-->
প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব পরিস্থিতির অবনতি ঘটাবে : রাজনৈতিক বিশ্লেষক

জনসমাবেশমুখী রাজনীতি

নিখিল মানখিন
জনসমাবেশমুখী রাজনীতি

ঢাকা: সমাবেশমুখী হয়ে উঠছে দেশের রাজনীতি। হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচিতে আস্থা ও আগ্রহ নেই দেশের মানুষের। বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে জনসমাবেশ ঘটিয়ে রাজপথ দখলে রাখতে মরিয়া দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল। চলছে জনসমাগম ঘটানোর পাশাপাশি বাগ্্যুদ্ধের প্রতিযোগিতা। দুদলের এই প্রতিযোগিতা যত বেশি শৃঙ্খলার বাইরে যাবে, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির তত বেশি অবনতি ঘটবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

 

জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে নানা কৌশলে জনমুখী কর্মসূচিতে নজর দিচ্ছে আওয়ামী লীগ-বিএনপি। চলছে ভিন্ন ভিন্ন কৌশলে জনগণের কাছে যাওয়ার চেষ্টা। টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে ২০১৫ সালের পর রাজপথের নিয়ন্ত্রণ য়োর মতো কোনো আন্দোলন করতে পারেনি বিএনপি। একের পর এক আন্দোলনে ব্যর্থতা, দলীয়প্রধানের সাজা এবং জাতীয় নির্বাচনে চরম বিপর্যয়ে বিএনপি একরকম বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। সংগত কারণে বিরোধীদের কোনো চাপ ছাড়াই আওয়ামী লীগ ব্যাপক স্বস্তি নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে।

 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সম্প্রতি জনসম্পৃক্ত ইস্যুতে আন্দোলনের কর্মসূচি দিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে বিএনপি। গত আগস্ট থেকে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে লোকসমাগম করার ওপর বেশ গুরুত্ব দিয়ে আসছে তারা। আগস্ট থেকে দলটি শুধু তাদের নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনেই সমাবেশ করে। আর ১৭ আগস্ট পাল্টা সমাবেশ করে নিজেদের শক্তি দেখিয়ে দেয় আওয়ামী লীগ। গত সেপ্টেম্বরে প্রায় পুরো মাসজুড়ে নয়াপল্টনে নেতাকর্মীদের নিয়ে সমাবেশ করেছে বিএনপি। প্রায় প্রতিদিন নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করে নিজেদের শক্তির জানান দেয়ার ইঙ্গিত দেন দলটির নেতারা। যদিও কয়েক বছর ধরেই শীর্ষ নেতাদের ছাড়া রাজনীতির মাঠে সরব থাকার চেষ্টা করছে দলটি। গত ১ সেপ্টেম্বর দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে রাজনীতিতে একটি বড় ধরনের শোভাযাত্রা করে নিজেদের শক্তি জানান দেয় বিএনপি।

 

সেই দিন প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর শোভাযাত্রা শুরুর আগে এক সমাবেশে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এ মিছিলের মধ্য দিয়ে বিএনপি দেশবাসীকে জানিয়ে দেবে বিএনপি এখন দেশের সবচেয়ে বড় দল।

 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনীতিতে সমাবেশমুখিতার সূত্রপাত গত ৮ অক্টোবর বিএনপির কর্মসূচিকে ঘিরে। ওই দিন নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারসহ আরও দাবিতে প্রতি শনিবার বিভাগীয় শহরে সমাবেশের ঘোষণা দেয় বিএনপি। প্রথম শনিবার চট্টগ্রামে সমাবেশ করে দলটি। এরপর দ্বিতীয় শনিবার ময়মনসিংহ, তৃতীয় শনিবার খুলনা, তার পরের শনিবার রংপুরে সমাবেশ করেছে দলটি। ৫ নভেম্বর বরিশালে সমাবেশ। আগামী ১০ ডিসেম্বর রাজধানীতেও বড় ধরনের সমাবেশের ঘোষণা আছে। বিভাগীয় এ কর্মসূচিগুলো ছাড়াও বিএনপি, তার সহযোগী সংগঠনগুলো ঢাকায় যেসব সমাবেশ করছে, সেগুলোতে নেতাকর্মীদের সমাগম দেখা যাচ্ছে, যা দলটির গত কয়েক বছরের সমাবেশে দেখা যায়নি।

 

সম্প্রতি সমাবেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বিরোধী রাজনীতি নিশ্চিহ্নে সরকার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছে। মামলা-হামলা-গুমের মাধ্যমে দেশে একটা ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে, যাতে কেউ সরকারের অপকর্মের প্রতিবাদে রাজপথে নামতে না পারে। কিন্তু জনগণের দল হিসেবে বিএনপি জনসম্পৃক্ত ইস্যুতে রাজপথে আন্দোলন করছে। নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বিএনপির নেতাকর্মীরা সাহসের সঙ্গে রাজপথে নেমেছেন। এ ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হবে। সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত সবাইকে রাজপথে থাকতে হবে। এবার রাজপথেই হবে ফয়সালা। আর মাঠে থেকেই মোকাবিলা করা হবে যে কোনো পরিস্থিতি।

