-->
রাজশাহীর পর ঢাকায়ও পুলিশের ওপর হামলা

নাশকতায় ফিরছে জামায়াত

নৈরাজ্য কোনোভাবেই ফিরতে দেয়া হবে না : পুলিশ

ইমরান আলী
নাশকতায় ফিরছে জামায়াত

ইমরান আলী: রাজনৈতিক কর্মসূচিতে আবারো সংঘর্ষে জড়াচ্ছে জামায়াত-শিবির। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বিরোধিতাকারী ও নির্বাচন কমিশন থেকে নিবন্ধন হারানো দলটি সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে। বিগত ২০১২-১৩ সময়ে সারা দেশে যে নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছিল, তারই ইঙ্গিত কিনা সেটি নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েই প্রথম দিনে জামায়াত ও তাদের ছাত্র সংগঠন শিবির মারমুখী ভ‚মিকায় অবতীর্ণ হয়।

 

রাজধানীর মালিবাগ এলাকায় পুলিশের ওপর অতর্কিত হামলা করে অন্তত ১০ পুলিশকে আহত করে। এর আগে গত ১৩ ডিসেম্বর রাজশাহীতে ঝটিকা মিছিল করে পুলিশের ওপর হামলা করে। সম্প্রতি জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমানের ছেলে ডা. রাফাত সাদিক সাইফুল্লাহকে জঙ্গিবাদে জড়ানোর অভিযোগে গ্রেপ্তার করে ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম। ছেলেকে জঙ্গিবাদে জড়ানোর তথ্য গোপন ও সহায়তার অভিযোগে তাকেও গ্রেপ্তার করা হয়। বর্তমানে জামায়াত আমির জেলহাজতে রয়েছেন। বলা হচ্ছে, শিবিরের একটি অংশ জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েছে। ডা. রাফাতের সহযোগিতায় তারা পাহাড়ে প্রশিক্ষণও নিয়েছে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরাই এ ধরনের সমাবেশ থেকে বড় ধরনের নাশকতার পরিকল্পনা করছে।

 

এদিকে এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, জামায়াতের নৈরাজ্য কোনোভাবেই ফিরতে দেয়া হবে না। কঠোর হাতে দমন করা হবে। খোদ ডিএমপি কমিশনার বলেন, জামায়াত অতীতে যে সন্ত্রাসী কর্মকাÐ চালিয়েছে, তারই ধারাবাহিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে পুলিশের ওপর হামলা চালিয়েছে। আমরা কোনোভাবেই আর মেনে নেব না। যত কঠোর ব্যবস্থা নেয়া দরকার, নেয়া হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র সঙ্গে জামায়াত আমির ড. শফিকুর রহমানের ছেলে ডা. রাফাত জড়িয়ে পড়েন।

 

এর নেপথ্যে সংগঠনটিতে জড়িত অন্যদের নানাভাবে সহযোগিতা; এমনকি ব্যয়ভার বহন করেন জামায়াতে ইসলামীর আমির। সংশ্লিষ্টরা জানান, ছেলে ডা. রাফাত নতুন জঙ্গি সংগঠনে জড়িয়েছেন এটা জেনেও তাকে সমর্থন দিয়ে গেছেন জামায়াত আমির। পরে রাফাত সিলেট অঞ্চলের প্রধান সমন্বয়কের ভ‚মিকায় অবতীর্ণ হন। নতুন জঙ্গি সংগঠনটিতে জড়ানো অনেকেই শিবিরের সাথী ও কর্মী ছিলেন। তাদের হিজরতের খরচও দিয়েছেন জামায়াত আমির।

 

গত ৯ নভেম্বর জামায়াত আমিরের ছেলে ডা. রাফাতকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারও আগে আরো নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’য় জড়িয়ে ট্রেনিং ক্যাম্পে যাওয়ার জন্য সিলেট থেকে হিজরত করা তিন জঙ্গি সদস্যকে যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে ডা. রাফাতকে সিলেট থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। ডা. রাফাতের নেতৃত্বেই সর্বপ্রথম সিলেট থেকে ১১ জন বান্দরবানে হিজরত করেন। সেখানে কুকিচিনে নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসেন। ডা. রাফাতের মতো বড় সহযোগী ও সংগঠক তাহিয়াত। তাহিয়াতের নেতৃত্বে অনেকে হিজরত করে। সে কুকিচিনে প্রশিক্ষণ অবস্থায় ছিল।

