-->
সরকারের সঙ্গে আঁতাতের অভিযোগ

তদন্ত কমিটি গঠনে বিএনপিতে তোলপাড়

এম সাইফুল ইসলাম
তদন্ত কমিটি গঠনে বিএনপিতে তোলপাড়

এম সাইফুল ইসলাম: ঢাকা মহানগরের দুই কমিটির নেতাদের সঙ্গে সরকারের আঁতাত ও দলীয় কর্মসূচিতে নিষ্ক্রিয়দের খুঁজে বের করতে তদন্ত কমিটি গঠনের পর তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে বিএনপিতে। বিশেষ করে মহানগর নেতাদের নিয়ে খোদ দলের নেতাকর্মীদের মাঝে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। অভিযোগ অনুসন্ধান করে প্রমাণ পেলে দায়ীদের কঠোর শাস্তি দাবি করেছেন দলটির সাধারণ নেতাকর্মীরা।

 

আন্দোলনের ‘প্রাণকেন্দ্র ঢাকা’র নেতাদের নিয়ে এমন প্রশ্ন ওঠায় বেশ বিব্রত বিএনপির হাইকমান্ডও।

 

দলটির ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের নেতারা কমিটি গঠনের বিষয়টি অস্বীকার করে বলছেন, বিষয়টি জানেন না তারা। আর এ বিষয়ে গঠিত কমিটির সমন্বয়ক ও দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানও বিষয়টি নিয়ে কোনো কথা বলতে চাইছেন না।

 

জানা গেছে, আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কৌশলের কাছে হেরে ২০১৮ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের পর বেশ সতর্কভাবে পথ চলতে শুরু করে বিএনপি। অনেকটাই ‘একলা চলো নীতিতে’এগোতে থাকে দলটি। ২০২১ সালের শেষভাগে এসে করোনাভাইরাসের প্রকটতা কমলে বেশ জোরেশোরে মাঠে নামে বিএনপি। বিশেষ করে অসুস্থ দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে সুচিকিৎসায় বিদেশে পাঠোনোর দাবি ও দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে মাঠে রাজপথের এই বিরোধী দল।

 

তাতে দেশব্যাপী বেশ সাড়া পায় দলটি। ২০২২ সালের শুরু থেকে বেশ জোরেশোরে বিএনপি দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায়ে তৎপর হয়। বিশেষ করে অতীতের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ‘ঢাকাকে আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু’ ধরে বছরের শুরু থেকে মাঠে নেমেছিল বিএনপি। আন্দোলনের পাশাপাশি মিত্রদের নিয়ে ‘বৃহত্তর ঐক্য’ গঠনে কাজ শুরু করে দলটি।

 

জানা গেছে, গত জুলাইয়ের শুরু থেকেই জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদসহ ইস্যুভিত্তিক কর্মসূচিতে মাঠে আছে বিএনপি। দলটির বিশেষ কর্মসূচির মধ্যে ছিল গত ছরের ১০ সেপ্টেম্বর থেকে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণে মাসব্যাপী ১৬টি স্থানে কর্মসূচি। ঢাকার কর্মসূচি শেষ করে বিএনপি ১০ সাংগঠনিক বিভাগীয় শহরে সমাবেশের ঘোষণা দিয়ে মাঠে নামে। গত ৮ অক্টোবর চট্টগ্রামে সমাবেশের মাধ্যমে বিভাগীয় সমাবেশ শুরু হয়। নানা প্রতিবন্ধকতার পরও এসব সমাবেশে বেশ সাড়া পায় বিএনপি।

 

কিন্তু ১০ ডিসেম্বর বিএনপির ঢাকার সমাবেশ নিয়ে নানা নাটকীয় ঘটনার সৃষ্টি হয়। ‘সমাবেশস্থল’ নিয়ে বিএনপি ও সরকারের সঙ্গে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়। পুলিশ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুমতি দিলেও বিএনপি নয়াপল্টনে সমাবেশের ব্যাপারে অনড় অবস্থানে ছিলো।

 

এরপর ৭ ডিসেম্বর নয়াপল্টনে পুলিশ-বিএনপি সংঘর্ষের পর দলীয় কার্যালয়ে অবরুদ্ধ থাকাবস্থায় গ্রেপ্তার করা হয় ঢাকা মহানগর উত্তরের আহব্বায়ক আমান উল্লাহ আমান, মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহব্বায়ক আব্দুস সালাম, সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, বিএনপির প্রচার সম্পাদক ও মিডিয়া সেলের সদস্য সচিব শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানী, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সভাপতি আব্দুল কাদের ভূইয়া জুয়েলসহ অসংখ্য নেতাকর্মী। পরদিন রাতে গ্রেপ্তার হন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। এরপরও গোলাপবাগ মাঠে অনুমতি নিয়ে ১০ ডিসেম্বর সমাবেশে করে বিএনপি।

 

