-->
শিরোনাম

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পরও কমেনি তৃণমূলের কোন্দল

নিখিল মানখিন
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পরও কমেনি তৃণমূলের কোন্দল

নিখিল মানখিন: আওয়ামী লীগের তৃণমূল কোন্দল নিরসনে দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দিয়েছিলেন। গত ৬ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে আওয়ামী লীগের বিশেষ বর্ধিত সভায় তিনি এ নির্দেশ দেন। নির্দেশ প্রদানের এক মাসের বেশি সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে। কিন্তু কোন্দল রয়েই গেছে। জাতীয় নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে ততই বাড়ছে এই তৃণমূল কোন্দলের তীব্রতা। জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে গত ১৫ বছরে সৃষ্ট কোন্দল প্রকট রূপ নিয়েছে। নিজেদের মধ্যে হামলা, পাল্টা হামলার ঘটনা বেড়েই চলেছে।

 

রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চাপ মোকাবিলার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে এই দলীয় তৃণমূলের কোন্দল। কোন্দল সুরাহা করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে সংশ্লিষ্টদের।

 

গত ৬ আগস্ট সকাল সাড়ে ১০টায় প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে দলটির বিশেষ বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সভায় উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের জাতীয় কমিটি, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, জেলা বা মহানগর ও উপজেলা বা থানা অথবা পৌর (জেলা সদরে অবস্থিত পৌরসভা) আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় সংসদের দলীয় সংসদ সদস্য, জেলা পরিষদ ও উপজেলা পরিষদের দলীয় চেয়ারম্যান, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার দলীয় মেয়র এবং সহযোগী সংগঠনগুলোর কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরা। সভায় সারা দেশ থেকে প্রায় পাঁচ হাজারের মতো প্রতিনিধি অংশ নেন। উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের ৪৩ জন নেতা বক্তব্য রাখেন।

 

সভায় উপস্থিত প্রতিনিধিরা জানান, সভায় খোলামেলা কথা বলেন তৃণমূলের নেতারা। শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে ওই সভায় তারা নিজ নিজ এলাকার রাজনৈতিক সুবিধা-অসুবিধার কথা তুলে ধরেন। একই সঙ্গে আগামী নির্বাচনে জয়লাভ করতে হলে দলীয় কোন্দল নিরসনের বিকল্প নেই বলেও তারা শেখ হাসিনাকে জানান তাদের বক্তব্যের মাধ্যমে।

 

তৃণমূল নেতারা বলেন, দলের মধ্যে কোন্দল সৃষ্টি হয়েছে। আওয়ামী লীগ এখন নিজেরাই নিজেদের প্রতিদ্ব›দ্বী। অপছন্দের নেতার বিরোধিতা করতে গিয়ে কেউ কেউ দলের বিরোধিতা করে ফেলছেন। এমনকি নিজ বলয় শক্তিশালী করতে বিএনপিসহ অন্য মতাদর্শের লোকজনেরও অনুপ্রবেশ ঘটানো হচ্ছে দলে। এসব বিষয়ও দলের সভাপতি শেখ হাসিনাকে অবহিত করেন তৃণমূল নেতারা।

 

স্থানীয় এমপিসহ আওয়ামী লীগের জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে তৃণমূল নেতারা বলেন, দলীয় মনোনয়ন পেয়ে আওয়ামী লীগের যেসব নেতা এমপি, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়রসহ জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন, তারা নির্বাচিত হওয়ার পরে দলীয় নেতাকর্মীদের থেকে দূরে থাকছেন। তারা দলীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে নিজের বলয় তৈরি করছেন।

 

আত্মীয়স্বজনকে দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে আনতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। দলের জন্য কাজ করছেন না। দলের পরীক্ষিত নেতাকর্মীদের উপেক্ষা করছেন। এ ছাড়া সরকারি উন্নয়ন কর্মকান্ডেও তারা নেতাকর্মীদের পরামর্শকে গুরুত্ব দেন না। এসব কারণে অনেক জায়গায় দলের ত্যাগী নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ-অসন্তুষ্ট। যা আগামী জাতীয় নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে।

 

তারা আরও বলেন, পক্ষপাতপূর্ণভাবে টিআর-কাবিখা দিয়ে অনেক এমপি এলাকায় বদনাম করছেন এবং তারা মাই লীগ তৈরি করেছেন। শেখ হাসিনার মনোনয়ন পেয়ে অনেকে শেখ হাসিনার চেয়ে নিজেকে জনপ্রিয় মনে করেন বলেও মন্তব্য করেছেন তৃণমূলের অন্তত দুজন নেতা। তৃণমূল নেতাদের কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন, কিছু কিছু এমপি টিআর-কাবিখা নিয়ে অনিয়ম করেন, দুর্নীতি করেন।

