-->

তৃণমূল গোছাচ্ছে আ.লীগ

নিখিল মানখিন
তৃণমূল গোছাচ্ছে আ.লীগ

নিখিল মানখিন: দলীয় তৃণমূল কোন্দল নিরসনে মাঠে নেমেছে আওয়ামী লীগ। দলটির বিভাগীয় টিম, জেলা ও উপজেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা ইতোমধ্যে বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে মাঠের রিপোর্ট গ্রহণ ও নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন। জেলা ও উপজেলা কমিটি ঘোষণার আগে কোন্দল নিরসনের বিষয়টি বিবেচনায় রাখা হচ্ছে। তবে পদে পদে সম্মুখীন হতে হচ্ছে নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির। উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে গত ১৩ বছরে সৃষ্ট কোন্দল স্থায়ী ও প্রকট রূপ নিয়েছে। হিমশিম খেতে হচ্ছে সংশ্লিষ্টদের।

 

আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র জানায়, বিএনপিকে নানাভাবে চাপে রাখার পাশাপাশি দল, বিশেষ করে তৃণমূল গোছাতে হাত দিয়েছে আওয়ামী লীগ। দল এবং তার সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের সম্মেলনের মাধ্যমে তৃণমূল কোন্দল নিসরনের চেষ্টা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে যারা যোগ্যতা থাকার পরও পদ-পদবি পান না, তাদেরও সমন্বয় করা হচ্ছে। তারা জেলায় না পেলে উপজেলা, উপজেলায় না পেলে ইউনিয়ন, ইউনিয়নে না পেলে ওয়ার্ডে সমন্বয় করা হচ্ছে। মূল দলে সুযোগ না পেলে সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ পদ দিয়ে গ্রুপিং শেষ করা হচ্ছে।

 

দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা ইতোমধ্যে বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে মাঠের রিপোর্ট গ্রহণ ও নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন। সর্বশেষ বৈঠকে উপস্থিত সাংগঠনিক সম্পাদকদের কযেকজন ভোরের আকাশকে জানান, দলের তৃণমূল পর্যায়ের পরিস্থিতি সার্বক্ষণিক মনিটরিং করে যাচ্ছেন দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা। সর্বশেষ বৈঠকে আগামী নির্বাচন ও দলের রূপরেখা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে, সে কথা উপস্থিত সম্পাদকদের স্মরণ করিয়ে দেন প্রধানমন্ত্রী। দলের ভেতরে কোনো সমস্যা থাকলে তা সমাধানের জন্য করণীয় এবং সংগঠনকে আরো শক্তিশালী কীভাবে করা যায়, তৃণমূলকে ঐক্যবদ্ধ কীভাবে করা যায়, তা নিয়ে ভাবতে বলেছেন। বিএনপি-জামায়াতের ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত ও অপপ্রচারের বিরুদ্ধে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাদের কীভাবে ঐক্যবদ্ধ করানো যায়; সে বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। দীর্ঘদিন পর অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে দায়িত্বপ্রাপ্ত সম্পাদকদের কাছে দলীয় সভাপতি জানতে চেয়েছেন, কোন জেলায় কী অবস্থা। বৈঠকে আনুষ্ঠানিকভাবে আট বিভাগের দলীয় রিপোর্ট দলের প্রধানের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এসব রিপোর্ট গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হচ্ছে। তৃণমূল পর্যায়ে কোথায় কোথায় দ্বন্দ্ব-কোন্দল চলমান, কোথায় এমপিরা ক্ষমতার প্রভাব দেখাচ্ছেনÑ রিপোর্টে এসব বিষয় গুরুত্ব পেয়েছে। কয়টি জেলা ও উপজেলায় সম্মেলন হয়েছে, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে কোথায় এবং কেন নৌকা হেরেছে, তৃণমূলের দ্বন্দ্বের কারণ কী, এমপিরা কীভাবে নিজেদের প্রভাব ধরে রাখছেন; সেসব বিষয়ে সার্বিক চিত্র রিপোর্টে তুলে ধরেছেন সাংগঠনিক সম্পাদকরা।