 

ডা. রাফাতকে জিজ্ঞাসাবাদে সিটিটিসি জানতে পারে রাফাতের বাবা জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমানের সঙ্গে কথা বলে সম্মতিক্রমেই ২০২১ সালের জুন মাসে বান্দরবান থেকে ফিরে আসেন ডা. রাফাত। সে সময় তাকে চট্টগ্রাম থেকে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় ফিরিয়ে আনা হয়। ডা. শফিকুর রহমানের সিলেটের বাসায় বিভিন্ন সময় জঙ্গি সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনা করতেন ডা. রাফাত।

 

১১ জনসহ ছেলে যে হিজরত করেছেন এর সবই জানতেন জামায়াত আমির। ক্ষেত্রবিশেষে তিনি সহযোগিতাও করেছেন। হিজরতের সব ব্যয়ভারও তিনি বহন করেছিলেন। পুলিশ বাহিনীর গ্রেপ্তার এড়াতে ছেলেকে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতা করেছেন জামায়াত আমির। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন জঙ্গি সংগঠনে জড়িত হয়ে সিলেট অঞ্চল থেকে হিজরত করা অধিকাংশেরই আগে শিবিরের সংশ্লিষ্টতা ছিল। নতুন জঙ্গি সংগঠনে জড়িত শীর্ষ পর্যায়ের যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তারা জামায়াতে ইসলামী থেকে সহযোগিতা পেয়েছে বলে তথ্য মিলেছে।

 

এ থেকে ধারণা করা হচ্ছে, জামায়াত ও শিবিরের সঙ্গে নতুন জঙ্গি সংগঠনের যোগসূত্র রয়েছে। এর পরপরই পুলিশ জামায়াত-শিবির বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করতে থাকে। গত ১২ ডিসেম্বর রাতে জামায়াত আমির গ্রেপ্তার হলে পরের দিন ১৩ ডিসেম্বর সারা দেশে বিক্ষোভ মিছিলের ঘোষণা দেয়া হয়। আর ওই মিছিল থেকেই শিবির অধ্যুষিত এলাকা হিসেবে পরিচিত রাজশাহীতে পুলিশের ওপর হামলা করে জামায়াত-শিবির। রাজশাহীর নিউমার্কেট এলাকায় সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন পুলিশ আহত হয়। পরে স্থানীয় জনগণ ও আরো অতিরিক্ত পুলিশ জামায়াত-শিবির কর্মীরা পালিয়ে যায়। পরে সেখানে অভিযান চালিয়ে ২০ জনের বেশি জামায়াত-শিবির কর্মীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

 

এদিকে গোলাপবাগে ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশ থেকে বিএনপির ২৪ ডিসেম্বর ঢাকায় মিছিলের ডাক দেয়ার পর জামায়াতও একইদিন ডাকে মিছিল। তবে সেদিন ঢাকায় আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন থাকায় কর্মসূচি পেছাতে বাধ্য হয় বিএনপি। পরে কর্মসূচি পেছায় জামায়াতও। বিএনপির সঙ্গে মিল রেখে ৩০ ডিসেম্বর মিছিলের ঘোষণা দেয় তারাও। তারা বায়তুল মোকাররম এলাকায় মিছিলের ঘোষণা দিলেও সেখানে না গিয়ে মগবাজার থেকে মিছিল শুরু করে সরাসরি পুলিশের ওপর হামলা করে।

 

পুলিশও প্রতিরোধের চেষ্টা করে। একপর্যায়ে পুলিশের অ্যাকশনে পিছু হটতে বাধ্য হয় তারা। আহত পুলিশ সদস্যরা হলেন শরীফ মোহাম্মদ ফারুকুজ্জামান (এসি নিউমার্কেট জোন), মো. বায়েজীদুর রহমান (এসি রমনা জোন), এসআই শহীদুল ওসমান মাসুম (রমনা থানা), এসআই সুবীর কুমার কর্মকার (রমনা থানা), এসআই হাবিবুর রহমান (রমনা থানা), এসআই মোহাইমিনুল হাসান (রমনা থানা), এএসআই কবির হোসেন (রমনা থানা), এএসআই মো. ফিরোজ মিয়া (রমনা থানা), কনস্টেবল সৌরভ নাথ (পিওএম পূর্ব) ও কনস্টেবল সাদী মোহাম্মদ (পিওএম পূর্ব)।