ওই সমাবেশের পর থেকে বিএনপি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ও উত্তরের নেতাদের অবস্থান নিয়ে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে ৭ ডিসেম্বর গ্রেপ্তারের পরদিন জামিন পান আমান উল্লাহ আমান। আমান জামিন পেলেও মামলার এজাহারে নাম না থাকলেও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ও আব্বাস জামিন না পাওয়ায় খোদ দলটির নেতাকর্মীদের মাঝে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়। এছাড়া ৭ ডিসেম্বর সংঘর্ষের পর মহাসচিব নিজে নয়াপল্টন কার্যালয়ে প্রবেশে পুলিশি বাধায় ব্যর্থ হয়ে তিনি একাই সেখানে প্রায় তিন ঘণ্টা অবস্থান করেন। ঢাকা মহানগরের ও কেন্দ্রের এত নেতাকর্মী থাকতে মহাসচিবকে সেদিন কেন একা অবস্থান করতে হয়েছে, সেটি নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।

 

এছাড়া ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশে ঢাকার বাইরে থেকে বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী যোগ দিলেও মহানগরের নেতাকর্মীদের উপস্থিতি নিয়েও প্রশ্নের সৃষ্টি হয়। লোকবল নামাতে ব্যর্থতার অভিযোগ রয়েছে মহানগর নেতাদের বিরুদ্ধে। মহাসচিব গ্রেপ্তার ও দলীয় কার্যালয়ে পুলিশের এমন অভিযানের পরও দলটি বিশেষ কোনো কর্মসূচি না দেয়ায় নেতাকর্মীদের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।

 

১০ ডিসেম্বরের ওই কর্মসূচি ঘোষণার পর থেকে আমান উল্লাহ আমানের বক্তব্য নিয়ে ঘোলাটে পরিস্থিতি তৈরি হওয়া ও তিনি গ্রেপ্তারের পরদিন জামিন পাওয়ায় নেতাকর্মীদের সন্দেহের তীর যেতে শুরু করে তার দিকে। এছাড়া জ্যেষ্ঠ নেতারা জেলে যাওয়ার পর নামসর্বস্ব ১৫ দল ও সংগঠন নিয়ে জোট গঠনের উদ্যোগে তাকে নিয়ে নতুন বিতর্কের সৃষ্টি হয়।

 

গত মাসে বিএনপি মহাসচিব জামিনের পর তার উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আমান উল্লাহ আমানকে নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা করেন দলটির জ্যেষ্ঠ নেতারা। তিনি ছাড়াও মহানগরের আরো কয়েকজন নেতার অবস্থান নিয়ে আলোচনা হয় ওই বৈঠকে। এছাড়া গত মাসের শেষভাগে অনুষ্ঠিত স্থায়ী কমিটির সভায় ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশে মহানগরের নেতারা কে কোথায় ছিলেন বা তাদের ভূমিকা কী ছিল তা নিয়েও ব্যাপক আলোচনা করা হয়।

 

সেখানে মহানগর নেতাদের অবস্থান নিয়ে আলোচনার একপর্যায়ে দলটির নীতিনির্ধারকরা দলের কর্মসূচিতে নিষ্ক্রিয়তার পাশাপাশি সরকারের সঙ্গে আঁতাত রয়েছে বলে কতিপয় নেতার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠছে, তা তদন্তে একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়। ৩ সদস্যের ওই কমিটিতে স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানকে সমন্বয়কের দায়িত্ব দেয়া হয়।

 

এই কমিটি গঠনের খবর ক্রমান্বয়ে ছড়িয়ে পড়ায় খোদ দলটির নেতাকর্মীদের মাঝে তোলপাড়ের সৃষ্টি হয়েছে। পদ ও পদবি হারানোর ভয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের একাধিক নেতা এ বিষয়ে ভোরের আকাশের এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেছেন। তারা অবিলম্বে সরকারবিরোধী আন্দোলন জোরদারে ঢাকাকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে সরকারের সঙ্গে আঁতাতকারীদের খুঁজে বের করে কমিটি থেকে বের করে দেয়ার দাবি জানান।

 

তারা বলছেন, ২০১৩-১৪ সালের আন্দোলনেও ঢাকার নেতারা রাজধানীতে জোরালোভাবে মাঠে না থাকায় সারা দেশে আন্দোলন জমে উঠলেও তাতে প্রাণ খুঁজে পায়নি। এদিকে, এমন নানা খবরে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের কমিটি ভেঙে দেয়া হতে পারে বলেও গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে ।

 

তবে, এ বিষয়ে দলটির ঢাকা মহানগরের নেতারা কথা বলতে চাইছেন না। তারা সরকারের সঙ্গে আঁতাতকারীদের তদন্তে কমিটি কমিটির গঠনের বিষয়টিও অস্বীকার করেছেন। ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব আমিনুল ইসলাম ভোরের আকাশকে বলেন, এ ধরনের কোনো কমিটি গঠনের কথা আমি জানি না। তাই বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য করতে চাই না।

 

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহব্বায়ক আব্দুস সালামও দলের নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে কমিটি গঠনের বিষয়ে জানেন না বলে দাবি করেছেন।

 

এ বিষয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে গঠিত কমিটির সমন্বয়ক ও স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে গতকাল বিকেলে তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, তিনি ঢাকার বাইরে যাওয়ার উদ্দেশে বিমানে আছেন। তাই কথা বলতে চাইছেন না। সন্ধ্যার পর তার মোবাইল ফোনে আবারো কথা বলার চেষ্টা করলে তিনি আর ফোন রিসিভ করেননি। এর আগেও তিনি এ বিষয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা না বলে ‘ক্রিটিক্যাল প্রশ্ন’ বলে এড়িয়ে গেছেন।

 

ভোরের আকাশ/নি

মন্তব্য

Beta version