 

বৈঠক উপস্থিত নেতারা জানান, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দলকে ঢেলে সাজাতে চান আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। তবে করোনাভাইরাসসহ নানা কারণে দলটির তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে তার বৈঠক হয়নি। পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হওয়ায় এখন থেকে সিরিজ বৈঠকে বসছেন সভাপতি। বৈঠকে সারা দেশের জেলা ও উপজেলা কমিটি গঠন কতটা সম্পন্ন হয়েছে আর কতটা বাকি আছে, এসব রিপোর্ট নিয়ে আগে থেকেই গণভবনে যাওয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল বলে জানান বৈঠকে উপস্থিত কয়েকজন নেতা।

 

তৃণমূল সমস্যা : আওয়ামী লীগের তৃণমূল সমস্যা নিরসন করতে গিয়ে দলীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা পদে পদে সম্মুখীন হচ্ছেন নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির। উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে গত ১৩ বছরে সৃষ্ট কোন্দল স্থায়ী ও প্রকট রূপ নিয়েছে। হিমশিম খেতে হচ্ছে সংশ্লিষ্টদের।

 

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষক মহল মনে করছেন, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে আওয়ামী লীগের চেইন অব কমান্ড দুর্বল হয়ে পড়েছে। সরকার ও দল একাকার হওয়ায় বেড়েছে জটিলতা। কোন্দলের শিকড় অনেক গভীরে বিস্তার লাভ করেছে। আর এসব দ্বন্দ্বে অনেক কেন্দ্রীয় নেতা, স্থানীয় সংসদ সদস্য, জেলা-উপজেলার শীর্ষ নেতা ও মনোনয়নপ্রত্যাশীরা মদদ জোগাচ্ছেন বলে মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা অভিযোগ করেছেন। আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতারা অভিযোগ করেন, করোনাকালে রাজনৈতিক কার্যক্রম স্থবির হয়ে কয়েক দফা উদ্যোগের পরও আওয়ামী লীগের ৭০টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে অধিকাংশ জেলার সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়নি। সিংহভাগ উপজেলা, পৌরসভা ও অন্য ইউনিট কমিটিও মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে পড়েছিল দীর্ঘদিন ধরে। আর দীর্ঘদিন ধরে সম্মেলন না হওয়ায় প্রায় সব জায়গাতেই একচ্ছত্র ক্ষমতার বলয় তৈরি হয়েছে। বেড়েছে দ্বন্দ্ব-কোন্দল এবং মন্থর হয়ে পড়েছে সাংগঠনিক কার্যক্রম। যার প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে। ত্যাগী, দক্ষ ও স্বচ্ছ-পরিচ্ছন্ন ইমেজের নেতারা দলে জায়গা না পেয়ে হতাশ হয়ে নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছেন। কেউ কেউ স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে পৃথক পৃথক দলীয় গ্রুপিংয়ে জড়িয়ে পড়েছেন।

 

অভিযোগ রয়েছে, অধিকাংশ এলাকায় আওয়ামী লীগের উপজেলা ও ইউনিয়ন কমিটি গঠনে একচ্ছত্র ক্ষমতা ব্যবহার করে থাকেন স্থানীয় সংসদ সদস্যরা। তাদের আশীর্বাদপুষ্ট লোকজন ছাড়া কমিটিতে স্থান পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে যোগ্যতার বিষয়টি বিচার-বিবেচনায় আনা হয় না। আওয়ামী লীগের বিভাগীয় টিম এবং জেলা নেতারাও অনেক সময় অসহায় হয়ে পড়েন। আর পদবঞ্চিত যোগ্য নেতারা তৈরি করেন পৃথক দলীয় বলয়। এটি শুধু আওয়ামী লীগ নয়, তার সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সব সংগঠনের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

 