 

ঘটনাস্থল থেকে ১১ জামায়াত-শিবির কর্মীকে গ্রেপ্তারও করে পুলিশ। এরা হলেনÑ কাউছার ইসলাম, হুমায়ুন কবির, সালাউদ্দিন, আ. রাজ্জাক, আ. আউয়াল, সাইজ উদ্দিন, মোতালেব, আরিফুল ইসলাম, মঈন উদ্দিন, আব্দুস সোবহান ও আল আমিন। এদিকে ধারাবাহিক পুলিশকে টার্গেট করে আক্রমণের ঘটনা গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বিশেষ করে বিগত ২০১২ থেকে ২০১৪ সালে সারা দেশে জামায়াত-শিবির যে নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছিল, এটি তারই ইঙ্গিত কিনা সেটি নিয়ে বিশ্লেষণ করছেন তারা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও তাদের রায় কার্যকর নিয়ে দেশব্যাপী অরাজকতা সৃষ্টি করে জামায়াত-শিবির। যানবাহনে অগ্নিসংযোগ, হত্যা; এমনকি পুলিশকে টার্গেট করে হত্যার মতো ঘটনার দায় তাদের ওপর ছিল। তবে পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, কোনোভাবেই আগের মতো জামায়াত-শিবিরের নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে দেয়া হবে না।

 

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, জামায়াত-শিবির অতীতে যে নৈরাজ্যকর কর্মকান্ড চালিয়েছিল, তা নতুন করে আর কোনোভাবেই ফিরতে দেয়া হবে না। তিনি বলেন, বগুড়ায় চাঁদে সাঈদীকে দেখা নিয়ে পুলিশ সদস্যদের খুন করেছে। গাইবান্ধায় আগুন দিয়েছে, পুলিশ সদস্যদের আগুনে পুড়িয়ে মেরেছে। অতীতে যে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালিয়েছে, তারই ধারাবাহিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে পুলিশের ওপর হামলা চালিয়েছে। আমরা কোনোভাবেই আর মেনে নেব না। যত কঠোর ব্যবস্থা নেয়া দরকার, নেয়া হবে।

 

তিনি আরো বলেন, অবৈধভাবে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা পুলিশের ওপর লাঠিসোঁটা নিয়ে আক্রমণ করে। এতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ পুলিশের ১১ সদস্য আহত হয়েছেন। পরে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দিয়ে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি বলেন, কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। জামায়াতের অতীত ইতিহাস ফিরে আসুক, এটা আমরা কোনোভাবেই মেনে নেব না। কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

 

গোয়েন্দারা বলছেন, জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া নামের যে জঙ্গি সংগঠন, এর অধিকাংশই শিবিরের রাজনীতিতে জড়িত ছিল। তারাই মূলত দেশের অভ্যন্তরে নাশকতার সুযোগ খুঁজছে। এরা পাহাড়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তবে সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতিসতর্কতার কারণে তারা সুযোগ পাচ্ছে না।

 

সিটিটিসিপ্রধান মো. আসাদুজ্জামান বলেন, গ্রেপ্তার ডা. রাফাত আগে ছাত্র শিবির করতেন। যাদের আমরা গ্রেপ্তার করেছি তারা সবাই ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র ট্রেনিং ক্যাম্পে যাওয়ার জন্য হিজরত করেছিলেন। আবার তারা প্রত্যেকেই শিবিরের সাথী ছিলেন। রাফাতের সহযোগী আরিফও শিবিরের সাথী ছিলেন।

 

যিনি নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’য় যোগ দেয়ার আগে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সিলেট অঞ্চলের প্রধান সমন্বয়কের ভ‚মিকা পালন করেছেন। সিসিটিসিপ্রধান বলেন, নতুন জঙ্গি সংগঠনটির সঙ্গে জামায়াতের সরাসরি সংশ্লিষ্টতা ও সমর্থন রয়েছে।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version