-->

দৌলতদিয়ার অন্ধগলি ছাড়তে চান তারা

মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ
দৌলতদিয়ার অন্ধগলি ছাড়তে চান তারা

মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ: কেউ ভুল মানুষের প্রেমে পড়ে হাত বদল হয়ে চলে এসেছিল যৌনপল্লিতে। কাউকে চাকরির নাম করে বিক্রি করে দেয়া হয় অন্ধগলিতে। আবার কারো জন্মই এখানে। শীত-বসন্ত-বর্ষা সুখে দুখে এখানেই পার করেছে বছরের পর বছর। দেহ বিক্রি করে খেত এরা। একসময় দেহের জৌলুস ছিল। অর্থকষ্টও তেমন ছিল না। তাদের দেখে চোখ ঝলসে যেতো সব বয়সের খদ্দেরের।

 

পেটের দায়ে দিন রাত এক করে খদ্দেরের মনোরঞ্জনে কাজ করে যেত এরা। মিলত কিছু বকশিও। এভাবে মেঘে মেঘে বেলা গড়িয়েছে। বয়সের ভাঁজে পড়ে কমেছে দেহের জৌলুস। খদ্দেরের দেখা নেই। ফলে কমে গেছে আয়। ঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে অভাব। এখন এ পল্লি ছেড়ে বের হতে চান তারা। কিন্তু কোনো উপায় দেখছেন না তারা। ফলে অনাহারে অর্ধহারে দিন কাটছে তাদের।

 

জানা গেছে, যৌনপল্লিতে প্রায় ৫ হাজার মানুষের বসবাস। এখানে যৌনকর্মীর সংখ্যা ১ হাজার ৩০০ জন। এর মধ্যে ১ হাজার ৫০ জন নিয়মিত। বাকিরা অনিয়মিত। প্রায় ৩০০ বাড়ি রয়েছে। শিশুর সংখ্যা ৬০০। বর্তমানে সাড়ে ৩৫০ বয়স্ক নারী রয়েছেন। মূলত করোনাভাইরাসের সময় থেকে রাজবাড়ীতে দেশের সর্ববৃহৎ দৌলতদিয়া যৌনপল্লিতে মানবেতর জীবনযাপন করছেন যৌনকর্মীরা। পদ্মা সেতু চালুর পর পল্লিতে শুরু হয়েছে হাহাকার। খদ্দেরের অভাবে জীবিকা সংকটে রয়েছেন তারা। সবচেয়ে বেশি কষ্টে আছেন পঞ্চাশোর্ধ্ব নারীরা।

 

এখন আর সেই আগের মতো ভিড় নেই। সুনসান নীরবতা চারদিকে। এক সময় পল্লির প্রধান গলিতে ভিড় লেগে থাকলেও সেই গলি এখন অনেকটাই ফাঁকা। খদ্দেরের আশায় নারীরা সেজে ঘরের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তবে এখন আর খদ্দের সেভাবে আসে না বলে জানান বেশ কয়েকজন যৌনকর্মী।

 

যৌনকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পল্লির অবস্থা একসময় ভালো ছিল। বর্তমানে খুব খারাপ। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর দৌলতদিয়া ফেরিঘাট ও লঞ্চঘাটে লোকজন আসে না। সবাই পদ্মা সেতু হয়ে যায়। তাই আমাদের হাহাকার শুরু হয়েছে। আমরা এখন চলে যেতে চাই। কিন্তু আমাদের তো যাওয়ার মতো কোনো জায়গা নেই। সরকার যদি আমাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে দেয় তাহলে বেঁচে থাকতে পারব।

 

সেখানে কথা হয় এক যৌনকর্মীর সঙ্গে। তিনি বলেন, দিন তারিখ মনে নেই কবে আসছিলাম। তবে শুধু মনে আছে, যেদিন সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে হত্যা করা হয় সেদিন এখানে আমার আসা। আমার বাড়ি ঝিনাইদহ। তিন সন্তান রয়েছে। তারা এ জগত থেকে অনেক দূরে। আমি একাই পল্লিতে আছি। আমার বয়স ৫০ বছরের ঊর্ধ্বে। পল্লির ভেতরে মানুষের বাড়িতে কাজ করে খাই। কাজের সংকট সৃষ্টি হয়েছে। আমরা এখান থেকে চলে যেতে চাই। আরেকজন বলেন, দৌতলদিয়া ফেরিঘাটে যখন যানজট লেগে থাকতো তখন ভালো ছিলাম। খদ্দের আসতো পল্লিতে। কিন্তু এখন কেউ খবর নেয় না। আমরা এখান থেকে চলে যেতে চাই। সরকার যদি আশ্রয়ণের ঘরে থাকার জায়গা করে দিতেন আমরা চলে যেতাম।

 

গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাকির হোসেন বলেন, দেশের সবচেয়ে বড় যৌনপল্লি দৌলতদিয়া। পদ্মা সেতু চালুর পর এখানে ভিন্ন প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে। আমি সরেজমিনে সেখানে গিয়েছিলাম। পল্লির সবাই আমাদের সমাজের অংশ। সেখানে কয়েকটি সংস্থা কাজ করে। আমি নির্দেশনা দিয়েছি ৫০ বছরের ওপরের নারীদের তালিকা প্রস্তুত করতে। চিন্তাভাবনা করব তাদের কীভাবে পুনর্বাসন করা যায়।

 

পল্লিতে রয়েছে ‘অসহায় নারী ঐক্য সংগঠন’। সংগঠনের সভানেত্রী ঝুমুর বেগম বলেন, পল্লির মধ্যে ৩৫০ জন বয়স্ক নারী আছেন। তাদের চরম খাদ্য সংকট শুরু হয়েছে। তারা এখন চলে যেতে চায়। গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাকির হোসেন এসেছিলেন। তিনি বলেছেন, ‘৫০ বছরের ঊর্ধ্বে যারা আছেন তাদের একটি তালিকা প্রস্তুত করতে’।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version