এম সাইফুল ইসলাম: আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে তৎপর বিএনপি। প্রতিবেশী দেশের নীতিনির্ধারকদের আস্থায় আনতে নানা কৌশলে এগোচ্ছেন দলটির নেতারা। বিএনপি ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়তে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। একসময় প্রকাশ্য সভা-সমাবেশে দেশটির বিরোধিতা করে বক্তব্য দিলেও সে পথ থেকে সরে এসেছেন দলটির শীর্ষনেতারা।
এ কারণেই ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীকে জোট থেকে সরে যেতে বাধ্য করেছে দলটি। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশটির ‘নিরপেক্ষ’ ভ‚মিকা লাভের চেষ্টার অংশ হিসেইে বিএনপির এ তৎপরতা। এজন্য দেশটির প্রতিনিধিদের সঙ্গে বাড়ানো হয়েছে যোগাযোগও।
এমন প্রেক্ষাপটে গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনারের সঙ্গে নৈশভোজে অংশ নেন বিএনপির পাঁচ নেতা। তবে বিএনপির শীর্ষনেতারা বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে রাজি নন। তারা বলছেন, প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ভালো। আর হাইকমিশনারের সঙ্গে নৈশভোজ একেবারে সৌজন্য একটি বিষয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ক্ষমতায় আসতে বিদেশিদের সহযোগিতা কামনা ভালো কাজ না হলেও টিকে থাকতে সম্পর্কোন্নয়নে অনেক দল বাধ্য হচ্ছে।
জানা গেছে, ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন নানা কারণে ভারতের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে ইসলামী ভাবধারার জামায়াতের সঙ্গে জোট করে ক্ষমতায় আসার বিষয়টি সেসময় ভারত খুব একটা ভালোভাবে নেয়নি।
এছাড়া ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল মধ্যরাতে চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানা বা সিইউএফএল জেটিঘাটে ১০ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধার ও ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সারা দেশে একযোগে জেএমবির সিরিজ বোমা হামলার ঘটনা ভারতকে নাড়া দেয়। বিশেষ করে বাংলাদেশের বড় অংশজুড়ে ভারতের সীমান্ত থাকায় দেশটি তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি জোটকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করে।
২০০৬ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতা শেষ করার পর দুই বছর ১/১১-এর মাধ্যমে অনির্বাচিত ব্যক্তিরা ক্ষমতাগ্রহণ করে। বিশেষ এ প্রেক্ষাপটের পর ২০০৮ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। তখন অনেকটাই স্পষ্ট ছিল, ভারতের সমর্থন ছিল আওয়ামী লীগের ওপর।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর উচ্চ আদালতের রায়ের মাধ্যমে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে। তখন নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পরস্পরবিরোধী অবস্থানে চলে যায়। দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে বিএনপি।
২০১২ সালের পর থেকে রাজপথের আন্দোলনে নামে বিএনপি জোট। এর মাঝে ২০১৩ সালের মার্চে ঢাকায় সফরে আসনে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি। তার সফরের সময় বিএনপির ডাকে হরতাল চলছিল। হরতাল বহাল রেখে খালেদা জিয়া তখন প্রণব মুখার্জির সঙ্গে দেখা করেননি। সেখান থেকে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক আরো খারাপ হয়ে দাঁড়ায় বিএনপির।
জাতীয় নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং বাংলাদেশে আসেন। নির্বাচন নিয়ে চলমান সংকটের মধ্যে তিনি বাংলাদেশে সফরে এসে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টিসহ বেশ কয়েকটি দলের সঙ্গে বৈঠক করেন। শেষ পর্যন্ত দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিতে তিনি জাতীয় পার্টির তৎকালীন চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে অনেকটাই ‘চাপ’ প্রয়োগ করে রাজি করেন বলে জনশ্রতি রয়েছে।
তিনি বলেন, নির্বাচন না হলে ‘মৌলবাদ চাঙ্গা’ হতে পারে। এরপর ২০১৮ সালের নির্বাচনের আওয়ামী লীগকে অনেকটাই প্রকাশ্যে সমর্থন ছিল ভারতের। তবে ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কৌশলের কাছে হেরে পরাজয়ের পর ভারতে সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে নতুন করে ভাবতে শুরু করে বিএনপি। দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসতে তাগিদ অনুভব করেন বিএনপি নেতারা।
