিকে সরকারের ব্যাংক ঋণ নির্ভরতা ও উচ্চ সুদের কারণে বেসরকারি খাতে অর্থপ্রবাহ সংকুচিত হয়ে পড়ছে। সরকার ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ব্যাংক খাত থেকে ১ দশমিক ৪ লাখ কোটি টাকা ঋণ নিতে চায়। এতে তারল্য সংকট আরও তীব্র হওয়ার পাশাপাশি বেসরকারি খাতের জন্য ঋণের সুযোগ সংকুচিত হবে। বাড়বে সুদের হারও, যা অর্থনীতির জন্য দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি তৈরি করবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদগণ।
এছাড়া মূল্যস্ফীতির চাপ ও বৈদেশিক সংকটও দূর হয়নি। চলতি অর্থবছরে বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতি থাকবে ৯ দশমিক ৯ শতাংশ, যা ভোক্তা পর্যায়ে চাপ অব্যাহত রাখবে।
আগামী অর্থবছরে তা কমে ৬ দশমিক ২ শতাংশে নামার পূর্বাভাস দিলেও বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্ববাজারে নানামুখী অস্থিরতা মূল্যস্ফীতির ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করতে পারে।
অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, দেশের মূল্যস্ফীতি কমিয়ে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সরকারি লক্ষ্য সাড়ে ৬ শতাংশ হলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরও নিচের মাত্রায় নামিয়ে আনতে চায়।
গত ২৪ জুন রাজধানীর একটি হোটেলে ‘গুগল পে’ সেবার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
গভর্নর বলেন, সরকার মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামাতে চায়। তবে আমরা আরও আগ্রাসী লক্ষ্য নির্ধারণ করেছি— ৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে পারলে সেটাই হবে আমাদের সফলতা। সব মিলিয়ে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ সংকুচিত হয়ে পড়ায় প্রভাব পড়ভে কর্মসংস্থানে। বর্তমানে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সাময়িকভাবে স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা চলছে, তবে এতে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ফলে কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও ডলার সংকট শিল্প-কারখানার উৎপাদন ব্যাহত করছে। এতে ঋণখেলাপির আশঙ্কা বাড়ছে।
তিনি ভোরের আকাশ’কে বলেন, রাজনৈতিক সরকার না আসা পর্যন্ত বিনিয়োগ আসবে না।
আর ব্যাংকের সব টাকা যদি সরকারই নিয়ে যায় তাহলে বেসরকারি উদ্যোক্তারা নতুন বিনিয়োগ করবে কোথা থেকে- এমন প্রশ্ন রেখে এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, দেশীয় বিনিয়োগ না বাড়া পর্যন্ত বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ার কোন সুযোগ নেই।
ভোরের আকাশ//হ.র