 

আওয়ামী লীগের কর্মসূচি : ভিন্ন কৌশলে জনসমাবেশ ঘটিয়ে রাজপথ দখলে রেখে বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশসহ সব জনসমাবেশের পাল্টা জবাব দিতে চায় আওয়ামী লীগ। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সম্মেলন এবং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতিÑ দুটিই একসঙ্গে শুরু করতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ। নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে ঢাকায় ছয়-সাতটি বড় সমাবেশ করবে দলটি। এ ছাড়া এখন থেকেই বিভিন্ন দিবসভিত্তিক ও দলীয় কর্মসূচির মাধ্যমে রাজপথে নিজেদের শক্ত অবস্থান ধরে রাখবে তারা। আর আগামী ২৪ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দলের ২২তম জাতীয় সম্মেলন হবে।

 

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী ফোরাম কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে দলের কেন্দ্রীয় সম্মেলন, নির্বাচনের প্রস্তুতি এবং রাজপথে অবস্থান ধরে রাখতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালনসহ বেশ কিছু সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়েছে। গত ২৮ অক্টোবর গণভবনে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৈঠকের মাঝখানে বিরতির সময় গণভবনের গেটে এসে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি জানান, আগামী ২৪ ডিসেম্বর দলের ২২তম কেন্দ্রীয় সম্মেলন হবে। এ ছাড়া ৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের পলোগ্রাউন্ডে বড় সমাবেশ করা হবে। ওই সমাবেশে দলের সভাপতি শেখ হাসিনা উপস্থিত থাকবেন বলে জানান দলটির সাধারণ সম্পাদক।

 

আরেকটি অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আওয়ামী লীগ যে সাংগঠনিক কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে, তা বিএনপির কর্মসূচির পাল্টাপাল্টি নয়।

 

দলীয় সূত্র জানায়, বৈঠকে তিনি বলেছেন, আগামী কয়েক মাস প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন বিভাগীয় ও জেলা শহরে সরকারি কর্মসূচিতে অংশ নেবেন। সরকারি এসব কর্মসূচিতে অংশ নেয়ার পাশাপাশি তিনি দলীয় সমাবেশ করবেন। এর মধ্যে ৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের পলোগ্রাউন্ডে সমাবেশ হবে। এরপর কক্সবাজার, যশোরসহ অন্যান্য শহরেও সমাবেশ হবে।

 

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সূত্রগুলো বলছে, আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ নয়, বিএনপির মূল লক্ষ্য সরকার পতন। যে কারণে রাজপথে সাংগঠনিক শক্তি দেখানো ছাড়া বিএনপির সামনে বিকল্প কিছু নেই। এটি বিবেচনায় রেখেই বিএনপিকে মোকাবিলার কৌশল ঠিক করা হচ্ছে।

 

ঢাকায় আগামী দুই মাসের কর্মসূচির মধ্যে যুবলীগের ৫০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠান হবে ১১ নভেম্বর। এরপর আওয়ামী লীগের সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের মধ্যে পাঁচ-ছয়টি জাতীয় সম্মেলন করা হবে। ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের সম্মেলন হতে পারে ডিসেম্বরের শুরুতে। এগুলোতে বড় জমায়েত হবে। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের দিন আওয়ামী লীগের বিজয় শোভাযাত্রা এবার বড় আকারে করার পরিকল্পনা আছে।

 

আওয়ামী লীগের জেলা পদমর্যাদার কমিটি আছে ৭৮টি। এ পর্যন্ত ৪৮টির সম্মেলন সম্পন্ন হয়েছে। বাকি ৩০টি জাতীয় সম্মেলনের আগে সম্পন্ন করার কথা। এর বাইরে আছে উপজেলা সম্মেলন। আওয়ামী লীগও জেলা সম্মেলন ও দলের সভাপতি শেখ হাসিনার জেলা সমাবেশগুলোতে বড় জমায়েত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে দলীয় সূত্র জানায়।

 

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ ভোরের আকাশকে বলেন, আওয়ামী লীগ বিএনপির পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি পালন করতে যাচ্ছে না। আওয়ামী লীগ নিজেদের দল গোছানোর কাজে আছে। আর তা শুরু হয়েছে বেশ আগেই। বিএনপি তাদের কর্মসূচি পালন করবে। আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দল হিসেবে তারাও রাজপথে থাকবে- এটাই স্বাভাবিক।

 

ভোরের আকাশ/আসা

মন্তব্য

Beta version