জানা গেছে, ২০১৮ সালের পর জামায়াতকে জোটে সরাসরি না রাখার যে সিদ্ধান্ত বিএনপি নিয়েছে, সেখানে ভারতকে আস্থায় আনার বিষয়টি রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের জামায়াতবিরোধী বক্তব্যও ভারতসহ পশ্চিমাদের সন্তুষ্ট করার কৌশল বলেও অনেকে মনে করেন।
জানা গেছে, লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নিজেও চেষ্টা করছেন ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনে। কিছুদিন আগে ঢকায় ভারতের বিদায়ী হাইকশিনার বিক্রম দোরাইস্বামীর সঙ্গে বিএনপির নেতাদের একাধিকবার বৈঠকের খবর প্রকাশিত হয়েছে। এসব বৈঠকে ভারতের চাওয়া অনুযায়ী, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও মৌলবাদ মোকাবিলায় আগামীতে সোচ্চার থাকবে বলেও বিএনপির পক্ষ প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
এছাড়া বিভিন্ন সভা সমাবেশে আগের মতো ভারতবিরোধী কট্টর বক্তব্য দেয়া থেকে সরে এসেছেন বিএনপি নেতারা। মাঝেমধ্যে ভারত বিরোধী বক্তব্য দিলেও সেটিকে ‘আইওয়াশ’ বলে মনে করছেন অনেকে। ভারতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক যে আগের তুলনায় ভালো সেটির উদাহরণ হিসেবে অনেকে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদের বিষয়টি সামনে আনছেন।
সম্প্রতি শিলংয়ের আদালত থেকে অনুপ্রবেশে দায়ে করা মামলায় খালাস পান তিনি। সেখান থেকে বিএনপির সভায়ও ভার্চুয়ালি দেন সালাহউদ্দিন। দেশের রাজনীতি সক্রিয় হবে বলেও ঘোষণা দিয়েছেন তিনি যদিও আদালতের রায়ে তিনি খালাস পেয়েছেন তারপরও অনেকে মনে করছেন এখানে ভারত সরকারের ইতিবাচক মনোভাব রয়েছে।
এদিকে বুধবার রাতে বিএনপির একটি প্রতিনিধিদল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মার বাসায় যান। প্রণয় ভার্মার আমন্ত্রণে এ প্রতিনিধিদলের সদস্যরা সেখানে নৈশভোজে অংশ নেন। মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু ও সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ ওই নৈশভোজে অংশ নেন।
রোববার ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে বিএনপির বৈঠক পর ভারতীয় হাইকমিশনারের সঙ্গে ওই বৈঠকটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। বৈঠক সূত্র বলছে, মূলত নৈশভোজের আয়োজন থাকলেও সেখানে দেশের চলমান অবস্থা ও আগামী নির্বাচন স্থান পায়। বর্তমান সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয় বলেও বিএনপি নেতারা ভারতের হাইকমিশানরকে জানিয়েছেন। আগামীতে ভারতীয় হাইকশিনারের সঙ্গে আরো একাধিক বৈঠক হবে বলেও জানা গেছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ভোরের আকাশকে বলেন, আমরা সেখানে হাইকমিনারের আমন্ত্রণে নৈশভোজে গিয়েছিলাম। মূলত এটি একটি সৌজন্য সাক্ষাৎ ছিল। এখানে রাজনৈতিক বিষয়টি মূল্য ছিল না। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে বিষয়ে তিনি বলেন, প্রতিবেশী এদেশটির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কোনোদিন খারাপ ছিল বলে আমার জানা নেই।
দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে শুধু ভারত নয়, যেকোনো গণতান্ত্রিক দেশের সমর্থন যেকেউ চাইতে পারে। আর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর ড. দিলারা চৌধুরী বলেন, স্বাধীন একটা দেশে যদি ক্ষমতায় আসতে বিদেশিদের সহযোগিতা লাগে, তাহলে এদেশের মানুষের জন্য আমরা কষ্ট হয়।
আর রাজনৈতিক দলগুলোকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছা হয়। তবে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যেখানে ভারতে গিয়ে বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় রাখতে সহযোগিতা চান, সেখানে বিএনপি ভারতকে আস্থায় রাখতে চাওয়া খারাপ কিছু বলে আমি মনে করি না। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত বাংলাদেশকে নিয়ে খেলা করে এটি অসত্য নয়। তবে বিষয়টি দেশের জন্য মঙ্গলজনক নয়।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য