তৃণমূল নেতাকর্মীরা আরো অভিযোগ করেন, স্থানীয় নির্বাচনকেন্দ্রিক বিশেষ করে উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কোন্দল এখনও রয়ে গেছে। ওইসব নির্বাচনে আওয়ামী লীগের রেকর্ডসংখ্যক বিদ্রোহী প্রার্থীর উপস্থিতি এবং বিজয় আলোচনার ঝড় তুলে। অনেক এলাকায় বিজয়ী বিদ্রোহী প্রার্থী ও বিজিতা বিদ্রোহী প্রার্থীদের সঙ্গে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও পরাজিত দলীয় প্রার্থীদের দূরত্ব রয়ে গেছে। সংসদ সদস্য মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতারা সব সময় আশা করেন উপজেলা, থানাসহ অধীন শাখা কমিটিগুলোতে নিজের অনুসারী নেতারা যাতে পদ পান। তৃণমূলের নেতারা পক্ষে থাকলে দলীয় মনোনয়ন পাওয়া সহজ হবে। এ হিসাব থেকেই মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতারা দলের পদে নিজের অনুসারীদের বসাতে জোরালো চেষ্টা করতে গিয়ে যোগ্য ও ত্যাগী নেতাদের সরিয়ে দেয়ার ঘটনাও ঘটছে।

 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ক্ষমতার দীর্ঘ বছরে দল ও সরকার যেন একাকার হয়ে গেছে। আগামী ২৪ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এই কাউন্সিল অধিবেশনে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে দল এবং সরকারকে আলাদা করা, যা নিয়ে আওয়ামী লীগের মধ্যে নানা রকম আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী দল এবং সরকারকে আলাদা করতে চান। যারা দলের নেতা হবেন, তারা সার্বক্ষণিক হবেন। তারা সরকারে থাকতে পারবেন নাÑ এরকম একটি ভাবনা তার মধ্যে রয়েছে বলে গুঞ্জন রয়েছে। তবে একাধিক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যের সঙ্গে কথা বলে দেখা গেছে, মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা দল এবং সরকার আলাদা করার যে কৌশল, সেই কৌশলের সঙ্গে একমত নন। কেন্দ্রীয় কমিটির নেতারা যদি সার্বক্ষণিক থাকেন, তাহলে দলকে শক্তিশালী করা অনেক সহজ হয়। দল এবং সরকার আলাদা করার বিতর্কে কারা জয়ী হয়, তা বোঝা যাবে আগামী সপ্তাহের আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে।

 

এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ ভোরের আকাশকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের ভিত্তি খুবই মজবুত। আগামী ২৪ ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন। এর আগেই তৃণমূল পর্যায়ের সম্মেলনগুলো শেষ করা হবে। যেহেতু আওয়ামী লীগ একটি বড় দল, তাই সম্মেলনে নেতাকর্মীদের মধ্যে একটু কোন্দল দেখা দেবেÑ এটাই স্বাভাবিক। কারণ পোস্ট তো একটা। এ কারণেই তৃণমূল পর্যায়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে। তবে আমরা চেষ্টা করছি, যাতে এ থেকে বেরিয়ে আসা যায়। কেউ সংগঠনবিরোধী কর্মকাণ্ড করলে তাকে শাস্তি পেতে হবে।’

 

আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন ভোরের আকাশকে বলেন, আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার নির্দেশনায় ইতোমধ্যে তৃণমূলের সংগঠনগুলোকে শক্তিশালী করতে সম্মেলন হচ্ছে। অনেক জায়গায় সম্মেলন হয়ে গেছে। বাকিগুলো দলের কেন্দ্রীয় সম্মেলনের আগেই শেষ হবে। তবে আওয়ামী লীগ বড় দল। সম্মেলনের মধ্য দিয়ে নতুন রক্তের সঞ্চালন ঘটে। তাই দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটতে পারে। এগুলো প্রশমিত করতে দল কাজ করছে। দল তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। কারণ দিন শেষে আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ।

 

ভোরের আকাশ/আসা

মন্তব্য

Beta version