তাকী মোহাম্মদ জোবায়ের
প্রকাশ : ১৬ জুন ২০২৫ ০৮:৪৮ এএম
প্রতীকী ছবি
অনুমিতভাবেই বড় হচ্ছে দেশের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ। বেড়িয়ে আসছে দেশের আর্থিক খাতের প্রকৃত চিত্র। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। এটি বিতরণ করা মোট ঋণের ২৪ শতাংশের বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আর্থিক খাতে বেপরোয়া লুটপাটের ক্ষতচিহ্ন হচ্ছে এই বিপুল খেলাপি ঋণ। বিগত দিনে নানা কৌশলে এগুলো লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে এগুলো প্রকাশ পাচ্ছে। আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ মোট বিতরণকৃত ঋণের এক তৃতীয়াংশে পৌঁছাতে পারে বলে আশঙ্কা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের।
তথ্য বলছে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের সময় খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। বিগত সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে প্রায় ১৯ গুণ বেড়েছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। গতকাল রোববার মার্চভিত্তিক খেলাপি ঋণের তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। স্বাভাবিকভাবে এই তথ্য মে মাসে প্রকাশ করার রেওয়াজ থাকলেও বেশ কয়েকটি ব্যাংকের খেলাপির হিসাব পেতে দেরি হওয়ায় প্রতিবেদন প্রকাশে দেরি হয়েছে বলে জানা গেছে।
এর আগে ডিসেম্বরভিত্তিক যে তথ্য প্রকাশিত হয়েছিল তাতে মোট খেলাপির পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। এই হিসেবে তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৪ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা, শতাংশীয় হিসেবে যা ২২ শতাংশের কাছাকাছি। এ নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে মোট নতুন খেলাপি হলো প্রায় ২ লাখ ৯ হাজার কোটি টাকা।
এদিকে বিগত সরকারের সময় নেওয়া অনেক বড় বড় ঋণই দিন দিন খেলাপি হয়ে পড়ছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়বে বলে ধারণা বাংলাদেশ ব্যাংকের। তখনই মূলত আর্থিক খাতের প্রকৃত চিত্র প্রকাশ পাবে। এরপর থেকেই ধীরে ধীরে খেলাপি ঋণ কমে আসবে বলে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ঋণের নামে ব্যাংক লুট হয়েছে ও লুটের টাকা পাচার হয়েছে। এগুলো এখন খেলাপি হয়ে পড়ছে। এসব ঋণের অনেকগুলোরই জামানত না থাকায় কিংবা অপর্যাপ্ত জামানত থাকায় এগুলো সরাসরি কু-ঋণে পরিণত হচ্ছে। এতেই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাড়তে থাকবে। কারণ, বিগত সরকারের একবারে শেষ সময়েও যে ঋণ নেওয়া হয়েছে সেগুলোর খেলাপি হওয়ার মেয়াদ সেপ্টেম্বরের মধ্যেই পূর্ণ হয়ে যাবে। ওই সময় আর্থিক খাতের আসল চিত্র পাওয়া যাবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মার্চ শেষে মোট বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৪১ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা মোট ঋণের ২৪ দশমিক ১৩ শতাংশ।
এদিকে ২০২৪ সালের মার্চ শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা, যা তৎকালীন বিতরণকৃত ঋণের ১১ দশমিক ১১ শতাংশ। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ লাখ ৩৮ হাজার ৪০ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে।
সাবেক সরকারের আমলে ব্যাংক থেকে প্রভাবশালীদের বড় অঙ্কের ঋণ দিতে নানা সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। পাশাপাশি খেলাপি ঋণ কাগজে-কলমে কম দেখাতে নেওয়া হয়েছিল একের পর এক নীতি। সরকার পরিবর্তনের পর সেই নীতি থেকে সরে এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যে কারণে খেলাপি ঋণ বাড়ছে বলে জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা। বাংলাদেশ ব্যাংক পূর্বের নীতি থেকে সরে আসায় ইসলামী ব্যাংকে খেলাপি ঋণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে।
একইভাবে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণও বেশ বেড়েছে। পাশাপাশি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ, এস আলমসহ আরও কিছু বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ঋণখেলাপি হয়ে পড়েছে। এতেও বেড়েছে খেলাপি ঋণ।
পাঁচ ব্যাংকের খেলাপি বেড়েছে ৮৫ হাজার কোটি টাকা : সমস্যাগ্রস্ত পাঁচটি ইসলামী ব্যাংক এতদিন নিয়মিত দেখিয়ে আসছিল এমন প্রায় ৮৫ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণের তথ্য উদ্ঘাটিত হয়েছে। সবমিলিয়ে পাঁচটি ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকা। মোট ঋণের যা প্রায় ৭৭ শতাংশ। বিপুল অঙ্কের খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলোর প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতি দেখা দিয়েছে ৭৪ হাজার ৫০১ কোটি টাকা।
ভোরের আকাশ/এসএইচ