-->
শিরোনাম

৬৬ বছরেও স্বকীয়তায় অটুট দেশবন্ধু সুইটমিট

আশীষ কুমার দে
৬৬ বছরেও স্বকীয়তায় অটুট দেশবন্ধু সুইটমিট

আয়তন কিংবা পরিধি যাই হোক, বয়স ৬৬ বছর; অর্থাৎ সাত দশক ছুঁই ছুঁই। এই দীর্ঘ পথপরিক্রমায় অনেক কিছুর সাক্ষী হয়ে স্বকীয়তা ও ঐতিহ্য অটুট রেখেছে ঢাকার একটি জলখাবারের দোকান ‘দেশবন্ধু সুইটমিট’। প্রতিষ্ঠানটির নামকরণেরও একটা ইতিহাস রয়েছে।

সময়টা ৫০ এর দশকের শেষ দিক। শচী মোহন গোপ তখন রাস্তায় দুধ, দই আর মাঠা বিক্রি করতেন। তিনিই ১৯৫৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘দেশবন্ধু সুইটমিট অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট’। খাবার আইটেম হিসেবে ছিল সকাল আর সন্ধ্যার জন্য পরোটা, লুচি, হালুয়া, লাবড়া আর ৩-৪ প্রকারের মিষ্টি। দেশবন্ধু হিসেবে পরিচিত ছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশ। তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর। তাদের জীবনদর্শন শচী মোহনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। এ কারণে মতিঝিলে ইত্তেফাক পত্রিকা অফিসের বিপরীতেই নিজের করা রেস্তোরাঁর নাম রাখেন দেশবন্ধু। ইত্তেফাকের সংবাদকর্মীরা নাশতা করতে আসতেন সেখানে। আর তাদের মাধ্যমেই অল্পদিনে ছড়িয়ে যায় দেশবন্ধু সুইটমিটের নাম। এই জলখাবারের দোকানে প্রায় ৪২ বছর ধরে কাজ করছেন বাবুল দেবনাথ। তিনি জানালেন, বিখ্যাত অনেকের পদধূলি পড়ার কথা।

বাবুল বলেন, এমন একটা সময় ছিল যখন কবি, লেখক, শিল্পীরা এদিকে আসতেন, আড্ডা দিতেন। এই রেস্টুরেন্টে চলচ্চিত্র জগতের লোকজনও আসতেন। তখন তো গুলিস্তানের এদিকেই ছিল শহর। পুরান ঢাকাও খুব জমজমাট। আর তার সঙ্গে মতিঝিলের এদিকটাও ৬০ এর দশক থেকে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছিল। এদিকে বাণিজ্যিক বিভিন্ন ভবনও ছিল। তখন আমাদের দোকানের বিপরীতে ইত্তেফাকের অফিস। প্রথমে এর সম্পাদক ছিলেন মানিক মিয়া; তিনি মুক্তিযুদ্ধের আগেই মারা যান। আমি তার গল্প শুনেছি। এখানে এক সময় আসতেন তিনি, সঙ্গে আরও নামকরা সব সাংবাদিক।

বাবুল দেবনাথ আশির দশকের শুরু থেকে কাজ করছেন এখানে। সে সময় প্রতিষ্ঠাতা শচী মোহন গোপ বেঁচে ছিলেন। তার কাছেই এসব গল্প শুনেছেন। বাবুল দেবনাথ বলেন, ‘শচী বাবু মারা গেছেন ১৯৮৫ সালে। এখন মিডিয়ার লোকজন আগের রমতো আসেন না। কিন্তু ৬০-৭০ এর দশকে এখান থেকে বহুবার এফডিসিতে নাশতা গেছে। এখানকার হালুয়া (সুজি), পরোটা আর ভাজির খ্যাতি ছিল পুরো ঢাকায়। এখনও আশপাশ তো বটে, বাইরে থেকেও লোকজন খেতে আসে। এই হোটেলের নাশতা রাজ্জাক, কবরী, শাবানাদেরও পছন্দের ছিল।

বিভিন্ন অনুষ্ঠান বা আয়োজনে আশপাশের প্রতিষ্ঠানগুলো খাবার নিতো এখান থেকে। রেস্তোরাঁয় পরোটা, ভাজি (লাবড়া), হালুয়ার পাশাপাশি আছে ৪-৫ রকমের মিষ্টি। ছানা আমিত্তি, কালাই আমিত্তি, কালোজাম, রসগোল্লা ও রাজভোগ। এ ছাড়া শিঙাড়া, নিমকি, লাড্ডু, দই।