 

টাকা খেয়ে কোনো কোনো এমপি বিএনপি-জামায়াতের জন্য চাকরির সুপারিশ করেন। ফলে আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়। তৃণমূলের একাধিক নেতা আওয়ামী লীগের অন্তঃকলহ এবং বিভক্তির জন্য এমপিদের ভূমিকাকে দায়ী করেছেন। এইসব এমপিদের বিরুদ্ধে তৃণমূলের নেতারা ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আওয়ামী লীগ সভাপতিকে আহব্বান জানান।

 

প্রায় ৭ ঘণ্টার আলোচনা শেষে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলের নেতাদের উদ্দেশ্যে দিক নির্দেশনামূলক বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, সভায় যেসব অভিযোগ এসেছে ভবিষ্যতে এমন যাতে আর না ঘটে সবাইকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এ ছাড়া আগামী নির্বাচনে যেসব নেতাকে দলীয় প্রার্থী করা হবে তাদের জন্য সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। কে মনোনয়ন পেলো আর কে পেলো না তা নিয়ে বিতর্ক করা যাবে না। এ সময় তিনি দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতে হাত তুলে নেতাদের সমর্থন জানাতে বললে উপস্থিত সবাই হাত তুলে সমর্থন জানান।

 

সভায় অংশগ্রহণককারী প্রতিনিধিরা আরও জানান, টানা চতুর্থবার ক্ষমতায় আসার জন্য আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের দিক নির্দেশনা দেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শুধু দিক নির্দেশনাই নয়, আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন কীভাবে দেয়া হবে বা কারা মনোনয়ন পাবেন না সে সম্পর্কেও তিনি সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল সম্পর্কে কড়া বার্তা দিয়েছেন। দলে ভিন্নমতাবলম্বীদের কোনো জায়গা থাকবে না বলে স্পষ্ট সতর্কবার্তা জানিয়েছেন।

 

তৃণমূল কোন্দলে জর্জরিত আওয়ামী লীগ: রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দলীয় তৃণমূল কোন্দল নিরসনে মাঠে নেমেছে আওয়ামী লীগ। দলটির বিভাগীয় টিম, জেলা ও উপজেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা ইতোমধ্যে বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে মাঠের রিপোর্ট গ্রহণ ও নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন। জেলা ও উপজেলা কমিটি ঘোষণার আগে কোন্দল নিরসনের বিষয়টি বিবেচনায় রাখা হচ্ছে। তবে পদে পদে সম্মুখীন হতে হচ্ছে নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির।

 

বিভিন্ন এলাকার তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের তৃণমূল কোন্দল নিরসন হবে না। গত ১৫ বছরে যা হয়নি, এই কয়েক মাসে তা সম্ভব নয়। এই সময়ে জাতীয় নির্বাচনে সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান এবং ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নে খুব বেশি নতুন নেতার আগমন ঘটেনি। পুরনো নেতা এবং তাদের পরিবারের সদস্যদেরকেই মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। কিন্তু এই দীর্ঘ ১৫ বছরে অনেক নতুন ও ত্যাগী নেতা পরিপক্ব হয়েছেন এবং তারা মনোনয়ন দাবি করে যাচ্ছেন। ফলে প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় মনোনয়ন প্রত্যাশীর সংখ্যা বিগত সময়ের তুলনায় কয়েকগুণ বেড়েছে।

 

উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে আওয়ামী লীগের চেইন অব কমান্ড দুর্বল হয়ে পড়েছে। সরকার ও দল একাকার হওয়ায় বেড়েছে জটিলতা। কোন্দলের শিকড় অনেক গভীরে বিস্তার লাভ করেছে। আর এসব দ্বন্দ্বে অনেক কেন্দ্রীয় নেতা, স্থানীয় সংসদ সদস্য, জেলা-উপজেলার শীর্ষ নেতা ও মনোনয়নপ্রত্যাশীরা মদদ জোগাচ্ছেন বলে মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা অভিযোগ করেছেন।

 

আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতারা অভিযোগ করেন, করোনাকালে রাজনৈতিক কার্যক্রম স্থবির ছিল। পরে গত বছর আওয়ামী লীগের বেশির ভাগ সাংগঠনিক জেলার সম্মেলন ও কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হলেও গঠিত হয়নি পূর্ণাঙ্গ কমিটি। সিংহভাগ উপজেলা, পৌরসভা ও অন্য ইউনিট কমিটিও মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে পড়েছিল দীর্ঘদিন ধরে। আর দীর্ঘদিন ধরে সম্মেলন না হওয়ায় প্রায় সব জায়গাতেই একচ্ছত্র ক্ষমতার বলয় তৈরি হয়েছে।