বাবুল দেবনাথ আরো জানান, তাদের দইটা পুরো টক না; টক-মিষ্টি মেশানো দুধের দই। দোকানের শুরু থেকেই আছে এটা। আর দুপুরেও খাবার হিসেবে ভাত, রুই মাছ, মুড়িঘণ্ট, মুরগি, খাসি এসব পাওয়া যায়। সেটাও অনেকদিন আগে, অর্থাৎ শচী মোহন থাকতে থাকতেই চালু হয়েছিল। এখন দোকান তার ছেলে শ্যামল গোপের মালিকানায় চলছে। দোকানে বসার জন্য ৬টি টেবিল আছে। প্রায় ২৪-২৫ জন এক সময়ে বসে খেতে পারেন।

তিনি বলেন, দোকানে আইটেম এই কয়টাই। কিন্তু সকাল ৭টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত একনাগাড়ে বিক্রি চলে। সকালেও পরোটা, হালুয়া ও ভাজি চলে, সন্ধ্যায়ও তাই। মিষ্টির ভেতর আমিত্তি, রসগোল্লা বেশি চলে। মাসকালাইয়ের আমিত্তিটা ছানার চেয়ে বেশি বিক্রি হয়।

বাবুল দেবনাথের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই দেখা গেল, কেউ খাচ্ছেন, কেউ আবার পার্সেল নিচ্ছেন। স্থানীয় একজন শিক্ষার্থী শুধু ৩ প্লেট সবজি পার্সেল নিলেন। জানা গেল, এই সবজি তথা লাবড়া আর হালুয়া চাহিদার শীর্ষে। লাবড়াটি আলু, পটল, পেঁপে, বেগুন, মিষ্টি কুমড়ার মিশ্রণ। সঙ্গে পাঁচফোড়নের ব্যবহার এর স্বাদকে আলাদা করতে ভূমিকা রেখেছে। হালুয়াটি সুজির; যা তখন একেবারে শেষ পর্যায়ে। অনেকেই পরোটা-লুচির সঙ্গে মিষ্টির তুলনায় এটি বেশি পছন্দ করেন। তবে দোকান শুরুর পর শচী মোহন গোপ মাঠা কিংবা দুধ রাখেননি। রেখেছিলেন দই। সেই টক-মিষ্টি স্বাদের দইয়ের ওপরে সরের তেমন আস্তরণ নেই। দই নরম ও মিষ্টি পরিমিত।

এক সময় এখানে চলচ্চিত্র ও সাহিত্য অঙ্গনের অনেকে আসতেন। এখন আর তেমন আসেন না। তাহলে কি বার্ধক্য ছুঁয়ে ফেলেছে দেশবন্ধুকে? তবে বাবুল দেবনাথ তা মনে করেন না। তিনি বললেন, শহরের পরিবর্তন তো একটা ব্যাপার। তখন শহর ছিল গুলিস্তান, ওয়ারী, মতিঝিলের দিকে। আশির দশক থেকে অন্যান্য জায়গায় শহর গড়ে উঠতে থাকে। ৯০ দশকের পর আরো পরিবর্তন ঘটেছে। তবে এখনো এখানে অন্যান্য এলাকা থেকে অনেক মানুষ আসে। ৯০ দশকেও তো এখান থেকে এফডিসিতে অনেকবার নাশতা গেছে।

এখন সবদিকে নতুন অনেক দোকান হয়েছে। আবার কবি-লেখকদের আড্ডার অন্য জায়গা তৈরি হয়েছে। এছাড়া খাবারের ধরনেও পরিবর্তন এসেছে। লুচি বা পরোটার সঙ্গে সবজি/ লাবড়ার জায়গায় অনেকের ফাস্টফুড, বার্গার, ফ্রাই এসব আইটেম পছন্দ। তবে দেশবন্ধুর নাশতা এখনো অনেক জনপ্রিয়।

এছাড়া শুরু থেকে নাশতার জন্য দোকানটি বেশি পরিচিত হলেও দুপুরে লাঞ্চ আইটেমও খুব চলে। আশপাশের অফিসগুলোতে যারা চাকরি করেন, তারা খেতে আসেন। তাই রেস্টুরেন্ট এখনো খুব ভালো অবস্থায় আছে, লোকসমাগম ভালো, প্রাণবন্ত আছে, যোগ করেন বাবুল দেবনাথ।

দেশবন্ধুর আরেক কর্মী মিন্টু দত্ত বলেন, শুক্র ও শনিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন। তাই এ দুদিন লোক একটু কম হয়। কিন্তু অফিস চলার দিনগুলোয় দুপুর কিংবা বিকেলে অনেক সময় সবার বসার জায়গা দেওয়া যায় না। তাই বয়স ৬৬ বছর হলেও দেশবন্ধু সুইটমিটকে বৃদ্ধ বলা যায় না। রেস্তোরাঁটি কোলাহলমুখর তারুণ্যই ধরে এখনো রেখেছে। ধরে রেখেছে স্বকীয়তা ও ঐতিহ্য।

ভোরের আকাশ/ সু

মন্তব্য

Beta version