 

বেড়েছে দ্বন্দ্ব -কোন্দল এবং মন্থর হয়ে পড়েছে সাংগঠনিক কার্যক্রম। যার প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে। ত্যাগী, দক্ষ ও স্বচ্ছ-পরিচ্ছন্ন ইমেজের নেতারা দলে জায়গা না পেয়ে হতাশ হয়ে নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছেন। কেউ কেউ স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে পৃথক পৃথক দলীয় গ্রুপিং এ জড়িয়ে পড়েছেন।

 

অভিযোগ রয়েছে, অধিকাংশ এলাকায় আওয়ামী লীগের উপজেলা ও ইউনিয়ন কমিটি গঠনে একচ্ছত্র ক্ষমতা ব্যবহার করে থাকেন স্থানীয় সংসদ সদস্যরা। তাদের আশীর্বাদপুষ্ট লোকজন ছাড়া কমিটিতে স্থান পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে যোগ্যতার বিষয়টি বিচার-বিবেচনায় আনা হয় না। আওয়ামী লীগের বিভাগীয় টিম এবং জেলা নেতারাও অনেক সময় অসহায় হয়ে পড়েন। আর পদবঞ্চিত যোগ্য নেতারা তৈরি করেন পৃথক দলীয় বলয়। এটি শুধু আওয়ামী লীগ নয়, তার সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সব সংগঠনের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

 

তৃণমূল নেতাকর্মীরা আরো অভিযোগ করেন, স্থানীয় নির্বাচনকেন্দ্রিক বিশেষ করে উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কোন্দল এখনো রয়ে গেছে। ওইসব নির্বাচনে আওয়ামী লীগের রেকর্ডসংখ্যক বিদ্রোহী প্রার্থীর উপস্থিতি এবং বিজয় আলোচনার ঝড় তুলে। অনেক এলাকায় বিজয়ী বিদ্রোহী প্রার্থী ও বিজিত বিদ্রোহী প্রার্থীদের সঙ্গে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও পরাজিত দলীয় প্রার্থীদের দূরত্ব রয়ে গেছে।

 

যশোর জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলন বলেন, ‘আওয়ামী লীগ আজ বিভক্ত। একটা আওয়ামী লীগ, আরেকটা ‘আমি লীগ’। নৌকার টিকিট নিয়ে পাস করে জনপ্রতিনিধি হওয়ার পর আর কোনো খবর থাকে না। পাশে চাপতে দেওয়া হয় না নেতাকর্মীদের। টিআর-কাবিখা দলের কোনো নেতাকর্মী পায় না। বিএনপি-জামায়াতের লোকজনের সরকারি চাকরি হয়, আর আওয়ামী লীগের কর্মীদের হয় না। কারণ বিএনপি-জামায়াতের লোকজন টাকা বেশি দেয় আওয়ামী লীগের কর্মীরা টাকা দেয় না বলে চাকরি হয় না।’

 

হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আলমগীর বলেন, জনগণ বলে শেখ হাসিনাকে ভোট দেব- কিন্তু এলাকার নেতাদের নয়। কারণ তারা নির্বাচিত হওয়ার পরে এলাকায় যেতে চায় না। মানুষকে সেবা দেয় না, নিজেরা নিজেরা বিশৃঙ্খলা করে।

 

গাজীপুর সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রীনা পারভীন বলেন, উপজেলা চেয়ারম্যানের সঙ্গে এমপিদের সম্পর্ক খারাপ এবং তা দৃশ্যমান। উপজেলা চেয়ারম্যানের সঙ্গে স্থানীয় এমপি-মন্ত্রীরা সমন্বয় করে না। মানুষ যখন আসে তখন আশানুরূপ সেবা দেওয়া যায় না।

 

দলীয় কোন্দল নিরসনে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা অবিরাম কাজ করে যাচ্ছেন জানিয়ে রংপুর বিভাগের দায়িত্বে থাকা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী ভোরের আকাশকে বলেন, সব দলেই তৃণমূল কোন্দল রয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ একটি বড় দল। এখানেও কোন্দল থাকবে। তবে বিদ্যমান কোন্দল কিভাবে প্রশমিত করা যায়, সেজন্য দলীয় উদ্যোগ অব্যাহত রয়েছে।

 

আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন ভোরের আকাশকে বলেন, আওয়ামী লীগ একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল। এমনটি একটি রাজনৈতিক দলে কোন্দল থাকবেই। কিন্তু দলীয় ও জাতীয় স্বার্থে অভিন্ন মঞ্চে সকলের এক হওয়ার নজিরও রয়েছে। তবে দলীয় সভাপতির নির্দেশে বিদ্যমান কোন্দল যতটা সম্ভব প্রশমিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version